জুমবাংলা ডেস্ক : ডেঙ্গু ভাইরাসের বাহক হলো এডিস ইজিপ্টাই জাতের মশা। ভাইরাসবাহী মশার কামড়ে ডেঙ্গুর জীবাণু একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে। তবে এই মশা কখন কামড়ায় এ নিয়ে অনেকেরই নানা মত আছে।
এতদিন একটি ধারণা প্রচলিত ছিল এই মশাটি মূলত দিনের বেলা কামড়ায়। সচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায়ও দিনের বেলা মশারির ভেতরে থাকতে অথবা ফুলহাতা কাপড় পড়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে এই মশাটি শুধু দিনে নয় বরং রাতেও কামড়ায়। এর অর্থ মশাটির আচরণে পরিবর্তন ঘটেছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য আশঙ্কার কারণ হয়ে উঠতে পারে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এডিস মশা মানুষকে কেবল দিনের বেলায় কামড়ায় কিনা এমন ধারণা যাচাই করতে গত কয়েক বছর ধরে গবেষণা পরিচালনার কথা জানান কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার।
এটি পরীক্ষার জন্য তিনি একজন মানুষকে মশারির ভিতরে রাখেন, তখন বাইরে তাকে কামড়াতে আসা মশাগুলোকে জীবিত ধরে ধরে একটি কাপে সংগ্রহ করা হয়।
তারপর সেই মশাগুলোকে পরীক্ষাগারে এনে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করে মাইক্রোস্কোপের নিচে পর্যবেক্ষণ করা হয় যে এগুলো কোন প্রজাতির মশা।
কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন মৌসুমে টানা ২৪ ঘণ্টা ধরে এই মশা সংগ্রহ ও আচরণ পরীক্ষার কাজ করেছেন তিনি।
তারা মূলত দেখতে চেয়েছিলেন কোন ধরনের মশা কোন সময়ে কামড়াতে বেশি পছন্দ করে। পরীক্ষায় তারা এসব মশার কামড়ানোর ছন্দ, কামড়ানোর সময় বা কর্মকাণ্ডের ধরণ এক এক রকম দেখেন।
এই পরীক্ষা করতে গিয়েই কবিরুল বাশার জানতে পেরেছেন যে এডিস মশা দিনের বেলা যেভাবে কামড়ায়, তেমনি রাতেও কামড়ায়। তবে রাতের বেলায় কামড়ানোর হার কিছুটা কম থাকে বলে তিন জানান।
সম্প্রতি তিনি রাতের বেলায় তার শরীরে বসা মশার প্রজাতি পরীক্ষা করে এডিস মশার উপস্থিতি পেয়েছেন।
এতে তিনি ধারণা করছেন, একসময়ে এডিস মশা শুধু দিনের বেলায় কামড়ালেও এখন এই মশার বৈশিষ্ট্যে বা আচরণগত পরিবর্তন এসেছে।
তিনি বলেন, ‘ইতোপূর্বে আমরা জানতাম এডিস মশা শুধুমাত্র দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকালে ও বিকেলে কামড়ায়। কিন্তু আমাদের গবেষণায় সেটি ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আমাদের ল্যাবরেটরি এবং মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় দেখেছি এডিস মশা রাতেও কামড়ায়।’
উজ্জ্বল আলো
এডিস মশার রাতেও সক্রিয় থাকার কারণ হিসেবে রাতের বেলা অতিরিক্ত উজ্জ্বল আলোর ব্যবহারকে একটি বড় কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হচ্ছে।
কবিরুল বাশারের মতে, শহরে উজ্জ্বল আলোর ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এডিস মশার আচরণে পরিবর্তন হয়েছে।
অতিরিক্ত আলোর কারণে একে তো মশা দিন-রাতের পার্থক্য বুঝতে পারছে না। তার ওপর এখন তারা রাতের পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথেও খাপ খাইয়ে নিয়েছে।
আলোর সাথে মশার আচরণ পরিবর্তনের বিষয়টি প্রথমবারের মতো তার সামনে এসেছে ২০১৯ সালে ঢাকার বিমানবন্দরে কাজ করতে গিয়ে।
ওই বছর বিমানবন্দরে মশার কারণে একটি ফ্লাইট দুই ঘণ্টা দেরিতে ছেড়ে যায়। সে সময় বিমানবন্দরে মশার ঘনত্ব পরীক্ষা করতে তার ডাক পড়ে।
