একটি যুগান্তকারী গবেষণা বদলে দিয়েছে মানুষের বহু যুগ ধরে চলে আসা একটি ধারণা—যে শুক্রাণুরা প্রতিযোগিতায় জয়ী হয়ে ডিম্বাণুতে প্রবেশ করে, তারাই ভবিষ্যতের প্রাণ তৈরি করে। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় দেখা গেছে, ডিম্বাণুই আসলে সিদ্ধান্ত নেয় কে হবে সেই বিজয়ী শুক্রাণু!
ডিম্বাণুর এক চমকপ্রদ গুণ—”পছন্দ” ও “অপছন্দ”
২০২০ সালে স্টকহোম ও ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এক গবেষণায় দেখান, ডিম্বাণু থেকে নিঃসৃত রাসায়নিক পদার্থ শুক্রাণুকে আকর্ষণ করে, কিন্তু সেই আকর্ষণ সব শুক্রাণুর জন্য নয়। প্রতিটি ডিম্বাণুর নিজস্ব ‘পছন্দের ধরন’ আছে, যাকে বলে ‘কেমিক্যাল স্বয়ম্বর’। অপছন্দের শুক্রাণুদের সে নির্দ্বিধায় দূরে সরিয়ে দেয়।
প্রচলিত কল্পচিত্র: শুক্রাণুর প্রতিযোগিতা বনাম বাস্তবতা
আমরা সবাই জানি সেই গল্প—লক্ষ লক্ষ শুক্রাণুর মধ্যে একটিই জিতে নেয় ডিম্বাণুতে প্রবেশের সুযোগ। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি অনেক বেশি জটিল এবং নারীকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণে।
বিজ্ঞান লেখিকা স্টার ভার্টনের সদ্য প্রকাশিত বই “The Stronger Sex”-এ বলা হয়েছে, নারীর দেহ ও প্রজনন ক্ষমতা নিয়ে বহু প্রচলিত ভুল ধারণা আমাদের সমাজে এখনো বিদ্যমান। তার অন্যতম হচ্ছে ডিম্বাণুর নিষ্ক্রিয়তা এবং শুক্রাণুর নায়কোচিত ভূমিকা। এই বইয়ে আধুনিক বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে সেই ভুলগুলিকে ভেঙে দিয়েছেন লেখিকা।
ডিম্বাণু জন্ম থেকেই তৈরি হয়, কিন্তু প্রতিটি বেছে নেয় সঙ্গী
নারী জন্মগ্রহণের সময়েই তার শরীরে থাকে ১০–২০ লক্ষ ডিম্বাণু। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে আসে সেই সংখ্যা, এবং প্রতি মাসে কেবল একটি ডিম্বাণুই পরিপক্ব হয়। তবে প্রতিটি ডিম্বাণুর থাকে নিজস্ব পছন্দ—কে হবে তার নিষেক সঙ্গী।
লিনেট সিভার্ট, ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ের জৈবিক নৃবিজ্ঞানের অধ্যাপক, বলেন যে নারীদেহ ডিম্বাণু উৎপাদনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত সংযত এবং বেছে বেছে ডিম্বাণু নিষিক্ত করে। এর পেছনে কারণ, মানুষ সাধারণত এক বা দুইটি সন্তানই ধারণ করে। ফলে, সেই সন্তান যেন সর্বোচ্চ সক্ষমতা ও স্বাস্থ্য নিয়ে জন্মায়, তা নিশ্চিত করতে ডিম্বাণু নিজেই উপযুক্ত শুক্রাণুকে নির্বাচন করে।
পুরুষ বনাম নারী: প্রজনন কৌশলের ভিন্নতা
পুরুষেরা প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ শুক্রাণু তৈরি করলেও, তারা আলাদা করে কোনটি উপযুক্ত তা নির্ধারণ করে না। এই ব্যাপারে পুরুষেরা অনেকটা মাছের মতো আচরণ করে, যারা সমস্ত শুক্রাণু একসঙ্গে ছেড়ে দেয়। অথচ নারী শরীর ঠিক বিপরীত পথে চলে—নির্বাচনের উপর জোর দেয়।
উভচর বা মাছের ক্ষেত্রে প্রচুর ডিম্বাণু ও শুক্রাণু উৎপন্ন হলেও, মানুষের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণমূলক প্রজনন ব্যবস্থাই গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে। আর তার কেন্দ্রে রয়েছে ডিম্বাণুর নিজস্ব বাছাই ক্ষমতা।
‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ ডিম্বাণু—শুধু আকর্ষণ নয়, প্রত্যাখ্যানও করে
গবেষণায় উঠে এসেছে, ডিম্বাণুর রাসায়নিক সংকেত নির্দিষ্ট শুক্রাণুর প্রতিই “নিবেদিত” থাকে। এমনকি একাধিক শুক্রাণু প্রবেশ করতে গেলেও ডিম্বাণু তার বাইরের আবরণ কষে বন্ধ করে দেয়, শুধুমাত্র নির্বাচিত শুক্রাণুর জন্যই খোলা রাখে রাস্তা।
এই নির্বাচন প্রক্রিয়াটি এতটাই সূক্ষ্ম যে একই নারী ও পুরুষের শুক্রাণু-ডিম্বাণু মিলেও সব সময় নিষেক হয় না, যদি না উভয়ের মধ্যে রাসায়নিক সামঞ্জস্য থাকে।
‘নারী অপেক্ষা করে, পুরুষ ছুটে আসে’—এই গল্পের শেষ সময় এসে গেছে?
এই ধারণা অনেকটাই লিঙ্গবৈষম্যমূলক সামাজিক স্টিরিওটাইপ-এর ফল। ১৯৯১ সালে এমিলি মার্টিন তাঁর গবেষণাপত্রে (The Egg and the Sperm) বলেন, বিজ্ঞানের পাঠ্যবইগুলোতেও নারীদের নিষ্ক্রিয় ও অপেক্ষমাণ হিসেবে দেখানো হয়, যা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন।
নারীশরীরের বিজ্ঞানসম্মত আচরণ বুঝতে হলে, সেই পুরনো স্টেরিওটাইপগুলোকে ভাঙতেই হবে। ইভলিন ফক্স কেলার দেখিয়েছিলেন, কীভাবে জীববিজ্ঞানের ভাষাও লিঙ্গবৈষম্যে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে।
গোপালগঞ্জে সহিংসতা : ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৪শ’ জনের নামে মামলা
বিজ্ঞানের আলোয় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি
ডিম্বাণু আর শুক্রাণুর মিলন কেবল এক রোমান্টিক গল্প নয়—এটি একটি বিজ্ঞাননির্ভর বেছে নেওয়ার প্রক্রিয়া, যার নিয়ন্ত্রণ নারীর হাতে। নতুন গবেষণা ও বিশ্লেষণ আমাদের শেখায়, প্রজনন কেবল পুরুষতান্ত্রিক ‘দৌড় প্রতিযোগিতা’ নয়, বরং নারীর নির্বাচনী শক্তির এক জটিল, সংবেদনশীল প্রক্রিয়া।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।