জুমবাংলা ডেস্ক : প্রতিবন্ধি হলেও সমাজের শত প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে জীবন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার তানিয়া খাতুন। তাকে দেখে মনে হয় সাত-আট বছরের শিশু। অথচ জন্মসনদ বলছে, তার বর্তমান বয়স ১৯ বছর। অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী তিনি।
পরিবারের সচ্ছলতা ফেরানোর পাশাপাশি অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে আইনজীবী হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তানিয়া। কিন্তু অর্থাভাব আর শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় ভেঙ্গে গেছে সে স্বপ্ন। তানিয়ার এগিয়ে যাবার পথে সরকারি বেসরকারি সহযোগিতা চেয়েছেন তানিয়ার পরিবার।
পাবনার আটঘরিয়া উপজেলার হাপানিয়া গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর তাজুল ইসলাম-নাছিমা খাতুন দম্পতির মেয়ে তানিয়া খাতুন। দুই ছেলে এক মেয়ের মধ্যে তানিয়া সবার বড়। প্রথম দেখায় তানিয়াকে যে কারো মনে হবে সাত-আট বছরের শিশু। কিন্তু জন্ম সনদের তথ্য অনুযায়ী তার বর্তমান বয়স ১৯ বছর।
২০০৩ সালে স্বাভাবিক শিশুর মতোই স্বাভাবিকভাবে জন্মগ্রহন করে তানিয়া। কিন্তু পরবর্তীতে বয়স অনুপাতে বৃদ্ধি পায়নি তার শারীরিক গঠন। দিন যত গড়িয়েছে ততই দুশ্চিন্তা জেঁকে বসেছে বাবা-মায়ের মনে। তানিয়াকে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসা করিয়েও সুফল পাননি তারা। তবে, তানিয়ার প্রবল ইচ্ছা শক্তির কাছে হার মেনেছে তার শারীরিক প্রতিবন্ধকতা।
সমাজের বাঁকা চোখ ও কটু কথা উপেক্ষা করে চালিয়ে গেছে শিক্ষা জীবন। ২০১৯ সালে বেরুয়ান বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও ২০২১ সালে বেরুয়ান মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে রেখেছেন মেধার স্বাক্ষর। বর্তমানে আটঘরিয়া সরকারি কলেজের অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্রী তিনি। পঞ্চম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় তানিয়া জানতে পারেন তার শারীরিক অক্ষমতার বিষয়টি। তারপর থেকে সমাজের মানুষের নানা কথা সহ্য করে চলেছেন তিনি।
আলাপকালে তানিয়া খাতুন বলেন, ক্লাস ফাইভে ওঠার পর আমি জানতে পারি আমি এরকম। তখন থেকেই খারাপ লাগে আমার। আমার পাশের অনেক মানুষই অনেক বড় হয়ে যাচ্ছে, অথচ আমি বড় হচ্ছি না, এতটুকুই রয়ে গেছি। চলাফেরার পথে সবাই কেমন করে আমার দিকে তাকায়, আঙ্গুল তুলে নানারকম কথা বলে। আমি কারো সাথে বন্ধুত্ব করতে পারি না, কথা বলতে পারি না। আমি ছোট, এটা কি আমার অপরাধ। লেখাপড়া করে একটা ভাল চাকুরী করে বাবা-মায়ের কষ্ট দূর করতে চাই। আইনজীবি হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্বপ্ন পূরণ হবে কি না জানিনা।
তানিয়া খাতুনের দিনমজুর বাবা তাজুল ইসলাম বলেন, মেয়েকে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু এখন তাকে নিয়ে সবসময় সবার কাছে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। সবাই হাসাহাসি করে, এতটুকু মেয়েকে কোনোদিন বিয়ে দিতে পারবো না। তার বয়সী অনেক মেয়ের বিয়ে হয়ে সন্তান হয়ে গেছে। এর চেয়ে বাবা হিসেবে কষ্টের কি আছে বলেন।
তানিয়ার মা নাছিমা খাতুন বলেন, অন্যান্য শিশুর মতোই তানিয়ার জন্ম হয়। কিন্তু পরে দেখি তার বয়সী অন্যান্য শিশুরা বাড়ছে, কিন্তু ও বাড়ে না। তখন বিভিন্ন জায়গায় অনেক টাকা পয়সা খরচ করে ডাক্তার দেখিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। ডাক্তার বলছে, তানিয়ার রক্ত কনিকার সমস্যা। ওর মাথার ব্রেন ভাল হওয়ায় কষ্ট করে লেখাপড়া করাচ্ছি। কিন্তু তানিয়া আইনজীবি হতে চায়। আমাদের সে সামর্থ নাই। তাই স্থানীয় কলেজে ভর্তি করেছি। সবাই যদি সহযোগিতা করে তাহলে তানিয়ার জীবনটা সুন্দর হতে পারে।
পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. সালেহ মুহাম্মদ আলী বলেন, আধুনিক চিকিৎসায় অনেক প্রতিবন্ধকতা থেকে স্বাভাবিক হয়। কিংবা স্বাভাবিক জীবনের যাপন করানোর মতো কাছাকাছি নিয়ে আসা যায়। তানিয়ার দূর্ভাগ্য হয়তো অর্থাভাবে তার চিকিৎসা হয়নি। সরকারের পাশাপাশি সমাজের বিত্তবানরা মানসিক, সামাজিক ও আর্থিকভাবে তানিয়ার পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন।
আটঘরিয়া সরকারি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ শরিফুল আলম বলেন, তানিয়া কলেজে, ভর্তি থেকে শুরু করে বেতন, বইসহ সকল সুযোগ সুবিধা ফ্রি করে দিয়েছি। আগামীতেও তার শিক্ষাজীবনে যেকোনো সহযোগিতায় কলেজ কর্তৃপক্ষ পাশে থাকবে।
এছাড়া কলেজের অন্যান্য শিক্ষার্থীসহ তার সহপাঠিদের বলে দিয়েছি যেন তানিয়ার সাথে বন্ধুসুলভ ভাল আচরণ করে, তানিয়া যাতে কষ্ট না পায় সেদিকে সকল শিক্ষককে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
আটঘরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান তানভীর ইসলাম বলেন, তানিয়া শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও, তার মানসিক শক্তি অনেক বেশি। যেকারণে সে অনার্সে লেখাপড়া করতে পারছে। ওর বিষয়ে জানার পরই তাকে শিক্ষাবৃত্তি দিচ্ছি।
তানিয়ার চিকিৎসার সকল ব্যয় আমরা বহন করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। তার পরিবারকে একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়া হবে। তানিয়া যাতে মনে না করে সে সমাজের বাইরের কেউ, সে লক্ষ্যে সব ব্যবস্থা নেয়া হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।