জাহিদুর রহমান : ভাওয়াল বনে সেই ১৯৫৫ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈরের রামচন্দ্রপুর গ্রামের প্রবীণ বেলায়েত হোসেন পেয়েছিলেন ময়ূরের ডিম। সেই ডিম মুরগির তায়ে ফুটিয়ে দিয়েছিলন ময়ূরের প্রাণ, সেবা-যত্নে বড়ও করেছিলেন। ভাওয়াল বনে এখন ময়ূরের দেখা পাওয়া যেন ডুমুরের ফুল! ১৯৮৫ সালে এ বনে সবশেষ ময়ূর দেখেছিলেন বেলায়েত হোসেন। হরিণহাটি কালিয়াকৈরের মৌচাক ইউনিয়নের নামকরা গ্রাম।
হরিণের অবিরাম হাঁটাহাঁটির জন্যই গ্রামটির নাম হয়েছিল হরিণহাটি। হরিণ ও ময়ূরের পাশাপাশি একসময় এ বনে ছিল বাঘের গর্জনও। বাঘের স্মৃতি নিয়ে এখনও গাজীপুরের শ্রীপুরে দাঁড়িয়ে আছে ‘বাঘের বাজার’।
বন আর জীববৈচিত্র্য যখন হারিয়ে যাচ্ছিল তখন তা টিকিয়ে রাখতে গাজীপুরে ২০১০ সালে গড়ে তোলা হয় ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক’। তবে বন আর বনের প্রাণী তো বিপন্নই, উল্টো সাফারি পার্কের ভেতরে সুরক্ষিত থাকা জেব্রাসহ বহু প্রাণী একের পর এক মারা যাচ্ছে। বন বাঁচানো তো দূরের কথা, হাতের নাগালের প্রাণী টিকিয়ে রাখতেই সবাই এখন ব্যতিব্যস্ত।
কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্কেরও একই দুর্গতি। দুটি সাফারি পার্কের অবস্থা যখন কাহিল, তখন সংরক্ষিত বন মৌলভীবাজারের জুড়ীর লাঠিটিলায় বন বিভাগ গড়ে তুলছে আরেকটি সাফারি পার্ক। গত নভেম্বরে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটির অনুমোদন দেওয়া হয়। ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সাফারি পার্ক, মৌলভীবাজার (১ম পর্যায়)’ শীর্ষক প্রকল্পটির জন্য ৩৬৪ কোটি ১১ লাখ টাকা বরাদ্দ মিলেছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ভেঙে পাহাড় ও গাছ কেটে সাবেক পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিনের নিজের নির্বাচনী এলাকায় (বড়লেখা-জুড়ী) ৫ হাজার ৬৩১ একর জায়গাজুড়ে এ সাফারি পার্ক নির্মাণ হচ্ছে।
দেশের প্রাকৃতিক বন, বাস্তুতন্ত্র ও প্রাণ-প্রজাতির সুরক্ষা জোরদার ও নিরাপদ না করে একের পর এক এমন প্রকল্পের স্রোত বইছে। কখনও সমাজিক বনায়নের নামে বিদেশি গাছ রোপণ, কখনও টেকসই বন ও জীবিকা প্রকল্পের নামে প্রাকৃতিক বনের বদলে কৃত্রিম বন গড়ে তোলা হচ্ছে। আবার ভুল জায়গা নির্বাচনের কারণেও টিকছে না সরকারের বনায়ন প্রকল্প। ফলে বছর বছর কমছে বন। বনের প্রতি নির্ভর মানুষ হারাচ্ছে জীবিকা। গত ১৭ বছরে প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার বন হারিয়ে গেছে বলে রেইন ফরেস্ট ফাউন্ডেশন নরওয়ের (আরএফএন) সাম্প্রতিক এক গবেষণায় উঠে এসেছে। বন বিভাগই বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় যে কোনো দেশে ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। বাংলাদেশে আছে মাত্র ১৫ দশমিক ৫৮ শতাংশ। সোসাইটি ফর এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড হিউম্যান ডেভেলপমেন্টের (সেড) গবেষণা বলছে, মধুপুর গড়ে ১৯৮৯ সালে প্রাকৃতিক বনের পরিমাণ ছিল ৪৩ শতাংশ। ২০০৭ সালে তা নেমে আসে ২৯.৮ শতাংশে।
এ পটভূমিতে আজ নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বন দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘উদ্ভাবনায় বন, সম্ভাবনাময় বন’।
কিছু প্রকল্পের কারণে বনের ক্ষতি
জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্ট পার্টিসিপেটরি অ্যাফরেস্টেশন অ্যান্ড রিফরেস্টেশন প্রজেক্ট (সিআরপিএআরপি) নিয়েছিল সরকার। এতে দেশের উপকূলীয় অঞ্চলে জলবায়ুসহিষ্ণু প্রজাতি গাছ দিয়ে বনায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে এর সুফল মেলেনি। ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে নোয়াখালীর হাতিয়ার নিউ চর জোনাকে ৪০ হেক্টর জায়গায় বিভিন্ন জাতের চারা রোপণ করে বন বিভাগ। দ্বীপ উপজেলা সদর ওছখালীর ১০ হেক্টরেও মাউন্ড (স্তূপাকৃতির) বনায়ন করা হয়। একই সময় জাহাজমারা রেঞ্জের নিঝুমদ্বীপে ৮ হেক্টর এবং নলচিরা রেঞ্জে ১০ হেক্টরেও বনায়ন করা হয়। তবে মাটির লবণাক্ততায় একটি চারাও টেকেনি।
জলবায়ু প্রকল্পের টাকায় উপকূলীয় বন বিভাগে লাগানো হয়েছে আকাশমনি ও ইউক্যালিপটাস। এগুলো মাটির গুণ নষ্টের পাশাপাশি দেশীয় গাছেরও ক্ষতি করে। গত বছর বন অধিদপ্তরের টেকসই বন ও জীবিকা প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম দেশের জন্য ক্ষতিকর ১৭টি বিদেশি উদ্ভিদ প্রজাতিকে চিহ্নিত করেছে।
জলবায়ু তহবিলের অর্থায়নে উপকূলের বিস্তীর্ণ এলাকায় গাছ লাগানো হয়েছিল। তবে বন হয়ে ওঠার আগেই এলাকাটি বাংলাদেশ ইকোনমিক জোন অথরিটিকে (বেজা) হস্তান্তর করে বন বিভাগ। পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর প্রায় ৩ হাজার ৮০০ হেক্টর বন উজাড় হয়েছে তাতে। অথচ ওই বন সৃজনে খরচ হয়েছিল প্রায় ৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা।
এর আগে বিদেশি প্রজাতির গাছ দিয়ে সামাজিক বনায়নের শুরু ১৯৮৯-৯০ সালে। সামাজিক বনায়ন করতে গিয়ে নির্বিচারে কাটা হয়েছে শালকপিস ও অন্য দেশি প্রজাতির বৃক্ষ। প্রথম পর্যায়ে ব্যাপকভাবে ইউক্যালিপটাস লাগানো হয়েছিল। ব্যাপক সমালোচনার মধ্যে মধুপুরে দ্বিতীয় সামাজিক বনায়ন প্রকল্প ছিল ফরেস্ট্রি সেক্টর প্রজেক্ট। দ্বিতীয় পর্যায়ে সরকারি বনভূমিতে ইউক্যালিপটাস লাগানো বন্ধ হয়।
বন বিভাগের হিসাবে, ১৯৮১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১ লাখ ৫ হাজার ২৮৩.০৩ হেক্টর জমিতে ব্লক বা উডলট (জ্বালানি কাঠের বন) লাগানো হয়। টাঙ্গাইলের মধুপুর বনে এ কর্মসূচির মাধ্যমে লাগানো জলবায়ুর অনুপযোগী বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি গাছের কারণে হারিয়ে যাচ্ছে বনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। এক সময় প্রাকৃতিক শালবন ছিল এবং এখনও কাগজে-কলমে গেজেটভুক্ত বনভূমি। ১৯৯৫ সালে বন বিভাগ ও সরকারি অন্য সংস্থা বনাঞ্চলে ইউক্যালিপটাস গাছ লাগানো নিষিদ্ধের পক্ষে মত দেয়।
বন সম্প্রসারণ কার্যক্রম ও স্থানীয় দরিদ্র জনগণকে আর্থিকভাবে উপকৃত করতে ষাট দশকের শুরুর দিকে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি শুরু হয়। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী নামে আরেকটি সামাজিক বনায়ন প্রকল্পে ১৯৯৪-৯৫ সালে যুক্ত হয় এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক। ২০১০ সালের ১১ আগস্ট সামাজিক বনায়নের অগ্রগতিবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ইউক্যালিপটাস ও আকাশমণি নিয়ে বলেছিলেন, ‘এত দিন বিদেশি দাতা সংস্থার পরামর্শে সামাজিক বনায়নের নামে এ ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। এ গাছের নিচে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না, এমনকি পাখিও বসে না। আকাশমণি গাছের রেণু নিঃশ্বাসের সঙ্গে শরীরে গেলে অ্যাজমা হয়।’
