ঠাকুরগাঁওয়ে চিনির বিকল্প হিসেবে চাষ হচ্ছে স্টেভিয়া। চিনির চেয়ে মিষ্টি এই ফসল চাষ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন অনেকেই। প্রতি কেজি পাতা ৫০০০ টাকার কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
জেলার সদর উপজেলার পারপূগী গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে চিনির চেয়ে ৩০০ গুণ বেশি মিষ্টি ঔষধি গুণ সম্পন্ন গাছ ‘স্টেভিয়া’। স্টেভিয়া চাষে সহায়তা করছে বাংলাদেশ সুগার ক্রপস গবেষণা ইনস্টিটিউট।
ঠাকুরগাঁও সুগার ক্রপস গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরিফুল ইসলাম বলেন, সদর উপজেলার শিবগঞ্জ পারপূগী গ্রামে দুই একর জমিতে ও পীরগঞ্জে দুই একর জমিতে স্টেভিয়া চাষ হচ্ছে।
জানা গেছে, গত বছর পরীক্ষামূলক চাষে সাফল্যের পর কৃষকপর্যায়ে স্টেভিয়া চাষ ছড়িয়ে দিতে চারা উৎপাদন শুরু করে গবেষণা ইনস্টিটিউট। প্রশিক্ষণও দেয়া হয় কৃষকদের। কৃষকরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন স্টেভিয়া চাষে। বায়ো-টেকনোলজি গবেষণা কেন্দ্রে স্টেভিয়া গাছের বংশবিস্তার ও গুণাগুণ যাচাই করেন ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।
এর আগে ২০০১ সালে থাইল্যান্ড থেকে গাছ সংগ্রহ করা হয়। দেশের জলবায়ুর সঙ্গে সহনশীল করে তুলতে ঠাকুরগাঁওয়ের আঞ্চলিক কেন্দ্রে এ উদ্ভিদ নিয়ে দীর্ঘ গবেষণা চালায় প্রতিষ্ঠানটি। পরে এর চাষ নিয়ে কৃষক পর্যায়ে দেয়া হয় প্রশিক্ষণ। ঠাকুরগাঁওয়ে চলতি বছর কৃষক পর্যায়ে চাষ শুরু হয়েছে।
ডায়াবেটিস তথা ব্লাড সুগার নিয়ন্ত্রণে রাখে, উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন প্রতিরোধ করে, যকৃত, অগ্ন্যাশয় ও প্লীহায় পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করে, স্টেভিওসাইড অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নিঃসরণে সহায়তা করে, ত্বকের ক্ষত নিরাময় ও দাঁতের ক্ষয় রোধ করে, E. colimn বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া দমন করে, খাদ্য হজমে সহায়তা করে, স্টেভিয়াতে কোনো ক্যালরি না থাকায় স্থূলতা রোধ করে, শরীরের ওজন কমাতে সহায়তা করে, মিষ্টি জাতীয় খাবারে চিনির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করা যায়, খাবারে গুণাগুণ বৃদ্ধি করে ও সুগন্ধ আনয়ন করে, শরীরের সুস্থতা ও সতেজতাবোধ সৃষ্টি করে।
উৎপাদন কৌশল : বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু স্টেভিয়া চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এদেশে সারা বছরই সফলভাবে স্টেভিয়া চাষ করা সম্ভব।
সুনিষ্কাশিত ও জৈব পদার্থযুক্ত বেলে দো-আঁশ মাটি স্টেভিয়া চাষের জন্য ভালো। লাল মাটি ও অপেক্ষাকৃত ক্ষারীয় মাটিতে স্টেভিয়া ভালো জন্মে। আমাদের দেশে বৃষ্টির পানি জমে না এরকম উঁচু সুনিষ্কাশিত জমিতে স্টেভিয়া চাষ করতে হবে।
পৃথিবীতে স্টেভিয়ার প্রায় ৯০টির মতো জাত আছে। এর বিভিন্ন জাত বিভিন্ন আবহাওয়ার জন্য উপযোগী। স্টেভিয়ার গুণাগুণ নির্ভর করে এর পাতায় বিদ্যমান স্টেভিওসাইডের ওপর।
পাতায় স্টেভিওসাইড উৎপাদন একই সঙ্গে গাছের বয়স, জাত ও আবহাওয়ার ওপর নির্ভরশীল। স্টেভিয়ার বাণিজ্যিক জাতের পাতায় কমপক্ষে ১০ ভাগ স্টেভিওসাইড থাকতে হয়।
