জুমবাংলা ডেস্ক : করোনাকালে দেশে অর্থনৈতিক সংকটের প্রথম ধাক্কাটা আসে নারী শিক্ষার ওপর। ঝরেপড়া মেয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেড়েছে বাল্যবিয়ের হার। দেশের অর্থনীতি করোনাকালের সংকট অতিক্রম করলেও বাল্যবিয়ে নিয়ন্ত্রণে আসেনি। বিশেষজ্ঞরা এর মূল কারণ হিসেবে দারিদ্র্য ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতাকে দায়ী করেছেন। লিখেছেন শাহেরীন আরাফাত
টাঙ্গাইল জেলার ধনবাড়ী উপজেলার ইসলামপুর গ্রামের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী বৃষ্টি (ছদ্মনাম)। চলতি বছরের ২ জুলাই তার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়। গ্রামের সচেতন লোকজন বাল্যবিয়ে সম্পর্কে স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিত করলেও বিয়ে আটকানো যায়নি। রাতে পাশের গ্রামে নিয়ে গিয়ে তাকে বিয়ে দেওয়া হয়। স্বামীর বাড়িতে উঠিয়ে দিতে পারলে প্রশাসনের পক্ষে তেমন কিছু করার থাকে না, বৃষ্টির পরিবার জানে। যার বিয়ে হলো, সেই বৃষ্টির কাছে বিয়ে-সংসার এসব খেলনার মতো।
বৃষ্টির মা ময়না বেগম (ছদ্মনাম) কিছু বাস্তব সমস্যার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। ‘বৃষ্টির বাপ ইটভাটায় কাজ করত। এখন পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না। ভ্যান চালায়। সংসার চলে না। আমার বোনের ছেলের সঙ্গে ওর বিয়ে হইসে। এই সম্বন্ধ কি পরে পাব? আরেকটা মেয়ে আছে আমার।’
এমন সম্বন্ধ কেন গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন ময়না বেগম? জানা যায়, নিজে পড়াশোনা না জানলেও বৃষ্টিকে তিনি স্কুলে পড়াতেন। এসএসসি পর্যন্ত পড়ানোর ইচ্ছা ছিল। কিছুদিন ধরে এলাকার কিছু ছেলে বৃষ্টিকে নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। এ নিয়ে প্রতিবেশীরা বৃষ্টিকেই দোষী সাব্যস্ত করে। সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করে তারা। আশ্রয় নেন বাল্যবিয়ের।
জাতিসংঘের জনসংখ্যাবিষয়ক সংস্থা ইউএনএফপিএর সবশেষ প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাল্যবিয়ের ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে বাংলাদেশ। বিশ্ব জনসংখ্যা পরিস্থিতি নিয়ে চলতি বছর ২০০৬ থেকে ২০২২ সালের তথ্য তুলে ধরে বলা হয়েছে, বয়স ১৮ হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ৫১ শতাংশ মেয়েকে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ১৫ বছর বা তার কম বয়েসী মেয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে বিয়ের হার ২৭ শতাংশ।
বাল্যবিয়ে করোনাকালে প্রকট আকার ধারণ করলেও, এর আগে-পরে বাল্যবিয়ে নিয়ন্ত্রণে নেওয়া উদ্যোগ ও তার ফল ইতিবাচক নয়। কারণ মৌলিক সামাজিক পরিবর্তনের অভাব। বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের উচ্চ হারের ক্ষেত্রে সমাজবিজ্ঞানীরা যেসব কারণ নির্দেশ করেছেন, তার অন্যতম দারিদ্র্য। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালক (কর্মসূচি) বনশ্রী মিত্র নিয়োগী বলেন, ‘যে কোনো সংঘাত, জলবায়ুর অভিঘাত, কভিড, অর্থনৈতিক টানাপোড়েন– যাই হোক না কেন, এর প্রথম শিকার আর লক্ষ্যবস্তু হয়ে যায় নারী ও কন্যাশিশু। দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বল হয়, তখন সে পরিস্থিতি কাটিয়ে ওঠার জন্য বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। বাল্যবিয়ে বন্ধ করার জন্য কি যথেষ্ট বিনিয়োগ আমরা করছি? যতটুকু করছি তা কি সমন্বিত? শুধু অর্থনৈতিক বিনিয়োগ নয়, এখানে অভিভাবকরা এখনও মনোযোগী নয় কন্যাসন্তানের ব্যক্তিত্ব গঠনে, আত্মমর্যাদা নিয়ে বেড়ে ওঠার গুরুত্বে বা স্ব-অভিমানের দৃঢ় বৈশিষ্ট্য গঠনে অথবা নিজের ওপর আস্থা, মনোবল বাড়ানো ও নিজেকে সাহসী করে তোলায়।’
