আল-আমীন দেওয়ান : দেশের সরকারি ডেটা-নথি দেশে নেই। কোনো এক ‘অদৃশ্য কারণে’ রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ এসব ডেটা দেশের বাইরে।আর এটি ঘটানো হয়েছে বেশ গোপনীয়তার সঙ্গেই। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে দেশের জাতীয় টায়ার ফোর ডেটা সেন্টারে কী এমন ঘটলো বা ঘটানো হলো যে, রাষ্ট্রীয় এমন ডেটা ওরাকলকে ডেকে এনে সিঙ্গাপুরে পাঠিয়ে দিতে হলো।
জাতীয় টায়ার ফোর ডেটা সেন্টারের ঘটনা আসছে পরের পর্বে, এ পর্বে ওরাকলের কেলেঙ্কারি।ঘটনার শুরু ২০২১ সালের শেষে। ওই বছরের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ডেটা সেন্টার কোম্পানি লিমিটেড (বিডিসিসিএল) হঠাৎ এক চুক্তি করে বসে ওরাকল সিঙ্গাপুরের সঙ্গে। বিডিসিসিএল ওরাকলের ডেডিকেটেড রিজিয়ন ক্লাউড কাস্টমার (ডিআরসিসি) প্রডাক্ট বা সেবা কিনবে।সেই অদৃশ্য কারণে এই কেনাকাটার চুক্তি হলে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে। প্রডাক্টটি কেনা হলো তিন বছরের জন্য ১৮ মিলিয়ন ডলারে।
এজন্য সার্ভারসহ প্রয়োজনীয় ইক্যুপমেন্ট ২০২২ সালের এপ্রিলের মধ্যে কালিয়াকৈরে হাইটেক পার্কের বিডিসিসিএলে বসানো হবে। কিন্তু মাস যায় ইক্যুপমেন্টের কিছুই আর বসে না। ওই সময় বিডিসিসিএলের এমডি হিসেবে এই চুক্তি করেন আবু সাঈদ চৌধুরী।এবার এটুআই তাদের ব্যবস্থাপনায় থাকা সরকারের ৩৪ হাজার দপ্তরের ডেটা, সরকারের নথি ব্যবস্থাপনার সব ডেটাসহ যাবতীয় সরকারি ডেটা বিডিসিসিএলের ফোর টায়ার ডেটা সেন্টারে যখন রাখতে গেলো বিডিসিসিএল এই ডেটা পাঠিয়ে দিল ওরাকলের ওসিআই সিঙ্গাপুরে।ব্যস ২০২২ সালের মে মাস হতে দেশের সব সরকারি ডেটা-নথি বিডিসিসিএলের নামকাওয়াস্তে চলে যেতে থাকলো সিঙ্গাপুরে। যার জন্য আলাদা করে বৈদেশিক মূদ্রায় বিল দিচ্ছিল বিডিসিসিএল। এটুআই বলছে তাদের ওই সময় বাধ্য করা হয়েছে। অনেকেই বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুললেও তা আমলে নেয়া হয়নি।
এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা বলছেন, সিঙ্গাপুরে ডেটা পাঠানোর বিষয়টি শুরু হয়েছে অনেক আগেই, ২০২২ এর দিকে। তখন আমি ছিলাম না। তবে এসে যতটুকু জেনেছি যে, তারা নির্দেশিত হয়েই ওখানে ডেটা ট্রান্সফারটা করেছে।‘এটুআই থেকে আমি যতটুকু শুনেছি যে তারা অনেক অপেক্ষা করেছে যে, এই ডেটাটা যখন ডিআরসিসি বাংলাদেশে হবে তখন যেন ডেটাটা নেয়া হয়। কিন্তু বারবার নির্দেশনার প্রেক্ষিতেই হয়তো মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে এটুআই সেটা করেছে তখন ‘ বলেন তিনি।
মো. মামুনুর রশীদ ভূঞা বলেন, ‘তবে আমরা বারবারই বলেছি যে, আমরা ডেটা সুরক্ষা করতে চাই। আমাদের তরফ থেকে আমাদের উচ্চারণ ছিল। আবার বিডিসিসিএল যে নিজে সুবিধাটা দেবে তারা তা দিতে পারছিল না।’তাহলে ১৬০০ কোটি টাকা দিয়ে এই জাতীয় ফোর টায়ার ডেটা সেন্টারে কী করা হলো যে, রাষ্ট্রের ডেটাই তারা রাখতে পারছেন না-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এই প্রশ্ন তারও।