জুমবাংলা ডেস্ক : নতুন আয়কর আইনে সঞ্চয়পত্রের মুনাফাকে করদাতার আয় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। পুরোনো আইনে মুনাফার অর্থ করদাতার আয়ের সঙ্গে যুক্ত হতো না, শুধু মুনাফার ওপর ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হতো, যা করদাতার চূড়ান্ত করদায় হিসাবে বিবেচিত হতো। অর্থাৎ সঞ্চয়পত্র থেকে পাওয়া মুনাফার ওপর আর কোনো কর দিতে হতো না। নতুন আইনে একই হারে উৎসে কর কাটলেও অন্য (চাকরি, ব্যবসা, বাড়ি ভাড়া প্রভৃতি) আয়ের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা যোগ করে করদাতার চূড়ান্ত করদায় নির্ধারণ করা হবে। এ কারণে ক্ষেত্রবিশেষে চলতি করবর্ষ থেকেই করদাতাদের বাড়তি কর দিতে হবে। মূলত নতুন আইনে পুরোনো আইনের একটি ধারা {৮২ (সি) ২(ডি)} বিলুপ্ত করার কারণে কর নির্ধারণের হিসাব পালটে গেছে।
একই কারণে চলতি করবর্ষে জমি বিক্রি থেকে প্রাপ্ত মুনাফা করদাতার আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। জমি বিক্রির মুনাফার ওপর আয়কর দিতে হবে। দলিল রেজিস্ট্রির সময় অন্যান্য করের (রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার) সঙ্গে বিক্রেতার হয়ে ক্রেতা উৎসে কর দিয়ে দিত। সেই উৎসে করই বিক্রেতার চূড়ান্ত করদায় বিবেচনা করা হতো। কিন্তু নতুন নিয়মে বিক্রির মুনাফার ওপর ১৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স দিতে হবে। এই গেইন ট্যাক্স থেকে বিক্রির সময় যে হারে উৎসে কর দেওয়া হয়েছে, সেটি বাদ দেওয়া হবে। এছাড়া রপ্তানির বিপরীতে সরকার যে নগদ সহায়তা দেয়, সেই অর্থকে নতুন আইনে আয় হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে।
সঞ্চয়পত্রে করের হিসাব : উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, যদি একজন করদাতার বার্ষিক আয় ১০ লাখ টাকা হয়, সেক্ষেত্রে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের সীমা অনুযায়ী এ আয়ের বিপরীতে তাকে বার্ষিক ৭২ হাজার ৫০০ টাকা কর দিতে হতো। পাশাপাশি তিনি প্রতিবছর সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের বিপরীতে দুই লাখ টাকা মুনাফা পান। ব্যাংক দুই লাখ টাকা মুনাফার ওপর ২০ হাজার টাকা উৎসে কর কর্তন করে করদাতার ব্যাংক হিসাবে বাকি অর্থ স্থানান্তর করে থাকে। এতদিন ২০ হাজার টাকা উৎসে কর চূড়ান্ত করদায় হিসাবে বিবেচনা করা হতো। করদাতা উৎসে কর কর্তনের বিষয়টি রিটার্নে শুধু উল্লেখ করতেন। অর্থাৎ করদাতা মোট আয়ের (বার্ষিক আয়+সঞ্চয়পত্রের মুনাফা) ওপর আয়কর দিলেন ৭২ হাজার ৫০০ টাকা।