২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি বন অধিদপ্তরের টেকসই বন ও জীবিকা বা সাসটেইনেবল ফরেস্ট অ্যান্ড লাইভলিহুড (সুফল) প্রকল্প শুরু হয়। ১ হাজার ৫০২ কোটি টাকার এ প্রকল্পে সরকার ৩২ কোটি ৭২ লাখ টাকা অর্থায়ন করছে। বাকি টাকা ঋণ দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক। এর আওতায় আছে পাঁচটি বনাঞ্চল এবং আট বিভাগের ২৮ জেলার ১৬৫ উপজেলার ৬০০ গ্রাম। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) প্রতিবেদনে সুফল প্রকল্পের বিষয়ে বলা হয়েছে, ৭১ শতাংশ গাছ লাগানো হলেও এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য শর্তগুলো মানা হয়নি। শর্ত ছিল– শাল, গর্জন, সোনালু, লটকন, নাগেশ্বর, বন আমড়া, খাড়াজোড়া, গামার, নেওড়, কুম্ভি কানাইডাঙ্গা, জলপাই, কদম, জামসহ বিভিন্ন গাছের চারা লাগাতে হবে। তবে লাগানো হয়েছে অন্য গাছ। তা ছাড়া এসব গাছের চারার ৪০ শতাংশও প্রথম বছরেই মারা গেছে।
এদিকে পরিবেশ-প্রতিবেশ সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ না নিয়েই কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক প্রশস্তকরণ প্রকল্প এলাকার বিদ্যমান গাছ কাটার নির্দেশ দিয়েছে বন বিভাগ। কক্সবাজার, ধোয়াপালং ও ইনানি রেঞ্জ কর্মকর্তাদের গত ১০ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগ এ নির্দেশ দেয়।
২০২০ সালে সুন্দরবনের ভেতরে ২৪ কোটি ৯৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ‘সুন্দরবনে পরিবেশবান্ধব পর্যটন (ইকো ট্যুরিজম) সুবিধা সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন’ নামে প্রকল্প হাতে নেয় বন বিভাগ। এখন ইকো ট্যুরিজমের নামে বনের ভেতরে হয়েছে কংক্রিটের স্থাপনা। স্থায়ী স্থাপনাগুলো দীর্ঘ মেয়াদে বন্যপ্রাণী ও বনের প্রতিবেশ-পরিবেশের ক্ষতির কারণ হবে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বন বিভাগ সামাজিক বনায়ন করে অথচ বন আইনে ভিলেজ ফরেস্ট করার কথা। তারা ভিলেজ ফরেস্টের বিধিমালা করে না। সামাজিক বনায়ন করলে বন বিভাগ যাবতীয় নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে রাখতে পারে। আর ভিলেজ ফরেস্ট করলে সব নিয়ন্ত্রণ থাকবে কমিউনিটিতে। বন বিভাগ কমিউনিটিকে নিয়ন্ত্রণ দিতে মোটেই আগ্রহী নয়। কারণ সেখানে তার যে অবৈধ লাভের হিসাব আছে, তাতে গরমিল লেগে যাবে। তিনি বলেন, বন বিভাগকে তার ক্ষমতা ছাড়তে হবে। কৃষি মন্ত্রণালয় ধান লাগায় না, মৎস্য মন্ত্রণালয় মাছ চাষ করে না। তাহলে বন বিভাগকে কেন গাছ লাগাতে হবে। বন বিভাগকে সেখান থেকে সরে এসে আইনের ২৮ ধারার আলোকে বননির্ভর জনগোষ্ঠীর হাতে ব্যবস্থাপনা ছেড়ে দিতে হবে।
পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, বনায়ন ও মানুষের জীবিকা টেকসই করতেই প্রকল্প নেওয়া হয়। বনভূমিকে সংরক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে বনের পরিধি আরও বাড়ানো হচ্ছে। বন অধিদপ্তর সারাদেশের সামাজিক বনায়নের মাধ্যমে স্থানীয় জনগণকে উপকারভোগী হিসেবে সম্পৃক্ত করে সড়ক, রেল, বাঁধের পাশে ও প্রান্তিক ভূমিতে ব্যাপক বনায়নের মাধ্যমে বৃক্ষ আচ্ছাদিত ভূমির পরিমাণ বাড়াচ্ছে। ফলে প্রকল্পের সুফল নেই, এ কথা বলা যাবে না। সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।