রঞ্জু খন্দকার, গাইবান্ধা থেকে : ভারতের পাটনা থেকে আসা শহিদ মিয়া সেই বালক বয়সে হাতে ধরেছিলেন রিকশার হাতল, পায়ে প্যাডেল। এভাবে সংসারের চাকা ঘুরিয়েছেন ৫১ বছর। এরপর শরীর আর কুলোয়নি। শহিদের স্ত্রী মনি বেগম মেসবাড়িতে কাজ বাদ দিয়ে দশ বছর আগে দেন চায়ের দোকান। এখন দিনে প্রায় আড়াই শ কাপ শুধু চা-ই বিক্রি হয় সেখানে। সঙ্গে চলে ‘টা’-ও। এই ‘চা ও টা’ বেচেই চলছে বুড়ো-বুড়ির সংসার।
অশীতিপর শহিদ ও বছর ষাটেকের মনির বাড়ি গাইবান্ধা শহরের মাঝিপাড়ায়। তাঁদের চায়ের দোকানটি থানাপাড়া এলাকায় রেলক্রসিংয়ের ধারে। এটি শহরে ‘চাচির দোকান’ নামে পরিচিত। গুগল ম্যাপেও এটি এই নামে চিহ্নিত। এই দোকানে শহরের বিভিন্ন এলাকার লোকজন চা খেতে ছুটে আসেন। আড্ডা দিতেও ভিড় জমান।
শহিদ জানান, তিনি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ– তিন আমলই দেখেছেন। একসময় যে অভাব ছিল, তা আর নেই বটে, কিন্তু শান্তিও দেশ থেকে উঠে গেছে। তবে শত অভাব-অভিযোগের মাঝেও লোকজন তাঁর দোকানে আসে, চা খায়। এসব দেখে তিনি শান্তি পান, অভাবও ঘোচে।
ভারতের পাটনা রাজ্যের মুজাফফরপুর থেকে সেই ব্রিটিশ আমলে ভাগ্যের অন্বেষণে বাংলাদেশে আসেন শহিদের বাবা। এরপর আর ফিরে যাননি। একসময় মুক্তিযুদ্ধের পর বিহারি হিসেবে আটকে যায় শহিদের পরিবার। তবে এখন এ দেশের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার পেয়েছেন তাঁরা।
শহিদ বলেন, এখন এটাই তাঁর দেশ। এ দেশ তাঁকে আশ্রয় দিয়েছে। তিনি একে মায়ের মতোই ভালোবাসেন। তিনি আর ভারতে যেতে চান না। এখানেই আমৃত্যু থাকতে চান।
প্রথমে বিহারি এক নারীকে বিয়ে করেন শহিদ। সে ঘরে তাঁর চার মেয়ে, এক ছেলে। তাঁরা বিয়েশাদি করে নাটোরে থাকে। এরপর বাঙালি মনিকে বিয়ে করেন শহিদ। এ সংসারে তাঁর দুই ছেলে। তাঁরাও আলাদা সংসার করছেন।
শহিদ বলেন, ১২ বছর বয়সে রিকশা চালানো শুরু করেন তিনি। টানা ৫১ বছর চালিয়েছেন। এরপর শরীরে বয়সজনিত নানা অসুখ বাসা বাঁধে। ২০১৪ সালে এই রেলক্রসিংয়ে টিনের ছাউনি তুলে চায়ের দোকান দেন তিনি। মূলত স্ত্রী মনি দোকানটি চালায়। তিনি সহযোগী।
গাইবান্ধা শহরকে দুভাগ করে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর চলে গেছে রেলপথ। এই পথ ধরে আধা কিলোমিটার হাঁটলে চোখে পড়বে গেটম্যানহীন একটি রেলক্রসিং। এখানে থামার সংকেত দিয়ে লেখা– সাবধান, সামনে ক্রসিং। কিন্তু এই সতর্কবাণী উপেক্ষা করে লোকজন এখানে শুধু থামেনই না, রীতিমতো ভীড় জমান। কারণ আর কিছুই নয়–এখানেই চাচির চায়ের দোকান!
চাচির দোকানের নিয়মিত খদ্দের গাইবান্ধা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী রাজিবুল ইসলাম ও শান্তা ইসলাম। তাঁরা বলেন, চাচির চায়ের হাতে কিছু একটা আছে। এ কারণে দিনে এক কাপ হলেও চা খেতে তাঁরা এখানে আসেন। সঙ্গে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে আড্ডাও দেন।
মনি বেগমের চায়ের দোকানের পসার এত সহজে হয়নি। অনেক বাধাও পেরোতে হয়েছে তাঁদের।
শহিদ বলেন, তাঁদের দোকানে এ পর্যন্ত চুরিই হয়েছে ৭-৮ বার। এলাকার কাউন্সিলরের দেওয়া টিউবওয়েলটিও খুলে নিয়ে গেছে একবার। এরপরও দোকানে রাতে থাকেন না তাঁরা। সকাল সাতটায় শুরু করে সন্ধ্যা ৭টায় বন্ধ করেন। এখানে রাত কাটালে রাত-বিরেতে বিড়ি-সিগারেটের জন্য খদ্দেররা বিরক্ত করবে। এর চেয়ে বাড়ি গিয়ে ঘুমানোই ভালো। লাভ না হয় কিছু কমই হলো!
চায়ের দোকান করে সংসার ভালোই চলছে বলে জানান শহিদ ও মনি। অন্তত রিকশা চালানো ও মেসবাড়ির কঠিন ও কষ্টকর কাজের চেয়ে এটা ভালো বলে মানছেন তাঁরা।
শহিদ ও মনি বলেন, তাঁদের দোকানে দিনে এক থেকে দেড় কেজি চিনি এবং এক থেকে দেড় কৌটা দুধের চা যায়। ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী টি ব্যাগ ও চাপাতা দিয়ে রঙ ও দুধ চা বানিয়ে লেবু, আদা ও লং দিয়ে পরিবেশন করা হয়। সব মিলিয়ে দিনে প্রায় আড়াই শ কাপ চা বেচেন তাঁরা। সঙ্গে বিড়ি, সিগারেট, পান, বিস্কুটও রয়েছে। এ দোকানের মাধ্যমে সংসার চালানোর পাশাপাশি দিনে দেড় শ টাকার একটা কিস্তিও চালান তাঁরা।
এই দম্পতি চায়ের দোকানটি করেই বাকি জীবনের লেনদেন চুকোতে চান। তাঁদের আশা, আল্লাহ যেন চা বেচেই জীবনের বাকি দিনগুলো পারি দিতে সাহায্য করেন।
শহিদ ও মনি বলেন, ক্রেতারা এখন যেমন সন্তুষ্ট, বাকি সময়গুলোতেও যেন সন্তুষ্ট থাকে, সেই চেষ্টা থাকবে। লাভ কিছু কম হলেও কেউ যেন বেজার না হোন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।