জুমবাংলা ডেস্ক : সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ হাজার সনদ জাল হয়েছে বলে ধারণা করছেন প্রতিষ্ঠানটি থেকে সদ্য ‘অব্যাহতি’ পাওয়া উপাচার্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক।
তিনি বলেন, ‘২০২২-২৩ সালের ৫০০টি সনদ যাচাই করে আমি হিসাব করে দেখেছি, ১০৫টি সনদ জাল আছে। অর্থাৎ মোট সনদের ২০ শতাংশ সনদ জাল। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমাদের ২০-২৫ হাজার শিক্ষার্থী বের হয়েছেন। এর মধ্যে সেই হিসেবে ৬ হাজার সনদ জাল হয়েছে বলে ধারণা করছি। আর এগুলোর একেকটিতে ৫ লাখ টাকা করে লেনদেন হয়েছে, যা হিসাব করলে ৩০০ কোটির উপরে দাঁড়ায়।’
অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হকের দাবি, ১০৫টি জাল সনদের ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার আগেই তাকে সরানো হয়েছে।
গত ২০ এপ্রিল ট্রাস্ট্রি বোর্ড এর সভা শেষে সদস্য সচিব (বিওটি) সরওয়ার জাহান স্বাক্ষরিত একটি চিঠি মো. মোজাম্মেল হকের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়। এতে বলা হয়েছে, ‘সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব থেকে আপনাকে সাময়িক অব্যাহতি (সাসপেনশন) দেওয়া হলো। এই সাময়িক অব্যাহতির আদেশ সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী আপনার বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের জন্য বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সর্বসম্মতিক্রমে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো। আপনার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের মাত্রা প্রকৃতি ও মাত্রা বিবেচনা করা হয়। আপনি সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার জন্য অবৈধ কার্যকলাপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা ভঙ্গ, আর্থিক অনিয়ম অসদাচারণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, ন্যায়পরায়ণতা, বৈধতা, স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য হয়েছি। এই সিদ্ধান্ত ২১ এপ্রিল ২০২৪ থেকে কার্যকর হবে।’
চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, ‘অব্যাহতিকালীন সময়ে আপনাকে আপনার ভূমিকার সাথে সম্পর্কিত সকল প্রকার দাপ্তরিক কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করা হলো। একই সাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতে সাময়িকভাবে নিষেধ করা হলো।’ ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছে, আপনার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা হবে এবং আপনাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ ইস্যু করা হবে।’
২০২১ সালের ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন আচার্য ও রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদ চার বছরের জন্য অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হককে সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ওই বছরের ১ এপ্রিল তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সে হিসেবে উপাচার্য হিসেবে তার মেয়াদ শেষ হবে আগামী বছরের ৩১ মার্চ।
তবে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিকে ট্রাস্ট্রি বোর্ডের দেওয়া এই অব্যাহতিতে মানা হয়নি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০। আইন অনুযায়ী, দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য (চ্যান্সেলর) রাষ্ট্রপতি। ওই আইনে বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর কোনও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্ট্রি বোর্ড কর্তৃক প্রস্তাবিত কোনও ব্যক্তিকে চার বছর মেয়াদের জন্য উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিযুক্ত করিবেন। এতে আরও বলা হয়েছে, চ্যান্সেলর সুস্পষ্ট ও গ্রহণযোগ্য কারণে বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সুপারিশক্রমে ভাইস চ্যান্সেলরকে অপসারণ করতে পারবেন। তবে শর্ত থাকে যে অপসারণের সিদ্ধান্তের আগে সংশ্লিষ্ট ভাইস চ্যান্সেলরকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিতে হবে।
অব্যাহতি পাওয়া ভিসি মো. মোজাম্মেল হক অভিযোগ করে বলেন, আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগ দেওয়া হয়নি। ২০ এপ্রিল ট্রাস্ট্রির এক সভায় হঠাৎ করে আমাকে বাইরে যেতে বলা হয়। এর কিছুক্ষণ পরে আমাকে অব্যাহতির চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়।
