ইফতেখার রায়হান : আটক মাদক কারবারিকে নতুন মামলায় না জড়ানো এবং আদালতে চালান না দেয়ার শর্তে দেয়া হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। পুলিশের সোর্স পরিচয়ে সেই টাকা নিচ্ছেন এক যুবক। এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর তোলপাড় চলছে। ঘটনাটি ঘটেছে গাজীপুর মেট্রোপলিটন এলাকায়।
ভিডিওতে দেখা যায়, টঙ্গীর কেরানীরটেক বস্তির মাদক কারবারি রুনা বেগমকে মামলা না দেয়ার শর্তে সোর্সের মাধ্যমে ৪ লাখ টাকা ঘুষ নেন পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম। বস্তির একটি কক্ষে ব্যাগভর্তি টাকা বের করার দৃশ্যসংবলিত গোপন ভিডিও ফাঁস হয় সম্প্রতি।
ভিডিওতে মোবাইল ফোনে পুলিশের সোর্স হৃদয়ের কণ্ঠে শোনা যায় ‘স্যার, পুরাটাই পাইছি’। এ কথা শোনার পর ওসি বলেন- ‘চলে আসো, চলে আসো’।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পুবাইল থানার এক মাদক মামলার এজাহারভুক্ত পলাতক আসামি রুনাকে গ্রেপ্তারে ১ অক্টোবর সন্ধ্যায় টঙ্গী পূর্ব থানাধীন কেরানিরটেক বস্তিতে অভিযান চালায় পুবাইল থানা পুলিশ। অভিযানকালে পুলিশের সঙ্গে অভিযুক্ত মাদক কারবারি ও স্থানীয়দের ধস্তাধস্তি এবং ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।
পুলিশ লাঠিপেটা করে ঘটনাস্থল থেকে রুনাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে আসে। এ সময় পুলিশের কাজে বাধা দেওয়া ও পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় তার স্বামী সুমনকেও আটক করা হয়।
ওইদিন গভীর রাতে রুনার হায়দ্রাবাদের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ২০০ পিস ইয়াবা জব্দ করা হয় বলে দাবি পুলিশের। পরদিন পুবাইল থানায় মাদক মামলা ও টঙ্গী পূর্ব থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা করে পুলিশ। মামলা হওয়ার পর গোপন ক্যামেরায় করা ভিডিওটি ফাঁস করে দেন রুনার স্বজনরা।
তবে পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, মোবাইল ফোনের ওই কণ্ঠ তার নয়। সোর্স নামধারী হৃদয়কেও তিনি চেনেন না।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যায়, রুনাকে গ্রেপ্তারের পরদিন রুনার স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে কেরানীরটেক বস্তিতে যান সোর্স হৃদয় ও আরেক মাদক কারবারি মুহুরি আলাউদ্দিন। সেখানে একটি কক্ষে সোর্স হৃদয় ও আলাউদ্দিন রুনার স্বজনদের জানান, ৫ লাখ টাকা ঘুষ দিলে আসামি রুনা ও তার স্বামী সুমনকে অন্য মামলায় চালান দেবে না পুলিশ।
এক পর্যায়ে ব্যাগ থেকে ৪ লাখ টাকা বের করে সোর্স হৃদয়ের হাতে দেন রুনার স্বজনরা। ওই টাকা পেয়ে সোর্স হৃদয় বলেন, ‘আমি স্যারের সঙ্গে এক মিনিট কথা বলে নেই।’
পরে মোবাইল ফোনে পুলিশের এক কর্মকর্তাকে ফোন দেন হৃদয়। রুনার স্বজনদের দাবি ওই পুলিশ কর্মকর্তা পুবাইল থানার ওসি শফিকুল ইসলাম।
ওই সময় সোর্স হৃদয়ের মোবাইল ফোন লাউড স্পিকার দেয়ায় গোপন ভিডিওতে ওসির কণ্ঠ শোনা যায়। সোর্স হৃদয় টাকা গ্রহণের পর ওসি ‘চলে আসো, চলে আসো’ বলে দ্রুত ফোন কেটে দেন। যাওয়ার আগে হৃদয় বলে যান, ‘আমি আপনার ছোট ভাই। আপনার বোন ও বোনের স্বামীর কিছু হবে না। তাকে অন্য কোনো মামলায় চালান দেবে না।’
