আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ভারতে আট লেনের জাতীয় বা প্রাদেশিক মানের এক কিলোমিটার সড়ক নির্মাণে খরচ হয় প্রায় ১৫ লাখ ডলার। জেলা ও শহরাঞ্চলের জন্য দুই লেনের প্রতি কিলোমিটার সড়ক তৈরিতে ব্যয় হয় প্রায় ৬ লাখ ডলার। প্রান্তিক সড়কের ক্ষেত্রে প্রতি কিলোমিটারে নির্মাণ ব্যয় পড়ে প্রায় ৪ লাখ ডলার। সঠিক পরিকল্পনা, বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, দক্ষ জনশক্তি, নির্মাণ উপকরণ ও যন্ত্রপাতির সহজলভ্যতা, উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহারসহ নানাবিধ কারণে এশিয়াসহ পৃথিবীর অনেক দেশের চেয়ে কম খরচে সড়ক তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছে ভারত।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম সড়ক নেটওয়ার্কের দেশ ভারত। দেশটিতে বিদ্যমান সড়ক নেটওয়ার্কের দৈর্ঘ্য প্রায় ৫৯ লাখ কিলোমিটার। ন্যাশনাল হাইওয়ে অথরিটি অব ইন্ডিয়া (এনএইচএআই) পরিকল্পনা করছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আরো ২৫ হাজার কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের। এ হিসাবে দেশটিকে প্রতিদিন অন্তত ৫০ কিলোমিটার নতুন সড়ক তৈরি করতে হবে।
ব্যবসাবান্ধব কৌশলের অংশ হিসেবে বিদ্যমান নেটওয়ার্ককে আরো বিস্তৃত ও উন্নত করতে গুরুত্ব দিচ্ছে ভারত। দিল্লি-মুম্বাই, অমৃতসর-জামনগরের মধ্যে হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ এক্সপ্রেসওয়ে গড়ে তুলছে দেশটি। সাহারানপুর-দেরাদুনের মধ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে ২১০ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে। প্রতিটি রাজ্যেই সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে বিনিয়োগ করা হচ্ছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। ২০২৫ সালের মধ্যে নতুন ২৩টি জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণের লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে ভারত।
২০১৯-২০২৫ সালের মধ্যে জাতীয় অবকাঠামো উন্নয়নে ১ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে ভারত, এর ১৮ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে দেশটির সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়নে। ধারাবাহিক বিনিয়োগের ফলস্বরূপ ২০১৬ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ভারতে সড়ক নির্মাণ বেড়েছে ১৭ শতাংশ। ২০২১ সালে করোনা মহামারীর মধ্যেও ১৩ হাজার ২৯৮ কিলোমিটার সড়ক তৈরি করেছে দেশটি।
ভারত যেমন তাদের সড়ক নেটওয়ার্ককে বিস্তৃত, গতিশীল ও নিরাপদ হিসেবে গড়ে তোলার দিকে গুরুত্ব দিচ্ছে, একইভাবে সমান গুরুত্ব দিচ্ছে কম খরচে সড়ক নির্মাণেও। এ লক্ষ্যে দেশটি কৌশলগতভাবে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে নতুন প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনের মাধ্যমে নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনা। দেশটির সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা রেখে চলেছে।
ব্যয় কমাতে ভারতের উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে সড়ক নির্মাণে প্লাস্টিক বর্জ্যের ব্যবহার। মূলত বিটুমিনের সঙ্গে মিশিয়ে ব্যবহার করা হচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য। প্রতি কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের জন্য ৯ টন বিটুমিনের সঙ্গে ব্যবহার করা হচ্ছে ১ টন প্লাস্টিক বর্জ্য। এতে কিলোমিটারপ্রতি এক টন বিটুমিন সাশ্রয় হচ্ছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩০ হাজার রুপি। এরই মধ্যে প্রায় ১ লাখ কিলোমিটার সড়কে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবহার করেছে দেশটি, যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্যের কথা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির (আইআইটিএস) এমন নানা উদ্ভাবন ও প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে সড়কের নির্মাণ ব্যয় কমাতে উদ্যোগী হয়েছে ভারত। পাশাপাশি সড়ক নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনতে সঠিক পরিকল্পনা, স্বচ্ছতার সঙ্গে প্রকল্প বাস্তবায়ন ও দক্ষ জনবল গড়ে তোলার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছে দেশটি।
সড়কের নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনতে এসব উদ্যোগের পাশাপাশি স্থানীয় নির্মাণ উপকরণ, জনবল ও যন্ত্রাংশের দিক দিয়ে কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে ভারত। এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সড়ক নির্মাণে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন ব্যয় ভারতে। প্রতিবেদনে আটটি দেশের সড়ক নির্মাণ ব্যয় বিশ্লেষণ করা হয়। দেশগুলো হলো চীন, পাকিস্তান, রাশিয়া, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, তুরস্ক, ফিলিপাইন ও বাংলাদেশ। প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, এই আট দেশের মধ্যে সড়ক নির্মাণে সবচেয়ে কম ব্যয় ফিলিপাইনে। আর ভারতের অবস্থান দ্বিতীয়।
