আশিক উল বারাত : বর্তমান সময়ে অনলাইন কেনাকাটায় সবচেয়ে আলোচিত কিংবা সবচেয়ে ব্যবহৃত শব্দটি হচ্ছে “স্যার প্রাইজ জানতে ইনবক্সে” আসুন। দেখা গেল, আপনি ফেসবুকে স্ক্রল করতে করতে কোন একটা পাঞ্জাবী দেখলেন এসময় কমেন্টে দাম জানতে চেয়ে মন্তব্য করলেন। কিন্তু আপনাকে বলা হলো স্যার ইনবক্সে আসুন।
এবার ইনবক্সে দাম জানতে চাওয়ার পর আপনাকে আবার বলা হলো, কোন প্রোডাক্টটা লাগবে ছবিটা এখানে একটু ডাউনলোড করে সেন্ড করুণ। এই যে এতো জটিল একটা প্রক্রিয়া যার শুরুটা হচ্ছে স্যার ইনবক্সে আসুন এই মন্তব্যের প্রেক্ষিতে এই প্রক্রিয়ায় দেখা যায় ক্রেতা একটা সময় পণ্যটি কেনারই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন।
আবার অনেক ক্রেতাই ইনবক্সে গিয়ে বিভিন্নভাবে প্রতারণা কিংবা বাজে ব্যবহার এর শিকার এর অভিযোগও তুলেছেন। নুসরাত দিবা নামে একজন ক্রেতা তাঁর অনলাইন কেনাকাটার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, প্রায় সময়ই দেখা যায় ইনবক্সে দাম জানতে চাওয়ার পর পণ্যটির দাম বর্তমান মার্কেটের দাম থেকে অনেক বেশি বলা হচ্ছে। কিংবা মেসেজের রিপ্লাই দিতে দেরি হচ্ছে। এ কারণে যে পণ্যটি কেনার জন্য অনলাইনে সময় ব্যায় করলাম। সে পণ্যটাই হয়তো কেনা হয় না।
এ বিষয়ে বেসরকারি চাকুরীজীবী সামিউল ইসলাম জানান, অনলাইন কোন পণ্য কিনতে গেলে যদি ক্রেতা ইনবক্সে দাম বলতে চায় তাহলে প্রচন্ড বিরক্ত হই। তিনি বলেন বিরক্ত হয়ে আর এখান থেকে কিছু কেনাই হয় না। আমার কি ঠ্যাকা পড়েছে ইনবক্সে গিয়ে তাদের কাছে দাম জেনে তারা কখন রিপ্লাই দিবে এর অপেক্ষায় থেকে এরপর জিনিস কিনব?
এ বিষয়ে সাংবাদিক এ আর ফারুক জানান, আমি খুবই বিরক্ত হই যখন কেউ ইনবক্সে দাম জানতে চাওয়ার জন্য বলে। কারণ, আমার মনে হয় দামাদামি বিষয়টি গোপনীয় কিছু নয় এবং এটি উন্মুক্ত থাকা উচিত। এছাড়াও, ইনবক্সে দামাদামি ক্ষেত্রে অযাচিত হয়রানির আশঙ্কাও থাকে। যেহেতু অনলাইন বিক্রয় প্ল্যাটফমগুলোতে ক্রেতা বিক্রেতার পূর্ব পরিচয় থাকে না, তাই এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এর বাইরে, ইনবক্সে দামাদামি করার ক্ষেত্রে দাম নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি অনেকটাই বিক্রেতার হাতে থাকে তাই ক্রেতার ঠকে যাওয়ার শঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে গৃহিণী বৃষ্টি হোসাইন জানান, এভাবে দাম বলার প্রক্রিয়াতে প্রচন্ডভাবে বিরক্ত হই।আপনারা ইনবক্সে দাম বলে কি বুঝাতে চান? মূল দামের চেয়ে দামাদামি করে কমাবেন? এভাবে আপনার এবং আমাদের দুজনেরই সময় নষ্ট।
