জুমবাংলা ডেস্ক : ভূমিসেবা সহজ এবং ভোগান্তিমুক্ত করতে ডিজিটালাইজেশন কার্যক্রম শুরু করেছে ভূমি মন্ত্রণালয়। ঘরে বসেই অনলাইনের মাধ্যমে গ্রাহকদের জমির নিবন্ধন, নামজারি, খাজনাসহ সব ধরনের সেবা নিশ্চিত করতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়। এতে ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা প্রদানে ভোগান্তি কমেছেও। কিন্তু ই-নামজারি সেবায় সময় কিছুটা সাশ্রয় হলেও ভোগান্তি রয়েই গেছে। দালালদের দৌরাত্ম্যে নামজারি আবেদনে গুনতে হচ্ছে অতিরিক্ত টাকা। ভূমি অফিসের কর্তাদের খুশি করতে অর্থ লেনদেনের অভিযোগও রয়েছে।
এসব অভিযোগ খোদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারাও স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, দীর্ঘদিন চলে আসা অনিয়মের জঞ্জাল থেকে ভূমি অফিসগুলোকে বের করে আনতে তারা জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। অভিযোগ পেলে তদন্তের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও তারা জানান।
রাজধানীর তেজগাঁও, কোতোয়ালি, রমনা ও শাহজাহানপুর এলাকার ভূমিসেবাগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নামজারির কাজে গেলেই কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আর্থিকভাবে ‘খুশি করার’ প্রস্তাব আসে। পড়তে হয় দালালের খপ্পরেও। দোকান থেকে নামজারির আবেদন করতে গেলে সরকারি ফির চেয়ে বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। অনলাইনে আবেদনের পর কাগজপত্র দাখিলে সশরীরে অফিসে গেলেই আসছে উৎকোচের প্রস্তাব। এ ছাড়া নামজারির শুনানির কিংবা মিসকেসের জন্য দীর্ঘক্ষণ সেবাপ্রার্থীদের অপেক্ষা করতে হয় সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কার্যালয়ে।
ভূমিসেবার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ই-নামজারির কাজে আবেদনসহ অন্যান্য কাগজপত্রের হার্ডকপি জমা দেওয়ার নিয়ম নেই। সেবাপ্রার্থীর ভূমি অফিসে যাওয়ারও প্রয়োজন নেই। এসব ক্ষেত্রে সেবাগ্রহীতাদের অসচেতনাকে দায়ী করছেন তারা।
সন্তানদের মাঝে সম্পত্তি বণ্টন (হেবা) এবং খারিজের কাজে মালিবাগ এলাকার বাসিন্দা জিয়াউল হাসান যান রাজধানীর পল্টনে রমনা ভূমি অফিসে। তার অভিযোগ, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও পুরনো একটি মীমাংসিত সমস্যা দেখিয়ে কর্মকর্তাদের খুশি করার প্রস্তাব দেন ওই অফিসের একজন। তিনি বলেন, ‘নামজারিতে সময় আগের চেয়ে কমেছে। তবে সেই পয়সা লেনদেনের বিষয়টা এখনো আছে। আমার যে ঝামেলা ছিল, সেটার জন্য কোর্টে মামলা করেছিলাম। কোর্র্ট রায়ও দিয়েছিল। এরপর এসিল্যান্ড অফিসে মিসকেস করেছিলাম, সেটারও রায় হয়েছে। সে রায়ও আমার পক্ষে ছিল। সাত-আট মাস আগেও ওই রায় অনুযায়ী জমির কাজ করেছি। আমার সব ডকুমেন্টস আপ টু ডেট। তবু ভূমি অফিসের ওনারা এটাকে ইস্যু করছেন। বলছেন আপনার কাজটা হবে, তবে স্যারকে একটু খুশি করে দিতে হবে।’
তেজগাঁও ভূমি অফিসে নামজারির কাজে আসা মাহবুব ইসলাম বলেন, ‘কাজ দ্রুত করার জন্য তাদের খুশি করার জন্য কিছু চেয়েছিল। তবে আমি কোনো লেনদেনে যাইনি। দেখি কাজটা হয় কিনা।’
নন্দীবাড়ি ভূমি অফিসে নামজারির কাজে আসা এক বৃদ্ধ বলেন, ‘ভোগান্তি তো কমেনি। এই অফিসে দুদিন এলাম। আবার যেতে হবে এসিল্যান্ড অফিস। ছোটাছুটি তো করতেই হচ্ছে।’