নতুন নিয়মে, সঞ্চয়পত্রের মুনাফা করদাতার বার্ষিক আয়ের সঙ্গে যোগ হবে। সে হিসাবে ওই করদাতার বার্ষিক আয় দাঁড়াবে ১২ লাখ (১০ লাখ টাকা বার্ষিক আয়+দুই লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রের মুনাফা) টাকা। এর বিপরীতে তাকে ব্যক্তিশ্রেণির সীমা অনুযায়ী এক লাখ পাঁচ হাজার টাকা কর দিতে হবে। যেহেতু ব্যাংক ২০ হাজার টাকা উৎসে কর কেটে রেখেছে, তাই করদাতাকে রিটার্নের সঙ্গে ৮৫ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ করদাতাকে আগের চেয়ে ১২ হাজার ৫০০ টাকা বেশি কর দিতে হবে। চলতি করবর্ষ থেকেই এ বিধান কার্যকর হয়েছে। যেসব করদাতা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে রিটার্ন জমা দেবেন, তাদের এই নিয়মে আয়কর দিতে হবে। অর্থাৎ নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যাদের আয় বেশি, তাদের বেশি ট্যাক্স দিতে হবে। কারণ, করযোগ্য আয়ের সঙ্গে সঞ্চয়পত্রের মুনাফা যোগ করলে করদাতার করযোগ্য আয় বেড়ে যাবে। ফলে ব্যক্তিশ্রেণির আয়করের স্তর (স্ল্যাব) পরিবর্তন হয়ে করদাতা উপরের স্তরে চলে যাবে। এতে বাড়তি কর দিতে হবে।
জানা যায়, পুরোনো আইনে ৮২(সি) ধারায় ছয়টি খাতের আয়ের বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে করকে চূড়ান্ত করদায় হিসাবে বিবেচনা করা হতো। এগুলো হচ্ছে-সরকার কর্তৃক জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদত্ত অর্থের বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে কর, সঞ্চয়পত্রের সুদ আয় বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে কর, রপ্তানিকারকদের নগদ সহায়তার বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে কর, এমপিওভুক্ত স্কুলের এফডিআর-এর প্রাপ্ত সুদের বিপরীতে কর্তনকৃত উৎসে কর, জমি বিক্রয়কালে কর্তনকৃত উৎসে কর এবং জমি ডেভেলপারদের সঙ্গে সাইনিং মানির বিপরীতে প্রদত্ত উৎসে কর। নতুন আয়কর আইনে এ ধারাটি বিলুপ্ত করা হয়েছে। ফলে চলতি করবর্ষ থেকে করদাতার সব ধরনের আয় তার বার্ষিক আয়ের সঙ্গে যুক্ত হবে এবং সে মোতাবেক তাকে স্ল্যাবভিত্তিক অথবা মূলধনি আয় হিসাবে উৎসে কর রিটার্নের সঙ্গে জমা দিতে হবে।
বিপাকে পড়বেন রপ্তানিকারকরাও : রপ্তানি খাতকে উৎসাহিত করতে সরকার ১ থেকে ২০ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দিয়ে থাকে। এ সহায়তার বিপরীতে ১০ শতাংশ উৎসে কর কেটে রাখা হয়। রপ্তানিকারকরা দীর্ঘদিন ধরে এ খাতের উৎসে কর বাতিলের দাবি জানিয়ে এলেও তা বহাল রাখা হয়েছে। নতুন আইনে পুরোনো আইনের ৮২(সি) ২ (ডি) ধারা বিলুপ্ত করার কারণে রপ্তানি প্রণোদনার ওপর বাড়তি করের বোঝা চাপবে। সহায়তার অর্থ রপ্তানিমুখী শিল্পের আয় হিসাবে গণ্য করা হবে। তৈরি পোশাকশিল্পকে রপ্তানি আয়ের ওপর ১২ শতাংশ করপোরেট কর এবং অন্য আয়ের ওপর কোম্পানি হিসাবে ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ হারে আয়কর দিতে হয়। অর্থাৎ নগদ সহায়তার ওপর ২৭ দশমিক ৫০ শতাংশ করপোরেট কর দিতে হবে।