সংস্থাটির বিশ্লেষণ বলছে, ভারতে সড়ক নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত জনবলের পেছনে ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় কম। একইভাবে সড়ক নির্মাণের বিভিন্ন ধরনের উপকরণও সহজলভ্য। আবার নির্মাণকাজে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করতেও ভারতে অন্য দেশের তুলনায় কম খরচ হয়। মোটা দাগে এই তিনটি বিষয় দেশটির সড়কের নির্মাণ ব্যয় কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছে বলে উঠে এসেছে এআইআইবির প্রতিবেদনে।
এসব বিষয় ছাড়াও সঠিক পরিকল্পনা ও সড়কের নির্মাণকাজ বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা এবং বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো সামর্থ্যের সর্বোচ্চ নিয়োজিত করার ফল ভারত পাচ্ছে বলে মনে করেন যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, ‘ভারতসহ পৃথিবীর যেসব দেশে সড়কের নির্মাণ ব্যয় কম, সেসব দেশের প্রেক্ষাপট আমরা যদি বিশ্লেষণ করি তাহলে সবার আগে যে বিষয়টা চোখে পড়বে, তা হলো সঠিক পরিকল্পনা। তারা সময় নিয়ে সঠিকভাবে পরিকল্পনা করে। এরপর প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যায়। বাস্তবায়নে নজরদারি ঠিক থাকে। নির্মাণকাজে সম্পৃক্তদের জবাবদিহিও করতে হয়।’
‘আমাদের দেশে যেটা হয়, একটি সড়ক নির্মাণের পুরো দায়িত্বটিই ঠিকাদারকে দিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু ভারত এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তাদের সড়ক অবকাঠামো নির্মাণকারী সংস্থাগুলো নিজেরাই একটা বড় অংশের কাজ বাস্তবায়ন করে। ঠিকাদারের ওপর নির্ভরতা সেখানে তুলনামূলক কম। তাদের সংস্থাগুলোকে দক্ষ জনবল আর প্রয়োজনীয় উপকরণে সক্ষম করে গড়ে তোলা হয়েছে। ভারতে সড়কের নির্মাণ ব্যয় কম হওয়ার পেছনে এই বিষয়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।’—বলেন অধ্যাপক ড. সামছুল হক।
ভারতের ঠিক উল্টো অবস্থা বাংলাদেশের। বিশ্বব্যাংক বলছে, বাংলাদেশে সড়ক নির্মাণ সবচেয়ে ব্যয়বহুল। এখানে প্রতি কিলোমিটার চার বা ততোধিক লেনের সড়ক নির্মাণ করতে ২৫ লাখ থেকে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার পর্যন্ত ব্যয় হচ্ছে। নির্মাণ ব্যয় বেশি হওয়ার জন্য উচ্চমাত্রায় দুর্নীতি, সময়মতো কাজ শেষ না হওয়া এবং দরপত্র প্রক্রিয়ায় প্রতিযোগিতা না থাকাকে দায়ী করেছে বিশ্বব্যাংক।
সড়কের নির্মাণ ব্যয়ে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বড় পার্থক্যটি কোন জায়গায় তৈরি হচ্ছে, জানতে চাইলে সামছুল হক আরো বলেন, ‘বাংলাদেশ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বিদেশী ঋণে। দাতারা ঋণ দেয়ার সময় বিভিন্ন শর্ত জুড়ে দেয়। এমন শর্ত দেয়, যেন দাতা দেশগুলোর হাতে গোনা কিছু ঠিকাদার দরপত্রে অংশ নিতে পারে। গুটি কয়েক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটে বেড়ে যায় প্রকল্পের ব্যয়। এ বিষয়টিই বাংলাদেশ আর ভারতের সড়ক নির্মাণ ব্যয়ে বড় পার্থক্য তৈরি করে দিচ্ছে, কেননা ভারত নিজেদের পয়সায় বেশির ভাগ সড়ক তৈরি করছে। আর যেসব সড়ক তৈরিতে ঋণ নিচ্ছে, সেগুলোতে দাতাদের শর্ত দেয়ার সুযোগ সেভাবে দিচ্ছে না।’ বাংলাদেশে পরিকল্পনা পর্যায়ে বিদেশী পরামর্শক নির্ভরতা, আমদানিনির্ভর নির্মাণ উপকরণ, নির্মাণ যন্ত্র, ভূমি অধিগ্রহণ, পেশাদার জনবলের ঘাটতি ও অদক্ষতা, বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষগুলোর দায়িত্বে অবহেলা ও দুর্নীতি এবং সড়কের সঙ্গে সঙ্গে নানা ধরনের বিলাসী অবকাঠামো তৈরি করায় নির্মাণ ব্যয় বেশি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
ভারতে একটি আট লেনের মহাসড়ক তৈরি করতে কিলোমিটারপ্রতি খরচ হয় প্রায় ১৫ লাখ ডলার। বিশ্বব্যাংকের হিসাব বলছে, এর চেয়ে আট গুণ বেশি টাকা খরচ করে চার লেনের ‘ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা’ এক্সপ্রেসওয়ে তৈরি করেছে বাংলাদেশ। ৫৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ ব্যয় ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার। ২০১৭ সালে চালু হওয়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ২৫ লাখ ডলার। চলমান ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নির্মাণে প্রতি কিলোমিটারে খরচ হচ্ছে প্রায় ৭০ লাখ ডলার।
সড়ক নির্মাণে পৃথিবীর সবচেয়ে ব্যয়বহুল বাংলাদেশ। নির্মাণে বেশি ব্যয় করেও মানসম্মত সড়ক অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সূত্র : বণিক বার্তা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।