স্টেভিয়া বাণিজ্যিকভাবে সাধারণত বেডে চাষ করতে হয়। বেডের উচ্চতা হতে হবে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি। বেডে সারি থেকে সারি দূরত্ব হবে এক ফুট এবং সারিতে গাছ হতে গাছের দূরত্ব হবে ৬ ইঞ্চি। ৫ থেকে ৬টি চাষ দিয়ে জমিকে ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। মই দিয়ে জমির ওপরের ঢেলা ভেঙে মিহি করে নিতে হবে।
দুভাবে স্টেভিয়ার বংশবৃদ্ধি করা যায়। প্রথমত টিস্যু কালচার পদ্ধতি এবং দ্বিতিয়ত স্টেম কাটিং পদ্ধতি। তবে টিস্যু কালচার সবচেয়ে ভালো ও লাভজনক পদ্ধতি। কারণ স্টেম কাটিং এ সফলতার হার খুবই কম এবং কাটিং এ শিকড় গজাতে অনেক বেশি সময় লাগে। বীজ থেকে চারা গজালেও অঙ্কুরোদগমনের হার থাকে খুবই কম।
জমিতে গাছের সংখ্যানির্ভর করে মাটি ও আবহাওয়ার ওপর। তবে লাভজনকভাবে চাষের জন্য একর প্রতি ৪০ হাজার গাছ বা হেক্টরপ্রতি এক লাখ গাছ লাগানো উত্তম।
স্টেভিয়ার সফল চাষনির্ভর করে জমিতে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদানের ওপর। জমিতে ফসফেট ও পটাশ সারের পরিমাণ ইউরিয়া অপেক্ষা বেশি হতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ইউরিয়া সার স্টেভিয়া পাতার মিষ্টতা কমিয়ে দেয়। তাই স্টেভিয়া চাষের জন্য জৈব সারই সর্বোত্তকৃষ্ট।
স্টেভিয়া চাষের জন্য সারাবছরই মাটিতে পরিমিত আর্দ্রতা থাকতে হবে। তবে গাছ অতিরিক্ত আর্দ্রতা সহ্য করতে পারে না। সাধারণত শীতকালে একবার এবং গ্রীষ্মকালে ২ থেকে ৩ বার ঝাঁঝরির সাহায্যে হালকা সেচের ব্যবস্থা করতে হবে। মাসে একবার বেডের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে।
তবে মালচিং করলে একই সঙ্গে আগাছা দমন হয় আবার আর্দ্রতাও সংরক্ষণ হয়। খড়-কুটো, কচুরিপানা বা কম্পোস্ট দিয়ে মালচিং করা যায় যা গাছের শিকড়কে মাটির সঙ্গে সুসংহত করে।
স্টেভিয়ায় পোকামাকড়ের আক্রমণ ও রোগবালাই কম হয়ে থাকে। কখনও কখন সেপটোরিয়া ও স্কেলেরোটিনিয়াজনিত গোড়া পচা রোগ দেখা যায়।
চারা অবস্থায় অনেক সময় গাছের গোড়া কেটে দেয়। এছাড়া অনেক সময় এপিড ও সাদামাছির আক্রমণও লক্ষ্য করা যায়। নিম ওয়েল স্প্রে করে অর্গানিক উপায়ে একই সঙ্গে পোকামাকড় ও রোগ-জীবাণু দমন করা যায়। এজন্য ৩০ মিলি নিম ওয়েল/লিটার পানি- এ হারে স্প্রে করতে হবে।
ঠাকুরগাঁও সুগার ক্রপস গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শরিফুল ইসলাম বলেন, স্টেভিয়া গাছের পাতা মিষ্টি। সবচেয়ে মিষ্টির নির্যাস। স্টেভিয়া বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে কাজ করে। যেমন ডায়াবেটিস ও হƒদরোগসহ বিভিন্ন রোগ উপশম করে। স্টেভিয়া চাষ করে হেক্টরপ্রতি বর্তমানে অন্য জেলায় ১৫০০ থেকে ২০০০ কেজি উৎপন্ন হচ্ছে। প্রতি কেজি পাতার দাম ৫০০০ টাকার বেশি।
তিনি আরো বলেন, স্টেভিয়া পাতা থেকে মিষ্টিসহ বিভিন্ন মিষ্টি জাতীর খাবার প্রস্তুত করা যায়, যা থেকে বছরে পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা আয় করা সম্ভব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্বব্যাপী ব্যাপক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে স্টেভিয়া চাষের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।