এ বিষয়ে বিকেএমইএ-এর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, সরকার রপ্তানিকে উৎসাহিত করতে এবং প্রতিযোগী সক্ষমতা ধরে রাখতে নগদ সহায়তা দেয়। এই সহায়তার ওপর উৎসে কর কাটার কোনো যৌক্তিকতা নেই। নতুন আয়কর আইনে যদি নগদ সহায়তাকে শিল্পের অন্য আয়ের সঙ্গে যোগ করে করারোপ করা হয়, সেটা হবে রপ্তানি খাতের সঙ্গে তামাশা করার শামিল। শিল্পমালিকদের আয় থেকে অতিরিক্ত কর আদায় করতেই আগের আইনের ধারা বিলুপ্ত করা হয়েছে বলে মনে করি। পোশাকশিল্প পরিবারের পক্ষ থেকে এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। তিনি আরও বলেন, সরকার আইন করে ব্যবসা-বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে। কিন্তু কিছু সরকারি কর্মকর্তা আইনে এমন সব ধারা যুক্ত করেন, যা সাধারণ ব্যবসায়ীদের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। মূলত ব্যবসায়ীদের ফাঁদে ফেলে বাড়তি উপার্জন করতে তারা এমনটা করেন। যদি গার্মেন্ট মালিকদের নগদ সহায়তার ওপর একবার উৎসে কর এবং পরে আবার অন্য আয় হিসাবে করপোরেট কর দিতে হয়, তাহলে নগদ সহায়তা দেওয়ারই দরকার নেই।
জমি বিক্রিতে করের খড়্গ : জমি অধিগ্রহণের ক্ষতিপূরণ, নিজের বা পৈতৃক সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি বিক্রি অথবা জমি ডেভেলপারকে দেওয়ার চুক্তির ক্ষেত্রে নতুন আইনে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এতে করদাতাদের বাড়তি হারে কর দিতে হবে। পুরোনো আইনে জমি বিক্রির সময় প্রদত্ত উৎসে করকে চূড়ান্ত করদায় হিসাবে বিবেচনা করা হতো।
এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসাবে বলা যায়, রফিক সাহেব ১০ বছর আগে রাজধানীর গোড়ানে একটি জমি এক কোটি টাকায় কিনেছিলেন। সেই জমি তিনি চলতি করবর্ষে ১০ কোটি টাকায় বিক্রি করলেন। প্রথা অনুযায়ী জমি বিক্রির সময় ক্রেতা দলিল রেজিস্ট্রির সময় অন্যান্য করের (রেজিস্ট্রেশন ফি, স্ট্যাম্প শুল্ক, স্থানীয় সরকার) সঙ্গে ৮ শতাংশ (৮০ লাখ টাকা) উৎসে কর পরিশোধ করে থাকেন। নতুন আইনে করদাতার জমি বিক্রি থেকে পাওয়া মুনাফার অর্থ রিটার্নে মূলধনি আয় (বিক্রয়ের অর্থ-ক্রয়ের অর্থ) হিসাবে প্রদর্শন করতে হবে। নতুন আইনে মূলধনি আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর রয়েছে। অর্থাৎ করদাতাকে জমি বিক্রির অর্থের ওপর এক কোটি ৩৫ লাখ টাকা কর দিতে হবে। যেহেতু রেজিস্ট্রির সময় উৎস কর বাবদ ৮০ লাখ টাকা ক্রয়কারী পরিশোধ করেছে, সেহেতু রিটার্নের সঙ্গে জমি বিক্রয়কারীকে আরও ৫৫ লাখ টাকা গেইন ট্যাক্স দিতে হবে। অন্যদিকে অনেকে পৈতৃক সূত্রে জমি বা সম্পত্তি বিক্রি করেন। সেক্ষেত্রে এ জাতীয় জমির মূল্য অজানা থাকায় পুরো বিক্রয় মূল্যের ওপর ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স দিতে হবে।
নতুন আইনে ব্যক্তি করদাতাদের জমি বিক্রির মূলধনি আয়কে দুটি ক্যাটাগরিতে ভাগ করা হয়েছে। প্রথমত, জমি কেনার পাঁচ বছরের মধ্যে বিক্রি বা হস্তান্তর করলে ব্যক্তিশ্রেণির স্ল্যাব অনুযায়ী কর দিতে হবে। সে হিসাবে উল্লিখিত রফিক সাহেবকে ২ কোটি ২২ লাখ ৮২ হাজার টাকা আয়কর দিতে হবে। অন্যদিকে পাঁচ বছর পর জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করলে ১৫ শতাংশ গেইন ট্যাক্স দিতে হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।