ফয়সাল খান চাকরী করেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। অনলাইনে পণ্য কেনাকাটার বিষয়ে তিনি জানান, কর্মব্যস্ততায় বিভিন্ন প্রোডাক্ট কেনার জন্য মার্কেটে যাওয়া সম্ভব হয় না বলেই অনলাইনে প্রোডাক্ট কেনা হয়। কিন্তু অনলাইনের ব্যবসায়ীরা দাম ইনবক্সে বলে। প্রায় সময়ই দেখা যায় একটা পণ্য কেনার পরে অন্য কোথাও পণ্যটি আরও অনেক কমে বিক্রি হচ্ছে। আবার ইনবক্সে দামাদামি করতে গেলে দেখা যায়, তীব্রভাবে খারাপ ব্যবহার করে মেসেজের অন্যপাশ থেকে যেটা আসলে সহ্য করার মতো না। এসময় ফয়সাল খান জানান, আমি অনলাইন থেকে কেনাকাটায় এখন ইনবক্সে আসুন শব্দটি শুনলেই ভয় পাই।
আইনজীবী অপরাজিতা অনলাইনে কেনাকাটা সম্পর্কে তাঁর অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বলেন, আমি অনলাইনে কিছু কিনি না। যদিও কিনি যেটার দাম বলা থাকে সেটা দেখি। একবার পোস্ট দেখবো, তারপর মেসেজ করবো তারপর ইনবক্সে যাবো ভাই এতো সময় কই। ইনবক্স বললেই আমি সরে আসি। ওপেন কমেন্টে দাম বলতে ওদের অসুবিধা কি এটাই বুঝি না।
আবির দাস নামের একজন শিক্ষার্থী জানান, ক্রেতার দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিষয়টা খুবই বিরক্তিকর। ইনবক্সে ম্যাসেজ দেয়ার সময় হয় না দেখেই আর কিছু কেনাও হয় না।
তবে অনলাইন ব্যবসায়ীরা বিষয়টি দেখছেন রিচ কমা কিংবা বাড়ার দিক থেকে। যারা ব্যবসায়ী তাঁদের মতে সরাসরি প্রোডাক্ট এর সাথে দাম লিখে দিলে পোস্টে কমেন্ট কম আসে। এ কারণে রিচও কম হয়।
এ বিষয়ে পিঞ্জর নামের একটি অনলাইন শপের কর্ণধার তনয়া জামান জানান, আসলে ব্যবসায়ীর দিকটা কেউ ভাবে না। আমি নিজে প্রোডাক্ট বিক্রি করার পর এখন ইনবক্সে দাম বলার বিষয়টা বুঝি। তিনি বলেন, পেইজে অবশ্যই সব প্রোডাক্টের ছবি থাকে। ক্রেতা ছবিতে কমেন্ট করবে। সেলারের বিক্রি দরকার হলে সেলার রিপ্লাই করবে।আর কাস্টমারের অতি আগ্রহ থাকলে কাস্টমারও নিজেই ইনবক্সে যাবে। এসময় তিনি সরাসরি দাম না বলার অন্যতম কারণ হিসেবে জানান মার্কেটের অবস্থার কথা। তিনি জানান, মোটামুটি সব কমন প্রোডাক্ট। আমি যখন দাম লিখে পোষ্ট করবো, ওই একই পণ্যের অন্য ব্যবসায়ী আমার পেইজ থেকে অন্তত ৫ টাকা কমে প্রোডাক্ট সেল দিবে। কাস্টমার তখন কোনটা নিবে? একারণেই ইনবক্সে দাম বলি আমি।
এসময় তনয়া বলেন বাধ্য হয়েই ইনবক্সে দাম বলি। এই যে হুজুগে কিছু উদ্যোক্তা তৈরি হয়, যারা মার্কেটে আসার পর প্রথম টার্গেট করে যে সব পেইজে দাম কেমন। সেই দাম থেকে তারা দাম কমিয়ে দেয়। তাঁরা ভাবে যে আগে মার্কেটে উঠে নেই তারপর দেখা যাবে লাভের ব্যাপারটা। কিন্তু কিছুদিন যাওয়ার পর তারা তো ব্যবসায় টিকতে পারেই না উলটো মার্কেট নষ্ট করে যায়।
তিনি উদাহারণ দিয়ে বলেন, আমার একটা প্রোডাক্ট আছে যেটা আমি ৫০০টাকা দিয়ে বানাই ৭৮০টাকা সেল করি। কারণ এখানে আমার ট্রান্সপোর্ট খরচ আছে, প্যাকিং খরচ আছে, আরো আনুসাঙ্গিক বিল আছে। আমি চেষ্টা করি যেনো মোটামুটি ১০০-১৫০টাকা প্রোফিট আমার থাকে। কিন্তু কিছুদিন আগে দুইটা পেইজ ওনার আমাদের কারখানা থেকে হিউজ প্রোডাক্ট নিল। নেয়ার পর তারা সেই প্রোডাক্ট বিক্রি করছে ৭৫০টাকা। আমি উৎপাদক হয়ে যদি না পারি এই দামে দিতে,,তারা কিভাবে দিচ্ছে!! শুরুর দিকে তারা ভালোই করল দেখলাম, কিন্তু ১মাসের মধ্যে তারা এখন ডাউন। কিন্তু ওইযে দাম কমিয়ে গেছে, আমি এখন আর আগের প্রাইস রাখতে পারছি না। অথচ আমার টার্গেট ছিল আমি প্রাইস ঈদের পর বাড়িয়ে ৮৫০ করবো। কারণ মোটামুটি সব পেইজে ৮০০ এর উপর সেল হয় সেইম ডিজাইনের প্রোডাক্ট, বাট কোয়ালিটি আরও অনেক খারাপ। আর এদিকে আমি বেস্ট কোয়ালিটি প্রোভাইড করেও দাম বাড়াতে পারছি না।