তিনি আরও বলেন, আমাকে অবৈধভাবে গুণ্ডার মতো হুমকি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। অথচ আমাকে রাষ্ট্রপতি ব্যতিত কেউ অপসারণ করতে পারেন না। কেবল জাল সনদও আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার আশঙ্কায় এটি করা হয়েছে। আর কেলেঙ্কারি ফাঁস করলে সরওয়ার জাহান ও যারা জাল সনদ কিনেছেন তারাসহ অনেকেই ফেঁসে যেতে পারেন।
অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, দীর্ঘদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অচলাবস্থা বিরাজমান। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা। একজন মাত্র ব্যক্তি সরওয়ার জাহান ২০০৩ সাল থেকে ট্রেজারার ছিলেন। ট্রাস্ট্রি বোর্ড এর সদস্য সচিব ও সাবেক ট্রেজারার সরওয়ার জাহান জাল সনদ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। ২০২১ সালের মার্চে দায়িত্ব গ্রহণের পর বিশ্ববিদ্যালয়ের কতগুলো জাল সনদ দেওয়া হয়েছে সেটি অভ্যন্তরীণভাবে তদন্ত করেন জানিয়ে তিনি বলেন, ৫০০টি স্নাতক সনদ যাচাই করে দেখতে পাই ১০৫টি ভুয়া বা জাল।
সরওয়ার জাহান ট্রেজারার থাকাকালীন ২০১০ সালে গঠিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে বহু টাকা সরিয়ে নিয়েছেন উল্লেখ করে অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এক হিসেবে দেখা যায়, তিনি বিগত দশ বছরে ১ কোটি ৭৮ লাখ টাকা তুলেছেন। যা ইন্টারেস্টসহ ৩ কোটির উপরে দাঁড়ায়। তাদের কাছে বিওটি জানতে চাইলে তারা প্রথমে জানাতে চাননি। তখন তারা বলে যে এটা বললে তাদের চাকরি থাকবে না। একসময় তৎকালীন ট্রেজারার সরওয়ার জাহান বিষয়টি স্বীকার করলেন যে এই টাকাগুলো একটি একাউন্টে জমা আছে এবং সেখানে আর টাকা জমা রাখা হয় না। আমি প্রতিবাদ করলাম এবং বললাম এই টাকাগুলো ফেরত দিয়ে দিতে। তখনই তিনি বললেন, আমি এটার মালিক আমি ফেরত দেব কেন? আমার প্রতিষ্ঠান, আমার টাকা আমি নিয়েছি আপনার সমস্যা কোথায়?’
অব্যাহতি পাওয়া ভিসি আরও বলেন, ‘সরওয়ার জাহান একটি জায়গা থেকে ৭৫ লাখ টাকা লোন করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরিশোধ বাবদ ২৮ লাখ টাকা তুলেও নিয়েছেন। কিন্তু কেন লোন করেছেন সেটি তিনি জানাননি। এমনকি বোর্ডও সবসময় এটিকে পাত্তা দিচ্ছিল না। মিটিংয়ে এজেন্ডা দিলেও কাগজপত্র নেই, ডকুমেন্টস নেই বলে বলে কালক্ষেপণ করতেন। এভাবে ৮-১০ কোটি টাকার যখন দুর্নীতি হলো তখন আমি আমার দায়িত্ব মতে ইউজিসি, মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিষয়টি আমার নিয়োগকর্তা মাননীয় চ্যান্সেলরকে জানিয়েছি। এরপর সেখান থেকে একটি তদন্ত কমিটি হলে বোর্ড আমার উপর ক্ষিপ্ত হয়। যদিও বোর্ডে কয়েকজন সৎ ব্যক্তি সবসময় দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।’
অধ্যাপক ইঞ্জিনিয়ার মো. মোজাম্মেল হক বলেন, ‘আমাদের অনলাইনে সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনে সরওয়ার জাহান সবসময় কারও সঙ্গে কোনও যোগাযোগ ছাড়াই ক্লিয়ার দিয়ে দিতেন। আমি অভিযোগ পেলাম অনলাইনে কতগুলো ভুয়া সাইট তৈরি করে জাল সনদ দেওয়া হচ্ছে। এরপর আমি সার্টিফিকেট ভেরিফিকেশনটাকে অফলাইন করে দিলাম। তারপর বোর্ডে অভিযোগ দেওয়া হলো, আমরা ভেরিফিকেশন করতে বিলম্ব করছি। আমরা বললাম কোনগুলো দেরি হচ্ছে দেখান। যেগুলো ফেইক বা জাল সেগুলো ভেরিফিকেশন করতে সময় লাগবে।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ট্রেজারার ও বর্তমানে বোর্ড অব ট্রাস্ট্রির সদস্য সচিব সরওয়ার জাহানকে একাধিকবার অনলাইন ও অফলাইনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। এমনকি তার হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিবেদক প্রশ্ন লিখে পাঠালেও তিনি উত্তর দেননি।
এসব বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্ট্রিজের সদস্য ও চট্টগ্রাম-৮ আসনের সংসদ সদস্য আবদুচ ছালাম ও লিয়াকত আলীকে একাধিকবার কলা করা হলেও তারা সাড়া দেননি।
বোর্ডের সদস্য মামুন সালামও ব্যস্ততা দেখিয়ে কথা বলতে রাজি হননি।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) থেকে হওয়া তদন্ত কমিটির চেয়ারম্যান ও ড্যাফোডিল ইউনিভার্সিটির ডিন প্রফেসর ড. শামসুল আলম বলেন, ‘সাউদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে উঠা নানা অভিযোগের বিষয়ে আমাদের তদন্ত এখনও চলমান রয়েছে।’
সূত্র : একুশে পত্রিকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।