স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের সোর্স পরিচয় দিয়ে হৃদয় প্রায়ই টাকা দাবি করে আসছিল। টাকা না দিলেই পুলিশের মাধ্যমে নানা অজুহাতে মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে হয়রানি করা হয়।
রুনার বোন কারিমা আক্তার বলেন, ‘আমার বোন ও বোনের জামাইকে ছেড়ে দেয়ার কথা বলে ৫ লাখ টাকা দাবি করে পুলিশ। আমার বোন প্রথমে এক লাখ টাকা দেবেন বলে জানান। এরপর ৪ লাখ টাকাই দেয়া হয়। অথচ আমার বোন ও ভগ্নিপতির বিরুদ্ধে পৃথক তিনটি মামলা করা হয়েছে।’
সূত্রে জানা যায়, পুবাইল থানায় ১৬ আগস্ট দায়ের হওয়া মাদক মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা এসআই হুমায়ূন কবির। পুলিশের এই কর্মকর্তা টঙ্গী পূর্ব থানায় থাকাকালে বিভিন্ন মাদক কারবারির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। পুবাইল থানায় বদলি হওয়ার পরও এই থানায় মাদকসহ কেউ গ্রেপ্তার হলে মামলায় আসামির তালিকায় টঙ্গী পূর্ব থানা এলাকার মাদক কারবারিদের নাম জুড়ে দেন তিনি। এরপর চার্জশিট থেকে নাম বাদ দেয়ার কথা বলে অর্থ হাতিয়ে নেন।
টঙ্গী পূর্ব থানার বাসিন্দা হয়েও মাদক কারবারি রুনার নাম পুবাইল থানার মামলায় অন্তর্ভুক্তিও এভাবেই হয়েছে বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। আর এক থানার পুলিশ অন্য থানায় আসামি রুনাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে পুলিশের সঙ্গে মাদক কারবারি ও এলাকাবাসীর ধস্তাধস্তির মতো ঘটনা ঘটে।
সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা যায়, অভিযানের সময় ঘটনাস্থলে পুলিশের সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন কথিত সোর্স হৃদয়। পরদিন টাকা লেনদেনের ঘটনায়ও মূল ভূমিকায় দেখা যায় হৃদয়কে। এমনকি ১৬ আগস্ট রুনার বিরুদ্ধে দায়ের করা পুবাইল থানার এক মাদক মামলার এজাহারেও এক নম্বর সাক্ষীর নাম হৃদয়।
এ বিষয়ে পুবাইল থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেন। বলেন, ‘হৃদয়কে তো পুলিশ সেখানে পাঠায়নি। এটা তাদের (সোর্সদের) টাকা নেয়ার কৌশল। হৃদয়টা কে আমরা তো জানি না। আপনারা তাকে খুঁজে বের করেন।’
তবে ওসি হৃদয়কে চেনেন না দাবি করলেও কথিত সোর্স হৃদয়ের দাবি, তিনি পুবাইল থানার বিভিন্ন অভিযানে গাড়ি ভাড়া দেন। রুনাকে গ্রেপ্তারের দিনও তিনি গাড়িসহ অভিযানে অংশ নেন। রুনার পরিবারের কাছ থেকে টাকা নেয়ার কথা স্বীকার করলেও সেই টাকা ফেরত দিয়েছেন বলে দাবি করেন সোর্স হৃদয়।
কে এই হৃদয়?
টঙ্গীর মাদক কারবারিদের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ব্যাংকের মাঠ বস্তির শীর্ষ মাদক কারবারি মোমেলা বেগমের মেয়ের স্বামী হৃদয়। ভুয়া পুলিশ ও সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে এর আগে একাধিক বার গ্রেপ্তার হন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, হৃদয়ের ব্যবহৃত গাড়ি দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মাদক নিয়ে আসে মাদক কারবারিরা। সোর্স পরিচয়ে বিভিন্ন মানুষকে হয়রানি করে টাকা আদায় করার অভিযোগ রয়েছে হৃদয়ের বিরুদ্ধে। ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে সাংবাদিক পরিচয়ে প্রতারণার চেষ্টাকালে দুই নারীসহ চার ভুয়া সাংবাদিককে আটক করে পুলিশ। ওই চারজন প্রতারকের একজন এই হৃদয়। সূত্র : নিউজবাংলা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।