আন্তর্জাতিক ডেস্ক: দক্ষিণ এশিয়ার দেশ শ্রীলংকার অর্থনৈতিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হচ্ছে। নগদ অর্থ, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পাশাপাশি জ্বালানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্য সংকট প্রকট হচ্ছে। জ্বালানি সরবরাহ ব্যবস্থায় উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় দেশটির পেট্রল পাম্পগুলোয় সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। এছাড়া ডলার সংকটে পড়ে দুটি দেশের দূতাবাস ও একটি দেশের কনসাল জেনারেলের কার্যালয় বন্ধ করে দিতে হয়েছে।
শ্রীলংকায় অর্থাভাব দেখা দেয়ায় দূতাবাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চলতি মাসের শেষদিন বন্ধ হচ্ছে ইরাকের বাগদাদ ও নরওয়ের অসলোতে অবস্থিত শ্রীলংকান দূতাবাস এবং অস্ট্রেলিয়ার সিডনির কনসাল জেনারেলের অফিস। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে দেশের বাইরের কূটনৈতিক মিশনগুলো পরিচালনায় নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছিল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শ্রীলংকার ৬৩টি কূটনৈতিক মিশন ছিল। এর মাধ্যমে সে সংখ্যা ৬০-এ নেমে এল।
ভারত মহাসাগরে অবস্থিত এ দ্বীপরাষ্ট্রটিতে জ্বালানির সংকট এ পর্যায়ে পৌঁছেছে যে প্রতিদিন নিয়ম করে ৭-৮ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। পাশাপাশি উচ্চমূল্যে জ্বালানি ও গাড়ির তেল কিনতেও দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকেও মিলছে না রান্নার কাজে ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় কেরোসিন। জ্বালানির জন্য দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষারত অবস্থায় কথাকাটাকাটির জের ধরে ও গরমে দেশটিতে তিনজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। শুধু তা-ই নয়, অবৈধভাবে জ্বালানি মজুদ করে রাখা হচ্ছে এবং অপর্যাপ্ত সরবরাহ ব্যবস্থারও অভিযোগ উঠেছে। এ অবস্থায় জ্বালানি সরবরাহ কার্যক্রমে সহায়তা করতে দেশের পেট্রল পাম্পগুলোয় সেনা মোতায়েনের ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সেনাসদস্যরা পেট্রল পাম্প ও কেরোসিন সরবরাহের স্থানগুলোর আশপাশে অবস্থান নেবেন। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র নিলান্ত প্রেমারত্নে বলেন, প্রতিটি জ্বালানি সরবরাহ কেন্দ্রে অন্তত দুজন সেনাসদস্য মোতায়েন থাকবেন। মানুষের চাপ সামলাতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে তাদের নিয়োজিত করা হচ্ছে না। এ সেনাসদস্যরা কেবল জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কাজ করবেন।
সরকারের মুখপাত্র রমেশ পাঠিরানা বলেন, সাধারণ মানুষকে সহায়তা করতে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। মানুষের অধিকার হরণ করতে নয়, বরং মানুষকে সাহায্য করতেই তারা নিয়োজিত থাকবেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহের ঘাটতি সাধারণ মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছে। এ ক্ষোভ সহিংসতার দিকে মোড় নিতে পারে বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে। অপেক্ষার সারি যত লম্বা হচ্ছে, বিক্ষোভের আশঙ্কা তত বাড়ছে বলেও মনে করে প্রতিরক্ষা সম্পর্কিত সূত্রগুলো। সে কারণে পরিস্থিতি উত্তাল হওয়ার আগেই পুলিশের পাশাপাশি সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
শ্রীলংকার মোট জনসংখ্যা ২ কোটি ২০ লাখ। এ পরিমাণ মানুষের জন্য যতগুলো জ্বালানি সরবরাহের কেন্দ্র রয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশই পরিচালিত হয় রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সিলন পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের অধীনে। মূলত এ কেন্দ্রগুলোতেই সেনা মোতায়েন থাকবে। দেশটির জ্বালানি সংকটের নানা চিত্র উঠে এসেছে গণমাধ্যমের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও। একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পর্যটক বহনকারী একটি বাহন আটকে বিক্ষোভ করছেন একদল নারী। তারা বলছেন, রান্নার কাজে ব্যবহার করার জন্য পর্যাপ্ত কেরোসিন পাচ্ছেন না তারা। আবার বহু ছবি ও ভিডিওতে উঠে আসছে পেট্রল পাম্পগুলোর সামনে অপেক্ষমাণ মানুষের দীর্ঘ সারির ছবি।
অর্থনৈতিক এ সংকট উত্তরণে দেশের সব রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে সম্মেলনের ডাক দিয়েছেন লংকান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। যেখানে সবার সঙ্গে মিলে এ সংকটের বিষয়ে আলোচনা করতে চান তিনি। কিন্তু বিরোধী দল এ সম্মেলনে যোগ না দেয়ার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে।
নানা কারণে নড়বড়ে ছিল শ্রীলংকার অর্থনীতি। কভিড-১৯ মহামারীর কারণে হুমকিতে পড়ে দেশটির উপার্জনের সবচেয়ে বড় খাত পর্যটন। মূলত এ খাতের হাত ধরেই শ্রীলংকায় প্রবেশ করত বৈদেশিক মুদ্রা। যেহেতু মহামারীর কারণে পর্যটন খাত একেবারেই বন্ধ ছিল, তাই আয়ও বন্ধ ছিল। আবার মহামারীর কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণও কমে যায় উল্লেখযোগ্য হারে। সব মিলিয়ে দেশটির সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করে। অর্থাভাবে জ্বালানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্য, ওষুধ, গুঁড়ো দুধের মতো পণ্যও আমদানি বন্ধ হয়ে গেছে।
অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব পড়েছে প্রতিটি শ্রীলংকানের জীবনে। কাগজ ও কালির সংকটের কারণে বন্ধ রাখতে হয়েছে লাখো শিক্ষার্থীর পরীক্ষা। গত সোমবার নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের এ পরীক্ষা শুরু হওয়ার কথা ছিল। বিদ্যুৎ সংকট তো এখন দেশের মানুষের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ১৯৪৮ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে এবারই সবচেয়ে খারাপ মন্দার মুখোমুখি হয়েছে শ্রীলংকা।
ঋণের ভারে জর্জরিত দেশটি আগের ঋণগুলোই এখনো পরিশোধ করে উঠতে পারেনি। তার পরও পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছেও আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ওষুধ ও খাদ্য কেনার জন্য শ্রীলংকাকে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দেয়ার বিষয়ে চুক্তি করেছে ভারত।
Own the headlines. Follow now- Zoom Bangla Google News, Twitter(X), Facebook, Telegram and Subscribe to Our Youtube Channel