জুমবাংলা ডেস্ক : বয়কটের মুখে পড়ে বিক্রি কমে গেছে এক সময়ের জনপ্রিয় পানীয় কোকাকোলার। বাংলাদেশে কোকাকোলার পরিবর্তে মানুষ খুঁজে নিয়েছে বিভিন্ন পানীয়। এছাড়া গাজায় ইসরাইলের হামলাকে কেন্দ্র করে বয়কটের ডাকে বিখ্যাত ফাস্ট ফুড চেইন ম্যাকডোনাল্ডস এখন লোকসানের মুখে। বয়কটের প্রভাবে মরক্কোতে স্থায়ীভাবে বন্ধের কথা তুলেছে জনপ্রিয় অ্যামেরিকান চেইন কফিশপ স্টারবাকস।
ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোম্পানি ও পণ্য বয়কটের ঘোষণায় বিভিন্ন দেশে এমন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বা ব্রান্ড। শুধু ইসরাইল-ফিলিস্তিন ইস্যুতেই নয়, বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কারণে পণ্য বয়কটের ডাক আসে। তবে পণ্য বয়কটে আসলে কি লাভ বা ক্ষতি? এর প্রভাবটাই বা পড়ে কিসে?
বয়কট কী
কোনো পণ্য, ব্যক্তি, সংস্থা বা দেশকে রাজনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত যে কোনো কারণে বর্জন করা, স্বেচ্ছায় সেবা নেয়া বা পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকাটাই মূলত বয়কট। সোজা কথায়, কোনো এক ইস্যু নিয়ে বিরোধিতার কারণে নির্দিষ্ট কোনো পণ্য, মানুষ বা দেশকে বর্জন করা।
পণ্য বা যেকোনো কিছুই, বয়কট করা বা গ্রহণ করা একান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কেউ আপনাকে বয়কট বা গ্রহণ করার বিষয়ে কোনোরকম জোরাজোরি করতে পারবে না।
বয়কট করা কী সম্ভব?
পণ্য বয়কটের ডাক প্রায়শই দেখা যায়। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। মানুষ বিভিন্ন কারণে বয়কটের ডাক দিচ্ছে। ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামে বিভিন্ন হ্যাশট্যাগ ব্যবহার করছে। সবাইকে বয়কটের আহ্বান জানাচ্ছে। তবে কোন পণ্য, দেশ বা সংস্থাকে বয়কট করা কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেই পণ্য বয়কট করতে আগ্রহী তার বিকল্প ব্যবস্থা আছে কি-না দেখতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে চোখ বন্ধ করে সেই পণ্য বয়কট করা সম্ভব।।
তবে যদি বিকল্প ব্যবস্থা না থাকে, তাহলে মোটাদাগে বললে, বয়কট করা সম্ভব হবে না। যেমন কোকাকোলার পরিবর্তে বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য পানীয় পান করছে। বয়কট করা সম্ভব হচ্ছে, কারণ বিকল্পব্যবস্থা আছে। আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান করেছে ইসরাইলি মালিকানাধীন কোম্পানি — ফাইবার। ফ্রিল্যান্সাররা কি চাইলেই এখন বয়কটকে সমর্থন জানিয়ে ফাইবারে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারবেন? পারবেন না। কারণ এর বিকল্প বাংলাদেশে নেই, রাতারাতি তৈরি করাও সম্ভব হবে না।
আবার কোকাকোলা বয়কট করার জন্য কার্টুন ভর্তি কোকাকোলা কিনে মাটিতে ফেলে তা নষ্ট করলেও বয়কট হবে না। উল্টো কোকের কোম্পানিকে বেশি লাভ করিয়ে দেয়া হবে।
সমসাময়িক ঘটনা
ইসরাইলকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলতে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত কোম্পানি ও পণ্য বয়কটের ঘোষণা আসে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেই কোম্পানি বা ব্র্যান্ডগুলোকেও অনেকটাই ভুগতে হয় বয়কটের ফল। গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষে সমর্থনের কারণে বয়কটের মুখে পড়েছে ম্যাকডোনাল্ডস। এটা প্রভাব ফেলেছে কোম্পানিটির বৈশ্বিক বিক্রিতে। ব্যবসার সেই পতন ঠেকাতে ইসরাইলে থাকা ২২৫টি রেস্তোরাঁর সবই স্থানীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে ফের কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফাস্ট ফুড জায়ান্টটি।
গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষে সমর্থনের কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কুয়েত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানেও বয়কটের মুখে পড়ে ফাস্ট ফুড কোম্পানিটি। ম্যাকডোনাল্ডস ছাড়াও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি অন্যান্য পশ্চিমা ব্র্যান্ড যেমন — কেএফসি, স্টারবাকস ও ইউনিলিভারও। বয়কটের প্রভাবে মরক্কোতে স্থায়ীভাবে বন্ধের কথা তোলে জনপ্রিয় আমেরিকান চেইন কফিশপ স্টারবাকস।
