জুমবাংলা ডেস্ক : চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রার অফিস যেন এক ‘ঘুষের দুর্গ’—এমনই অভিযোগ সেবা গ্রহীতা ও দলিল লেখকদের। সর্বশেষ ৩০ জুন, রোববার সীতাকুণ্ডের প্রবীণ ব্যবসায়ী হাজী দিদারুল আলম ১২ শতক জমি রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে চরম হয়রানির শিকার হন। ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানানোয় সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিব তাঁর দলিল ফিরিয়ে দেন এবং অফিসে পুলিশ ডেকে এনে তাঁকে প্রকাশ্যে ‘মাফ চাইতে’ বাধ্য করেন।
কী ঘটেছিল সেদিন?
হাজী দিদারুল আলম সীতাকুণ্ড বাজারের পরিচিত টাইলস ব্যবসায়ী। সেদিন তিনি একটি আম-মোক্তারনামা দলিলের ভিত্তিতে ১২ শতক জমি নিজের নামে রেজিস্ট্রি করতে সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে যান। কিন্তু দলিল দেখে সাব-রেজিস্ট্রার জানান, জমির বিক্রয়মূল্যের ওপর ৭ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হবে—এর মধ্যে ৫% উৎস কর এবং ২% ভ্যাট।
কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর নিয়ম অনুযায়ী, যাঁরা ডেভেলপার নন, তাঁদের ওপর এই ৭ শতাংশ কর আরোপ বেআইনি। হাজী দিদার এ কথা বলায় রায়হান হাবিব ক্ষিপ্ত হয়ে দলিল তাঁর দিকে ছুড়ে মারেন এবং তাঁকে ‘দালাল’ বলে অপমান করেন।
পরবর্তীতে রায়হান হাবিব নিজেই পুলিশ ডেকে আনেন। হাজী দিদারের ভাষ্য অনুযায়ী, পুলিশ আসার পর অফিসে উপস্থিত সকলের সামনে তাঁকে ‘মাফ চাইতে’ বলা হয়। তিনি বলেন, “আমি শুধু ঘুষ দিতে রাজি হইনি, তবুও আমাকে অপরাধীর মতো বিবেচনা করা হলো।”
তিনি আরও জানান, “এর আগেও আমি আম-মোক্তার দলিলের ভিত্তিতে ২২ শতক জমি রেজিস্ট্রি করেছি, তখন অতিরিক্ত কোনো কর দিতে হয়নি। তবে সাব-রেজিস্ট্রারকে ৩০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হয়েছিল।”
প্রশাসনের ভূমিকা
ঘটনার সময় চট্টগ্রাম জেলা রেজিস্ট্রার খন্দকার জামিলুর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। তিনি পুরো বিষয়টি নীরবভাবে প্রত্যক্ষ করেন। পরে শুধু দিদারকে প্রশ্ন করেন, “আপনি কোন রাজনৈতিক দলের?”—এমন প্রশ্নে দিদার হতবাক হয়ে যান।
জেলা রেজিস্ট্রার দাবি করেন, আম-মোক্তারনামা দলিল থেকে খণ্ড জমি বিক্রির ক্ষেত্রে ৫% উৎস কর ও ২% ভ্যাট দিতে হয়। তাঁর মতে, যাঁরা আম-মোক্তারনামার মাধ্যমে খণ্ড জমি বিক্রি করেন, তাঁদের ডেভেলপার ধরে নিতে হবে।
কিন্তু আয়কর আইন ২০২৩ অনুসারে, কেবলমাত্র প্রকৃত ডেভেলপারদের কাছ থেকে এই কর আদায় করা বৈধ। ২০১০ সালের “রিয়েল এস্টেট উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা আইন” অনুযায়ী, শুধু আম-মোক্তার দলিল থাকার কারণে কাউকে ডেভেলপার হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। ডেভেলপার বলতে বোঝায়, যে কেউ নিজে অথবা জমির মালিকের সঙ্গে চুক্তি করে ভবন নির্মাণ বা উন্নয়ন করে এবং তা বিক্রি করে।
ঘুষের অভিযোগ নতুন নয়
এই প্রথম নয়—সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের বিরুদ্ধে আগেও একাধিক ঘুষ ও হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দলিল লেখকরা তাঁর বিরুদ্ধে মানববন্ধন ও অনির্দিষ্টকালের কলম বিরতিতে যান। পরে একটি মামলার মাধ্যমে আন্দোলন দমন করা হয়। এমনকি তাঁকে বদলির আদেশ দেওয়া হলেও সেটি একদিনের ব্যবধানে স্থগিত করা হয়, যা স্থানীয়দের মধ্যে প্রশ্নের জন্ম দেয়—তিনি কি প্রশাসনের কারও আশ্রয়ে আছেন?
সম্প্রতি মিরসরাই উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের দায়িত্বেও তাঁকে কিছুদিনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেখানে তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষের অভিযোগ উঠলে তিনি হঠাৎ ‘অসুস্থতার’ অজুহাতে সেখান থেকে ফিরে আসেন।
ঘুষের লেনদেনে ‘ইয়াকুব’ ও পুরনো বিতর্ক
এক সময় সাব-রেজিস্ট্রার অফিসের ঝাড়ুদার ইয়াকুবের মাধ্যমেই ঘুষ লেনদেন হতো—এমন অভিযোগ রয়েছে। পরবর্তীতে তাঁকে বরখাস্ত করা হলেও, সম্প্রতি তাঁকে আবার চাকরিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে, যা নিয়েও নানা সমালোচনা চলছে।
তদন্তের দাবি
দলিল লেখকরা বলছেন, সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবের সময় ৭ শতাংশ করের অজুহাতে বিপুল পরিমাণ ঘুষ লেনদেন হয়েছে। গত এক বছরের দলিলগুলো তদন্ত করলে প্রকৃত তথ্য বেরিয়ে আসবে। তাঁরা দুর্নীতি দমন কমিশনসহ আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
ওসি’র বক্তব্য
সীতাকুণ্ড থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মুজিবুর রহমান জানান, “সাব-রেজিস্ট্রার ফোন করে বলেন, একজন ব্যক্তি অফিসে গোলমাল করছেন। তাই পুলিশ পাঠানো হয়। বাকিটা আমার জানা নেই।”
অন্যদিকে, সাব-রেজিস্ট্রার রায়হান হাবিবকে একাধিকবার ফোন করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।