লাইফস্টাইল ডেস্ক : তাহাজ্জুদ মর্যাদাপূর্ণ এক ইবাদত। শেষ রাতের এই নফল নামাজ আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পর শ্রেষ্ঠ নামাজ এটি। মহানবী (স.) ইরশাদ করেছেন, ‘রমজানের পর সর্বশ্রেষ্ঠ রোজা হলো আল্লাহর মাস মহররমের রোজা। আর ফরজ নামাজের পর সর্বশ্রেষ্ঠ নামাজ হলো রাতের (তাহাজ্জুদের) নামাজ।’ (মুসলিম: ১১৬৩)
রাতের শেষভাগে ঘুম থেকে উঠে যে নামাজ আদায় করা হয়, মূলত সেটাকে তাহাজ্জুদের নামাজ বলা হয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর রাতের কিছু অংশে তাহাজ্জুদ পড়বে। এটা তোমার অতিরিক্ত দায়িত্ব। অচিরেই তোমার রব তোমাকে প্রশংসিত স্থানে প্রতিষ্ঠিত করবেন।’ (সুরা বনি ইসরাঈল: ৭৯)
তাহাজ্জুদে মন হয় নির্মল
কুপ্রবৃত্তি দমনে তাহাজ্জুদ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। মনকে করে নির্মল। ইরশাদ হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই রাতে ঘুম থেকে ওঠা মনকে দমিত করার জন্য অধিক কার্যকর। ওই সময়ে পাঠ করা (কোরআন তেলাওয়াত বা জিকির) একেবারে যথার্থ।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ০৬)
তাহাজ্জুদ আদায়কারীদের নিয়ে আল্লাহর প্রশংসা
মানুষ যখন গভীর ঘুমে মগ্ন, তখন প্রভুর ভালোবাসায় যে বান্দারা নামাজে দাঁড়ায়, তাদের প্রশংসা করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তারা শয্যা ত্যাগ করে তাদের প্রতিপালককে ডাকে আশায় ও আশঙ্কায়। আর আমি তাদের যে রিজিক দিয়েছি, তা থেকে তারা ব্যয় করে’ (সুরা সাজদা: ১৬)। ‘তারা ধৈর্যশীল, সত্যবাদী, অনুগত ব্যয়কারী ও রাতের শেষ প্রহরে ক্ষমাপ্রার্থী।’ (সুরা আলে ইমরান: ১৭)
তাহাজ্জুদের পারিবারিক প্রচেষ্টায় আল্লাহর রহমত
তাহাজ্জুদ নামাজের আরও অসংখ্য ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ সেই ব্যক্তির প্রতি সদয় হন, যে রাতে ঘুম থেকে জেগে ওঠে তাহাজ্জুদের জন্য এবং তার স্ত্রীকেও জাগায়। আর যদি স্ত্রী উঠতে অস্বীকৃতি জানায়, তাহলে তার চেহারায় পানি ছিটিয়ে দেয়। মহান আল্লাহ সেই নারীর প্রতিও সদয় হন, যে রাতে ঘুম থেকে ওঠে, তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করে এবং নিজের স্বামীকেও (তাহাজ্জুদের জন্য) জাগায়। আর যদি স্বামী উঠতে অস্বীকৃতি জানায়, তার চেহারায় পানি ছিটিয়ে দেয়। (আবু দাউদ: ১৩০৮)
আল্লাহর সর্বাধিক নিকটবর্তী হওয়ার অনন্য উপায়
আমর ইবনে আবাসা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, আল্লাহ তাআলা রাতের শেষ প্রহরে বান্দার সর্বাধিক নিকটবর্তী হন। কাজেই ওই মোবারক সময়ে আল্লাহর জিকির করা সম্ভব হলে তখন তুমিও তাদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাও। (তিরমিজি: ৩৫৩৩)
নবীজির তাহাজ্জুদ
মুগিরা ইবনে শু’বা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) এত দীর্ঘ সময় (তাহাজ্জুদের) নামাজ আদায় করতেন যে তাঁর পদযুগল ফুলে যেত। তাঁকে বলা হলো, হে আল্লাহর রাসুল, আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সব গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। জবাবে তিনি বললেন, তাই বলে কি আমি এই মহা অনুগ্রহের জন্য অধিক ইবাদত করে শোকর আদায়কারী বান্দা হব না? (বুখারি ও মুসলিম, মেশকাত: ১১৪৯)
তাহাজ্জুদ গুনাহ মাফের বড় উপায়
আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, তোমাদের তাহাজ্জুদের নামাজ আদায় করা উচিত। কেননা তা তোমাদের পূর্বেকার সজ্জন ব্যক্তিদের প্রতীক এবং তোমাদের প্রতিপালকের নৈকট্য লাভের বিশেষ মাধ্যম। নামাজ গোনাহসমূহ বিমোচনকারী এবং গোনাহের প্রতিবন্ধক। (তিরমিজি: ৩৫৪৯, সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১০৭৫)
ঘুমের আগে অন্তত দুই রাকাত নামাজ
শেষ রাতে ঘুম থেকে উঠতে পারার সম্ভাবনা না থকলে প্রয়োজনে শোয়ার আগে দুই রাকাত নামাজ পড়তে উৎসাহিত করা হয়েছে হাদিসে। বলা হয়েছে, এতেই তাহাজ্জুদের ফজিলত লাভ হতে পারে। সাউবান (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (স.) ইরশাদ করেন, ‘রাত্রি জাগরণ কষ্টকর ও ভারী জিনিস, তাই তোমরা যখন (শোয়ার আগে) বিতির পড়বে, তখন দুই রাকাত (নফল) নামাজ পড়ে নেবে। পরে শেষ রাতে উঠতে পারলে ভালো, অন্যথায় এই দুই রাকাতই ‘কিয়ামুল লাইল’-এর ফজিলত লাভের উপায় হবে।’ (সুনানে দারেমি: ১৬৩৫; সহিহ ইবনে খুজাইমা: ১১০৬; তাহাবি: ২০১১)
আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনু আস (রা.) বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (স.) আমাকে বললেন, হে আবদুল্লাহ! তুমি অমুক ব্যক্তির মত হয়ো না, সে রাত জেগে ইবাদত করত, পরে রাত জেগে ইবাদাত করা ছেড়ে দিয়েছে। (বুখারি: ১১৫২)
তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইলের পার্থক্য
তাহাজ্জুদ ও কিয়ামুল লাইলের পার্থক্য হলো- রাতে ঘুমের পর কেবল নামাজ আদায়ের জন্য জাগ্রত হওয়া তাহাজ্জুদ। চাই অল্প সময়ের জন্য হোক বা বেশি সময়। আর কিয়ামুল লাইল হলো- নামাজ, জিকির, দোয়া ও কোরআন তেলাওয়াত ইত্যাদির সমষ্টি। এগুলো রাতের যেকোনো অংশে হতে পারে। অতএব, তাহাজ্জুদ হলো কিয়ামুল লাইলের একটি প্রকার। এটি ঘুমের পর রাতে নামাজ আদায়ে আবার জাগ্রত হওয়াকে বলে। (হাল হুনাকা ফারকুন বাইনাত তাহাজ্জুদ ওয়া কিয়ামিল লাইল, http://www.islamqa.info/ ২০-১১-২০১৭)
তাহাজ্জুদে নবীজির দোয়া
ইবনু আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আল্লাহর রাসুল (স.) রাতে তাহাজ্জুদের উদ্দেশে যখন দাঁড়াতেন, তখন এ দোয়া পড়তেন। দোয়াটি হলো—
اللَّهُمَّ لَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ قَيِّمُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ لَكَ مُلْكُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ نُورُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَمَنْ فِيهِنَّ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ مَلِكُ السَّمَوَاتِ وَالْأَرْضِ وَلَكَ الْحَمْدُ أَنْتَ الْحَقُّ وَوَعْدُكَ الْحَقُّ وَلِقَاؤُكَ حَقٌّ وَقَوْلُكَ حَقٌّ وَالْجَنَّةُ حَقٌّ وَالنَّارُ حَقٌّ وَالنَّبِيُّونَ حَقٌّ وَمُحَمَّدٌ حَقٌّ وَالسَّاعَةُ حَقٌّ اللَّهُمَّ لَكَ أَسْلَمْتُ وَبِكَ آمَنْتُ وَعَلَيْكَ تَوَكَّلْتُ وَإِلَيْكَ أَنَبْتُ وَبِكَ خَاصَمْتُ وَإِلَيْكَ حَاكَمْتُ فَاغْفِرْ لِي مَا قَدَّمْتُ وَمَا أَخَّرْتُ وَمَا أَسْرَرْتُ وَمَا أَعْلَنْتُ أَنْتَ الْمُقَدِّمُ وَأَنْتَ الْمُؤَخِّرُ لآ إِلَهَ إِلاَّ أَنْتَ أَوْ لآ إِلَهَ غَيْرُكَ