ইনবক্সে দাম বলার বিষয়ে কথা হয় কলত্র নামের একটি অনলাইন শপের কর্ণধার নুসরাত জাহান মুমুর সাথে। তিনি জানান, লজিকালি দাম বলা বা না বলা দুইটাই ঠিক। বিরক্তও হয়, আবার ইনবক্সে দাম বলাও বিজনেস পলিসি হিসেবে ঠিক। এটা বলা যায় বিজনেস টেকনিক। দাম জানতে চেয়ে অনেক কমেন্ট আসবে। কিন্তু রিপ্লাই দিবে ইনবক্সে। এতে কমেন্ট বাড়বে। রিচ বাড়বে। তাই আমার মতে ইনবক্সে বলাটাই ঠিক।
তবে ইনবক্সে দাম বলার বিষয়ে বিরোধ পোষণ করে কুঞ্জ নামের একটি অনলাইন শপ এর কর্ণধার নাবিউল হাসান জানান, আমি দাম মেনশন করে দিই। দামের জন্য কমেন্ট বা ম্যাসেজ করলে পেইজের রিচ বাড়বে ঠিক তবে দাম মেনশন করে দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ দাম সরাসরি না বলাটা একধরণের হয়রানি। দাম নিয়ে লুকোচুরি করার কোন যৌক্তিকতা নেই। তিনি জানান, কাস্টমারের কোন পণ্য পছন্দ হলে দাম জানতে না পারলে সে একটা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে যে পণ্যটি কিনবে কি কিনবে না। আর এক্ষেত্রে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বিক্রেতা কখন দাম বলবে। এছাড়াও দাম উন্মুক্ত থাকলে এ ধরণের অন্যন্য পণ্য অন্যান্য স্থানে কেমন কোয়ালিটির পাওয়া যাচ্ছে এইটা দেখে সিদ্ধান্ত নেয়া যায়।
এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা জানান, দাম ইনবক্সে বললে সাময়িক সময়ের জন্য ব্যবসায়ীর কিছুটা রিচ বাড়লেও কেউ যদি সুনামের সাথে দির্ঘদিন ধরে ব্যবসা করতে চায় এবং ব্র্যান্ড ভ্যালু তৈরি করতে চায় তাহলে দাম উন্মুক্ত রাখা ছাড়া ভিন্ন কোন বিকল্প নেই।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর এফ-কমার্স এলায়েন্স এর কো-চেয়ারম্যান খালিদ সাইফুল্লাহ্ বলেন, বর্তমানে ই-কমার্স সেক্টর বড় হবার কারনে এবং ফেসবুক কমার্স বা এফ কমার্স বিজনেসের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় উদ্যোক্তাদের মধ্যেও কম্পিটিশন বেড়েছে। দেখা যায় কোনো একটি প্রোডাক্টের দাম কোনো পেইজে পাবলিক করা থাকলে সেটি দেখে সেম প্রোডাক্টের দাম অন্য কোনো ব্যাবসায়ী কমিয়ে দিচ্ছেন৷
এতে করে অসম প্রতিযোগিতা দেখা যায়৷ এ কারনেই অনেক এফ কমার্স ব্যাবসায়ীরা প্রোডাক্টের দাম পাবলিকলি না জানিয়ে ইনবক্সে আসতে বলেন। ইনবক্সে আসতে বললেই যে সেটি প্রতারনা বা পণ্যের মান খারাপ হবে বিষয়টি এমন না। আসলে প্রতারকরা এই বিষয়টির সুযোগ নিচ্ছে। সূত্র : জনকণ্ঠ অনলাইন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।