এটুআইপি পিডি বলেন, বিডিসিসিএল আমাদের ৩০০ কোটি টাকা বিল পাঠিয়েছে। এই টাকা এটুআই কোথা হতে দেবে ? ওরাকল যে বিল করে তারা বাজারে অন্যদের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি, এ বিষয়টিও এটুআই তুলেছে।চলছিল এমন, আবারও হঠাৎ করেই মাত্র কয়েকমাস আগে ২০২৪ সালের ৬ মে’তে বিডিসিসিএলের কেনা ওরাকলের ওই ‘ডেডিকেটেড রিজিয়ন ক্লাউড কাস্টমার (ডিআরসিসি)’ প্রডাক্টকে বাংলাদেশের ’বাংলাদেশ গভর্মেন্ট ক্লাউড’ ঘোষণা দেয়া হলো। এজন্য রাজধানীর এক অভিজাত হোটেলে করা হলো জাঁকজমক এক অনুষ্ঠান।
বিডিসিসিএলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, আসলে ২০২২ সালের এপ্রিলে যেসব ইক্যুপমেন্ট ওরাকলের বসানোর কথা ছিল হাইটেক পার্কের ডেটা সেন্টারে সেটা তখন বসানো হয়েছে।এরপর ২০২৪ সালের ৩০ মে বিডিসিসিএলের সেই সময়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আতাউর রহমান খান এটুআইয়ের প্রকল্প পরিচালককে চিঠি লিখে জানান যে, ওসিআই সিঙ্গাপুরে থাকা ডেটা এবার তারা বাংলাদেশে স্থাপিত ওরাকলের ডিআরসিসিতে নিয়ে আসবেন।আর সেই ডেটা এখনও স্থানান্তর শেষ হয়নি।
বিডিসিসিএল বলছে, ম্যাসিভ এই ডেটা নিয়ে আসতে ৬ মাসের মতো সময় লাগবে। তারা ধারণা করছেন অক্টোবরের মধ্যে এই স্থানন্তর শেষ হবে।প্রশ্ন, এরপর মাত্র তিন বছর পর এসব সরকারি এসব ডেটা কোথায় রাখা হবে ? ওরাকলের সঙ্গে চুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে না নতুন কোথাও নতুন কারও সঙ্গে চুক্তিতে। কারণ এখন পর্যন্ত নিজেদের জাতীয় ফোর টায়ার ডেটা সেন্টারে নিজেদের সক্ষমতায় ডেটা রাখার সম্ভাবনা দৃশ্যমান নয়।এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিডিসিসিএলের এমডি (অতিররিক্ত দায়িত্ব) ড. মুহম্মদ মেহেদী হাসান বলেন, তিনি সবে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি কিছুই জানেন না আর তিনি এখানে থাকবেনও না।যোগাযোগ করা হয়েছিল বিডিসিসিএলের পরিচালক মোঃ জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। যিনি ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের যুগ্ম-সচিব।
তিনি বলেন, তিনি মাত্র একটি বোর্ড মিটিংয়ে যোগ দিয়েছেন। বোর্ডের এজেন্ডাতে তো এসব থাকে না। তবে বিষয়গুলোতে তিনি আশংকা প্রকাশ করেন।আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে জানতে, বিডিসিসিএলের চেয়ারম্যান মো. শামসুল আরেফিন, পরিচালক ড. এসএম মাহবুবুর রহমান, সাবেক এমডি আবু সাঈদ চৌধুরী ও মো. আতাউর রহমান খানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে হলে তারা সাড়া দেননি।আর এসব নিয়ে ওরাকল বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুবাবা দৌলার যোগাযোগেও সাড়া মেলেনি।বিডিসিসিএলের ব্যবস্থাপক পর্যায়ের কর্মকর্তা বলছেন, সরকারের ১৬০০ কোটি টাকা লোনের টাকায় বানানো সরকারের নিজস্ব ক্লাওড সিস্টেমকে ডেভলপ না করে ওরাকলের সাথে ১৮ মিলিয়ন ডলারে তিন বছরের এই চুক্তিই তো বড় প্রশ্নের।-টেকশহর ডটকম
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।