অর্থ: ‘হে আল্লাহ! আপনার জন্য সমস্ত প্রশংসা, আপনি আসমান জমিন ও এ দুয়ের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর নিয়ামক এবং আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা। আসমান জমিন এবং তাদের মাঝে বিদ্যমান সব কিছুর কর্তৃত্ব আপনারই। আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা। আপনি আসমান জমিনের নূর। আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা। আপনি আকাশ ও জমিনের মালিক, আপনারই জন্য সমস্ত প্রশংসা। আপনি চির সত্য। আপনার ওয়াদা চির সত্য; আপনার সাক্ষাৎ সত্য; আপনার বাণী সত্য; জান্নাত সত্য; জাহান্নাম সত্য; নবীগণ সত্য; মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্য, কেয়ামত সত্য। ইয়া আল্লাহ! আপনার নিকটই আমি আত্মসমর্পণ করলাম; আপনার প্রতি ঈমান আনলাম; আপনার উপরই তাওয়াক্কুল করলাম, আপনার দিকেই রুজু করলাম; আপনার (সন্তুষ্টির জন্যই) শত্রুতায় লিপ্ত হলাম, আপনাকেই বিচারক মেনে নিলাম। তাই আপনি আমার পূর্বাপর ও প্রকাশ্য গোপন সব অপরাধ ক্ষমা করুন। আপনিই অগ্র পশ্চাতের মালিক। আপনি ছাড়া প্রকৃত কোনো ইলাহ নেই, অথবা (অপর বর্ণনায়) আপনি ছাড়া প্রকৃত কোনো সত্য মাবুদ নেই।’ (সহিহ বুখারি: ১১২০)
তাহাজ্জুদ নামাজের উত্তম সময়
রাতের শেষ অংশে ঘুম থেকে ওঠার পর তাহাজ্জুদ পড়া সবচেয়ে উত্তম। তবে এশার নামাজের পর থেকে সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত এই নামাজ পড়া যায়। আর এতে তাহাজ্জুদের ফজিলত লাভ হয়। কেননা তাহাজ্জুদ নামাজের মূল সময় এশার নামাজের পর থেকেই শুরু হয়, যদিও উত্তম সময় হলো ঘুম থেকে ওঠার পর।
এশার নামাজ শেষে ঘুমিয়ে পড়বে। চাই তা অল্প সময়ের জন্য হোক। এরপর রাতের মধ্য ভাগে জেগে অল্প সময়ে দুই রাকাত নামাজ পড়বে। এরপর যত রাকাত ইচ্ছে নামাজ আদায় করবে, তবে নামাজ হতে হবে দুই রাকাত করে। দুই রাকাত শেষে সালাম ফিরাবে, আবার দুই রাকাত পড়বে..। এভাবে যত রাকাত সম্ভব, তাহাজ্জুদ আদায়ের পর বিতির নামাজ আদায় করবে। (শায়খ বিন বাজ; কাইফিয়্যাতু সালাতুত তাহাজ্জুদ ওয়া কিয়ামুল লাইল, ফতোয়া নুরুন আলাদ দারব, খণ্ড: ১০, পৃষ্ঠা: ২১-২৪)
নবীজি যখন তাহাজ্জুদ পড়তেন
আসওয়াদ ইবনে ইয়াজিদ (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আয়েশা (রা.)-এর কাছে রাসুল (স.)-এর তাহাজ্জুদ নামাজ (রাতের) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, তিনি রাতের প্রথমাংশে ঘুমাতেন। তারপর নামাজে দাঁড়াতেন এবং সেহরির পূর্বক্ষণে বিতির আদায় করতেন। এরপর প্রয়োজন মনে করলে বিছানায় আসতেন। তারপর আজানের শব্দ শুনে জেগে উঠতেন এবং অপবিত্র হলে সর্বাগ্রে পানি বইয়ে গোসল করে নিতেন নতুবা অজু করতেন। তারপর নামাজ আদায় করতেন। (সুনানে নাসায়ি: ১৬৮০; মুসনাদ আহমদ: ২৫৪৭৪)
আল-হাজ্জাজ ইবনে গাজিয়্যাহ (রা.) বলেন, ‘তোমার কেউ যদি রাতে জাগ্রত হয়ে সকাল হওয়া পর্যন্ত নামাজ আদায় করে, তাহলে সে তাহাজ্জুদ আদায়কারী হিসেবে ধর্তব্য হবে। কেননা তাহাজ্জুদ হলো- ঘুম থেকে জেগে নামাজ পড়া, এরপর ঘুমিয়ে আবার জেগে নামাজ পড়া। রাসুল (স.)-এর তাহাজ্জুদ নামাজ এমনই ছিল।’ (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ: ২৮০/২)
অতএব আল্লাহর সন্তুষ্টি পেতে তাহাজ্জুদসহ রাতের নফল ইবাদত-বন্দেগির বিকল্প নেই। রাত জেগে নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার পাশাপাশি নফল ইবাদত-বন্দেগিতে নিজেদের নিয়োজিত রাখা মুমিন মুসলমানের উচিত। হাদিসে ঘোষিত প্রিয়নবী (স.)-এর পড়া দোয়া বেশি বেশি পড়া উচিত। আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে তাহাজ্জুদ যথাযথভাবে আদায় করার তাওফিক দান করুন। দুনিয়া ও পরকালের কল্যাণ লাভের তাওফিক দান করুন। আমিন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।