ভারতীয় পণ্য বর্জন
সম্প্রতি ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক ওঠে বাংলাদেশে। পুরো বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকেন্দ্রিক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে #India Out #Boycott Indian products-এর ছড়াছড়ি দেখা যায়। তবে যার প্রভাব পড়েনি বাজারে। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্য বয়কটের ন্যূনতম প্রভাব পড়েনি ভারতে। ভারতের রফতানি যেমন কমেনি, তেমনই ভারতে বাংলাদেশি পর্যটকের ভিড়ও কমেনি। ঈদের আগে কলকাতার নিউমার্কেটে বাংলাদেশিদের উপচেপড়া ভিড় দেখা গেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যবসায়ীরা বলেছেন ব্যবসা আরও বেড়েছে।
লাভ-ক্ষতির হিসেব
যখন একটি দেশকে বয়কট করা হবে, তার মানে সেই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সব দিক দিয়ে শেষ করার কথা ভাবতে হবে। বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বয়কট করতে চায়, তবে আমদানি-রফতানির হিসেব বাদ দিলেও সে দেশে বাংলাদেশের কত সংখ্যক মানুষ কাজ করে তার সঙ্গে যুক্ত রেমিট্যান্স, বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কথা চিন্তা করতে হবে। যেমন — ইসরাইল শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে এত উন্নত যে, বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় প্রায় সবকিছুতেই ইসরাইলের শেয়ার আছে, যার মধ্যে অনেক কোম্পানি কিংবা ব্র্যান্ডের নাম আমরা জানি না, না জেনে ব্যবহার করছি।
একটা জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তা থেকে বিরত থাকা অসম্ভব। বিরত থাকলে পিছিয়ে পড়তে হবে প্রতিযোগিতার এ বিশ্বে। কারণ, ফাইবার ব্যবহার না করলে লস শুধু ইসরাইলের নয়, হাজার হাজার ব্যবহারকারীদেরও হবে।
প্রতিযোগিতা ও ভূরাজনীতির চালে বয়কট
কোনো দেশই শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যতটুকু তার নিজের, বাকিটুকু বাকি পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশেরও উল্লেখযোগ্য অংশ বাকি পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। তা বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে হোক অথবা আমাদের রফতানি পণ্যের জন্য বিদেশি বাজারে চাহিদা তৈরি করার মাধ্যমেই হোক।
যদি যেসব দেশে বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রফতানি করে, সেসব দেশ উলটো বাংলাদেশকে বয়কট করে বসেছে? এমন আঘাত এলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির কী অবস্থা হবে? এসব সংকট এড়াতেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতারা ভেবেচিন্তে ভূরাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি করছেন কিংবা পদক্ষেপ নিচ্ছেন।
ইতিহাস কী বলে?
২০০৫ সালে ডেনমার্কের দৈনিক পত্রিকা ‘ঈওলান্ত পস্টেন’-এ মহানবির কার্টুন প্রকাশের পর ডেনিশ পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়েছিল। যার প্রভাবে ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত দেশটির রফতানি সাড়ে ১৫ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ফরাসি পণ্য বয়কটের ডাক দেয়া হয়। ক্যাপিটাল হিলের রেস্তোরাগুলোতে ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের নাম বদলে রাখা হয় ফ্রিডম ফ্রাই।
এক গবেষণার বরাত দিয়ে জার্মানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলে জানায়, বয়কট ডাকের সেসময় ফরাসি ওয়াইনের সাপ্তাহিক বিক্রি ২৬ শতাংশ কমে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরাইলের আচরণের প্রতিবাদে ২০০৫ সালে বিডিএস নামে একটি মুভমেন্ট শুরু হয়। ২০১৫ সালে ইসরাইলে ফাঁস হওয়া এক নথি জানায়, দেশটির অর্থনীতিতে বিডিএসের আর্থিক প্রভাবের পরিমাণ বছরে ১৪০ কোটি ডলার।
বয়কটের মাধ্যমে মানুষ নির্দিষ্ট কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিদের মালিকদের যে বার্তা দিতে চায় তা দেয়া সম্ভব। বয়কটে সেই পণ্যের ব্যবসায় ধসও আনা সম্ভব। তবে তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।