ব্র্যাকের জেন্ডার কর্মসূচির পরিচালক নবনীতা চৌধুরী বলেন, ‘বাল্যবিয়ের যেসব কারণ আমরা দেখতে পাই সেটি শহরে বা গ্রামে একই রকম। এর মধ্যে একটি বড় কারণ হলো, মেয়েদের নিরাপত্তার সমস্যা। আমাদের দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছেলে ও মেয়েদের ভর্তির হার কয়েক দশকে প্রায় সমান হয়ে উঠেছে। মাধ্যমিক স্তর থেকে ক্রমাগতভাবে মেয়েদের ঝরে পড়া বাড়ে। বাংলাদেশে এর কারণ বিচার করতে গেলে প্রথমেই দেখা যায়– মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথ নিরাপদ নয়। বাংলাদেশে উপার্জনকারী কোনো কাজের সঙ্গে এখনও অনেক নারী যুক্ত হতে পারছেন না। এক দশকের বেশি সময় ধরে উপার্জনকারী কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের হার ৩৫ শতাংশের আশপাশে। পরিবার দেখছে– নারীকে পড়ালেও সে আয়-উপার্জন তো করতে পারছে না। প্রথম করণীয়– মেয়েদের চলার পথ নিরাপদ করা। আমরা বাল্যবিয়েকে সমাজে আজও অপরাধ ও অগ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারিনি। সুতরাং আগামী বছর পরিসংখ্যান নিলে এর চেয়ে ভিন্ন কিছু হবে, এমনটা আশা করা যায় না।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক কাবেরী গায়েন বলেন, ‘আমাদের যে সামাজিক নিরাপত্তারবলয় আগের চেয়ে ভঙ্গুর। মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার পথ মসৃণ নয়। তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। ফলে মা-বাবা মনে করেন, কোনো অঘটন হয়ে গেলে মেয়ের বিয়ে হবে না। অর্থনৈতিক অবস্থাভেদে অনেক মা-বাবা মেয়েটিকে বাড়তি মুখ মনে করেন, যাকে বিয়ে দিতে পারলেই ভালো। অনেক মেয়ে চাকরি করলেও দেখা যায়, আয়কৃত টাকার ওপর তার নিয়ন্ত্রণ নেই।’
২০১৮ সালের কর্মপরিকল্পনায় বাংলাদেশ সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে কমিয়ে আনার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছিল। তাতে ১৫ বা তার কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের কথা শূন্যের মধ্যে, ১৮ বা তার কম বয়সী মেয়েদের বিয়ে এক-তৃতীয়াংশ কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছিল। এছাড়া বলা হয়েছিল ২০৪১ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে সম্পূর্ণ বন্ধ করা হবে। জাতিসংঘের সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোলের আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিয়ে নির্মূলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা এ ক্ষেত্রে কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে পাচ্ছেন না।
কাবেরী গায়েন বলেন, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় মেয়েদের ক্ষেত্রে ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন– স্কুলে গেলে মেয়েদের খাবার দেওয়া, তাদের বৃত্তি প্রদান। সেটিও করোনাকালে ভেঙে পড়েছে। ওই সময় ব্যাপক পরিমাণে বাল্যবিয়ে হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার বাজেটে ওই ঝরে পড়া মেয়েদের ফিরিয়ে আনা, তাদের শিক্ষামুখী করার জন্য যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা দরকার ছিল তা করেনি।’
২০১৭ সালে সরকার বাল্যবিয়ে নিরোধ আইন পাস করে। তাতে একাধিক ধারায় কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হয়। এ আইন ব্রিটিশ সরকার প্রণীত ‘চাইল্ড ম্যারিজ রেসট্রেইন্ট অ্যাক্ট-১৯২৯’কে প্রতিস্থাপন করে। তবে আইনটির একটি বিশেষ ধারায় বাল্যবিয়েকে বৈধতা দেওয়া হয়। ওই ধারায় বলা হয়, ‘বিধি দ্বারা নির্ধারিত কোনো বিশেষ প্রেক্ষাপটে অপ্রাপ্ত বয়স্কের সর্বোত্তম স্বার্থে, আদালতের নির্দেশ এবং পিতা-মাতা বা প্রযোজ্য ক্ষেত্রে অভিভাবকের সম্মতিক্রমে, বিধি দ্বারা নির্ধারিত প্রক্রিয়া অনুসরণক্রমে, বিবাহ সম্পাদিত হইলে উহা এই আইনের অধীন অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবে না।’
এ নিয়ে নবনীতা চৌধুরী বলেন, ‘এ আইনের মধ্য দিয়ে ১৪ বছরের মেয়েকেও বিয়ে দিয়ে দেওয়া যাচ্ছে। সামাজিক নিরাপত্তা ও জনমানসে পরিবর্তন না এনে এ অবস্থার কোনো পরিবর্তন সম্ভব নয়।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।