রাতের বেলা মশা ধরতে গিয়ে তারা দেখতে পান যে বিমানবন্দরের ভেতরে উজ্জ্বল ও মৃদু আলোর মধ্যে এডিস মশা বিচরণ করছে। তারপরেই তিনি ঘোষণা দিয়েছেন যে এডিস মশা রাতেও কামড়ায়।
ঢাকায় আরো বিভিন্ন স্থানে তার পর্যবেক্ষণ অনুসারে, এডিস মশা উজ্জ্বল কিংবা মৃদু – সব ধরনের আলোতে সক্রিয় থাকে। তাই ঘর আলোকিত থাকলে রাতেও কামড়াতে পারে এই প্রজাতির মশা।
এ ব্যাপারে কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশা খুবই চতুর এবং যেকোনো পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এটি নিজেকে পরিবর্তন করে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সারা বিশ্বে আলোর দূষণ বেড়েছে। অর্থাৎ আলো যতটা ব্যবহার উচিত ছিল তার চেয়ে বেশি ব্যবহার হচ্ছে। এই আলোর দূষণের সাথে এডিস মশা খাপ খাইয়া নিয়েছে এবং রাতের বেলাও কামড়াচ্ছে।’
সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত নগরায়নের কারণ এই মশা তার আচরণ পরিবর্তন করে নিয়েছে বলে মনে করেন এই কীটতত্ত্ববিদ।
তাই বাস্তবতা হলো এডিস মশা থেকে বাঁচতে এখন দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টাই প্রয়োজনীয় সব ধরনের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে।
জনস্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব
আবার দিনের বেলায়ও অনেক জায়গা অন্ধকার হয়ে থাকে, এমন পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথেও এডিস মশা খাপ খাইয়ে তার অবস্থান টিকিয়ে রাখছে বলে জানান কবিরুল বাশার।
কখনো কখনো এমন তথ্যও প্রচার হয়েছে যে, এডিস মশা সূর্য ওঠার ৩-৪ ঘণ্টা পর এবং বিকেল থেকে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময়টায় বেশি সক্রিয় থাকে। ভর দুপুরের চেয়ে আলো-আঁধারি পছন্দ করে বেশি।
এসব ধারণাও ভুল বলে জানিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার। তিনি জানান, এডিস মশা দিনে-রাতে ২৪ ঘণ্টা অর্থাৎ ভর দুপুরে বা মধ্য রাতেও কামড়ায়।
সাধারণত সারা দেশে মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে এডিস মশার লার্ভা সৃষ্টি হয়। এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব বাড়ে। তবে এ বছর এডিস মশার ঘনত্ব কয়েক গুণ বেড়েছে সময়ের আগেই। এতে শঙ্কিত কীটতত্ত্ববিদরা।
এডিস মশার এই আচরণগত পরিবর্তনের কারণেই এটি সুপার পতঙ্গ এবং আগের চেয়ে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে, যা জনস্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
কবিরুল বাশার বলেন, ‘এডিস মশার কর্মকাণ্ড যদি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে আমরা শুধু ওই সময়টায় সতর্ক থাকলেই হতো। কিন্তু এখন ২৪ ঘণ্টাই সতর্ক থাকতে হচ্ছে, আমাদের ঝুঁকির পরিধি বেড়ে গেছে, প্রতিটা সময় এখন আমাদেরকে মশা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে, সাবধান থাকতে হচ্ছে।’
মানুষকে যেসব মশা কামড়ায় সেগুলো নারী মশা। এদের মধ্যে মা এডিস মশা সবচেয়ে বেপরোয়া থাকে বলে তিনি জানান।
‘মা মশা তার পরবর্তী প্রজন্মকে পৃথিবীতে আনা নিশ্চিত করার জন্য যেকোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে পারে। মা মশাকে প্রচুর রক্ত খেতে হয়। এ রক্ত খাওয়ার সুযোগ যদি সে দিনে না পায় তাহলে সে রাতেও খাবে,’ বলেন তিনি।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।