সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : পছন্দের ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন মনগড়া শর্ত জুড়ে ১২ কোটি ৬০ লাখ ৮৪ হাজার টাকার দরপত্র আহবান করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে এই অনিয়ম করা হয়েছে বলে দাবি করেন দরপত্রে অংশগ্রহণ করতে না পারা ভুক্তভোগী ঠিকাদারেরা।

ঠিকাদাররা অভিযোগ করে বলেন, দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল গুলোতে সহজ শর্তে দরপত্র আহবান করা হলেও ডা. বাহাউদ্দিন আওয়ামী লীগের পুরনো সিন্ডিকেট ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দিতে কঠিন ও অযৌক্তিক শর্তাবলী দিয়ে ই-জিপি টেন্ডার আহবান করেছেন। গত ২২ আগস্ট ময়মনসিংহ জেলা সদর হাসপাতালে একই ধরনের কাজের জন্য ই-জিপি টেন্ডারের মাধ্যমে দরপত্র আহবান করা হয়েছে । কিন্তু সেই দরপত্রে মানিকগঞ্জের মত এতো কঠিন শর্তারোপ করা হয়নি।
দরপত্র নোটিশ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের চাহিদা চেয়ে গত ১৩ আগষ্ট বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ই-জিপির মাধ্যমে দরপত্র আহবান করা হয়েছে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের মধ্যে মেডিসিন, মনোহারী, কম্পিউটার সামগ্রী ও যন্ত্রাংশ, সার্জিক্যাল রি-অ্যাজেন্ট, ক্যামিকেল, আসবাবপত্র, গজ-বেন্ডিজ, কটন, লিলেন্ট সামগ্রী, প্রিন্টিং, রোগীর খাবার সরবরাহসহ ১৪টি আইটেম দরপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
দরপত্রের নোটিশে বলা হয়েছে, যেসব ঠিকাদার কাজ করতে ইচ্ছুক তারা আগামী ২৬ আগষ্ট পর্যন্ত দেশের যেকোন স্থান থেকে অনলাইনে শিডিউল ক্রয় করতে পারবেন এবং ২৭ আগস্ট ক্রয়কৃত শিডিউল অনলাইনের মাধ্যমে সাবমিট করতে পারবেন।
দরপত্রের নোটিশের শর্তাবলীতে উল্লেখ করা হয়, কম্পিউটার সামগ্রীর সরবরাহের জন্য ঠিকাদারকে BASIS (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়ার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিস) মেম্বারশিপ এবং DCCI (ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাট্রিজ) সার্টিফিকেট থাকতে হবে।
ঠিকাদারদের দাবি, জেলা পর্যায়ে এই কাজ পেতে ইঅঝওঝ মেম্বারশিপ এবং উঈঈও সার্টিফিকেট প্রয়োজন নেই। বিগত বছরগুলোতে হাসপাতালের দরপত্রে এ ধরনের কোন শর্তাবলী ছিল না। আর প্রয়োজন থাকলেও শুধুমাত্র জেলা চেম্বারের সার্টিফিকেট থাকলেই হয়ে যেত। এই সার্টিফিকেট ইন্ডাস্ট্রিয়াল এবং মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির জন্য প্রয়োজন। সাধারণ ঠিকাদারদের ক্ষেত্রে এর কোন প্রয়োজন নেই।

এছাড়া, হাসপাতালের জন্য গজ, বেন্ডিজ, কটন সরবরাহের ক্ষেত্রে BMIHEDMA (বাংলাদেশ মেডিকেল ইনষ্ট্রমেন্ট এন্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার এন্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এসোসিয়েশন) সনদ চাওয়া হয়েছে। যা হাসপাতালের তত্বাবধায়ক সু-কৌশলে সংক্ষেপে লিখেছেন। ফলে অনেক ঠিকাদারের জন্য BMIHEDMA এর অর্থ বুঝতে কষ্টকর হবে। দরপত্রে এরুপ কঠিন শর্তাবলী থাকায় জেলার অনেক ঠিকাদারের হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছে থাকলেও বঞ্চিত হবেন বলে আশঙ্কা স্থানীয় ঠিকাদারদের। এ কারণে দরপত্রে মনগড়া ও আপত্তিকর শর্তাবলী সংশোধনের দাবি জানিয়েছেন সাধারণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো।
ঠিকাদারদের অভিযোগ, দরপত্রগুলোতে যে সকল আপত্তিকর শর্তাবলী দেওয়া হয়েছে, তা শুধুমাত্র নির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিতে যোগসজসে করা হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন ঠিকাদার অভিযোগ করে বলেন, গত ১৩ আগস্ট দরপত্র প্রকাশিত হয়। অথচ তত্বাবধায়কের আহবান করা প্রতিটি দরপত্রের আইডির বিপরীতে এক মাস পিছনে গিয়ে অর্থাৎ বিগত ১ জুলাই আগামী ২৬ আগস্ট পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ২ মাস ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে বলা হয়েছে। যেমন- ঔষধ সরবরাহের দরপত্রের ক্ষেত্রে ১ কোটি ৯৫ লাখ টাকা এবং মনোহারী সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে ৭৫ লাখ টাকা ধারাবাহিকভাবে দুই মাস ব্যাংকে স্ট্যান্ডবাই রাখতে হবে। এছাড়া কম্পিউটার সামগ্রী সরবরাহের ক্ষেত্রে ঢাকা চেম্বারের সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে ঢাকা ছাড়া অন্যান্য জেলার চেম্বারে সদস্য হলে সেই ঠিকাদার দরপত্রে অংশগ্রহন করতে পারবে না। দরপত্রের শর্তে BASIS (বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ সফটওয়ার এন্ড ইনফরমেশন সার্ভিস) মেম্বারশীপ সার্টিফিকেট চাওয়া হয়েছে। এরকম হাস্যকর সব শর্ত দিয়ে টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। এছাড়া মনোহারীর ক্ষেত্রে BMIHEDMA (বাংলাদেশ মেডিকেল ইনষ্ট্রমেন্ট এন্ড হসপিটাল ইকুইপমেন্ট ডিলার এন্ড ম্যানুফ্যাকচারার্স এন্ড এসোসিয়েশন) সনদ চাওয়া হয়েছে। জেলা পর্যায়ের ঠিকাদারদের পক্ষে এটাও একটি কঠিন শর্ত।
কয়েকজন ঠিকাদার জানান, দরপত্রের অনিয়ম ও তত্বাবধায়কের এসকল অপকর্ম নিয়ে কোন ঠিকাদার যেন আপত্তি করতে না পারে সেজন্য দরপত্র দাতাদের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব প্যাডে অভিযোগ করতে পারবে না মর্মে অংঙ্গীকারনামা নেয়া হয়েছে। তত্বাবধায়ক নির্দিষ্ট ঠিকাদারদের কাজ পাইয়ে দেওয়ার জন্য এসব শর্ত আরোপ করেছেন বলে অভিযোগ স্থানীয় ঠিকাদারদের।
স্থানীয় ঠিকাদারেরা আরো জানান, আহবান করা দরপত্রগুলোর আরোপ করা শর্ত শিথিল করে স্থানীয় ঠিকাদারদের কাজ করার সুযোগ করে দিলে একদিকে যেমন কাজের মান ভাল হবে অন্যদিকে সরকারী অর্থ কম ব্যয় হবে।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে ঘনিষ্টতার প্রভাব খাটিয়ে পদোন্নতি পেয়ে মানিকগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। দায়িত্ব নিয়েই মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এবং তাঁর ছেলে রাহাত মালেক শুভ্র ছাড়াও আওয়ামী লীগের স্থানীয় প্রভাবশালী সুলতানুল আজম খান আপেল, আফসার সরকার, ইসরাফিল হোসেন, আবু বকর সিদ্দিক খান তুষার, বাবুল সরকার, জাহিদ হোসেনসহ বিভিন্ন নেতার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তোলেন তিনি। তাদের সঙ্গে মিলেমিশে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়ন না করে উল্টো হাসপাতালকে দুর্নীতির অভয়াশ্রম হিসেবে গড়ে তোলেন।
আওয়ামী লীগের আমলে নিজেকে গোপালগঞ্জের সন্তান এবং আওয়ামী লীগের মতাদর্শী পরিচয় দেওয়া ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন বিগত সময়ে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন বাণিজ্য হিসেবে কয়েক কোটি টাকা কামিয়ে নিয়েছেন। সেসময় তার দুর্নীতি নিয়ে যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদের প্রকাশ্যে গালি গালাজ, মারধর এমনকি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানীর অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। গত বছরের জুলাই-আগষ্টে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ছাড়াও যেসব ছাত্র-জনতা পুলিশের হাতে মার খেয়ে মারাত্বক আহত হয়েছিলেন তাদের চিকিৎসা সেবা না দিয়ে হাসপাতালের গেটে তাঁলা লাগিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ডা. বাহাউদ্দিনের বিরুদ্ধে। এ কারণে গতবছরের ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর মানিকগঞ্জের একমাত্র সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে তিনিও হাসপাতালের একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে পালিয়ে যান। পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে কয়েকজন স্থানীয় নেতাকর্মীকে ম্যানেজ করে কর্মস্থলে ফিরেন তিনি।
মানিকগঞ্জ ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালের তত্বাবধায়ক ডা. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিনের বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, এসব বিষয়ে আমার কোন মন্তব্য নেই। সরকারী নিয়ম মেনে ই-জিপি টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। কারো কোন অভিযোগ থাকলে সেটা ই-জিপি সিস্টেমে জানাবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।