কোতোয়ালি সার্কেলের সহকারী কমিশনারের (ভূমি) অফিসে নামজারির শুনানির জন্য আসা যাত্রাবাড়ীর এক সেবাগ্রহীতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘ভোগান্তি আর কমল কই। আড়াই মাস আগে অনলাইনে আবেদন করেছিলাম, আজ এলাম শুনানির জন্য। সকাল থেকে বসে আছি; এখনো ডাক আসেনি। আবেদনের পর ভূমি অফিসে গেলে তারা টাকা-পয়সা চেয়েছিল, তবে দিইনি।’
এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আনিসুর রহমান বলেন, ‘যারা নাগরিকসেবা নিতে অফিসে যাবেন, তাদেরও কিন্তু একটা দায় থাকতে হবে। অনেক সময় দেখা যায়, তারা এসব ক্ষেত্রে বাইরের লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। দালাল কিন্তু সেবাপ্রার্থীর রূপ নিয়ে অফিসে ঢুকে যায়। অনেক ক্ষেত্রে আমরা চিহ্নিতও করতে পারি না। তবে দালালদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে। এসব ক্ষেত্রে আমাদের অফিসের কারও যদি প্রশ্রয় থাকে, আমরা তার বিরুদ্ধেও তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেব। এ বিষয়ে ঢাকা জেলা প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে।’
এসিল্যান্ড অফিসগুলোতে সেবাপ্রার্থীদের দীর্ঘ অপেক্ষা প্রসঙ্গে আনিসুর রহমান বলেন, ‘জনগণের ভোগান্তি কমাতে এসিল্যান্ডদের নির্দেশনা দেওয়া আছে কোনো কারণে নামজারি শুনানি কিংবা মিসকেস এটেন্ড করতে না পারলে সেটা যেন আগে থেকেই সেবাপ্রার্থীরা জানতে পারেন। এ ছাড়া আগে থেকে অনলাইনেই যেন সেবাপ্রার্থীরা এসব তথ্য জানতে পারেন, তার কাজ চলছে। আশা করছি এক মাসের ভেতর এটা চালু করতে পারব।’
ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. মো. জাহিদ হোসেন পনির বলেন, ‘প্রতিটি নামজারির পর গ্রাহক প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আমরা রোবোটিক কল চালু করেছি। যেখানে তিনটি প্রশ্নের উত্তরের মাধ্যমে গ্রাহক তাদের অভিযোগ জানাতে পারেন। এ ছাড়া ডিজিটাল ভূমিসেবা কল সেন্টারের মাধ্যমে গ্রাহক বিশ্বের যে কোনো প্রান্ত থেকে নামজারির আবেদন করতে পারেন। এসব সেবা সম্পর্কে ব্যাপক প্রচারও চালানো হচ্ছে।’
ভূমি অফিসগুলোতে অনিয়ম এবং গ্রাহক ভোগান্তির বিষয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (মাঠ প্রশাসন) প্রদীপ কুমার দাস বলেন, ‘অনিয়মের বিষয়ে আমাদের কাছেও অভিযোগ আছে। আমরা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছি, নিয়মিত মনিটরিং চলছে। যথাযথ প্রমাণসাপেক্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে। তবে যেহেতু দীর্ঘদিনের অনিয়ম, পুরোপুরি স্বচ্ছতা আনতে সময় লাগবে। আশা করছি এটা কমে আসবে। এক্ষেত্রে জনগণকেও সচেতন হতে হবে।’
ই-নামজারি নিয়ে কম-বেশি অভিযোগ থাকলেও অনলাইনে খাজনা দিয়ে সন্তুষ্ট সেবাগ্রহীতারা। তেজগাঁও ভূমি অফিসে খাজনা দিতে আসা এক দম্পতি জানান, কোনো রকম ভোগান্তি ছাড়াই মুহুর্তের মধ্যেই খাজনা দিতে পেরেছেন তারা। খরচ হয়নি এক টাকাও। ভূমিসেবা উন্নয়নে সন্তুষ্ট তারা।
কোতোয়ালি ভূমি অফিসে খাজনা দিতে আসা আরেক সেবাগ্রহীতা বলেন, ‘দ্রুত সময়ে খাজনা দিতে পেরেছি। অনলাইন হওয়ায় ভোগান্তি আগের চেয়ে অনেক কমেছে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।