জাহিদ ইকবাল : বাংলাদেশে অনলাইন সাংবাদিকতা গত এক দশকে যে অগ্নিগর্ভ গতিতে বিস্তার লাভ করেছে, তা দেশের গণমাধ্যম ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। প্রযুক্তির উন্নয়ন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসার এবং উচ্চগতির ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সংবাদ পরিবেশকে এমন এক পর্যায়ে নিয়ে এসেছে, যেখানে তথ্য তৈরি, গ্রহণ এবং বিতরণের প্রক্রিয়াই সম্পূর্ণ বদলে গেছে।

বিটিআরসির ২০২৫ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যা প্রায় ১৪ কোটির বেশি, যার মধ্যে ৯৭ শতাংশ ব্যবহার করছে স্মার্টফোন। এই বিপুল ডিজিটাল জনসংখ্যা সংবাদপাঠের পদ্ধতিকে একেবারে নতুনভাবে রূপান্তরিত করেছে। আগের দিনে পাঠককে সংবাদপত্র খুঁজে নিতে হতো; আজ সংবাদই পাঠকের কাছে চলে আসে—ফেসবুক নিউজফিড, ইউটিউব শর্টস, অনলাইন নিউজপোর্টাল, মেসেঞ্জার নোটিফিকেশন বা সার্চ ইঞ্জিনের অ্যালগরিদমের মাধ্যমে।
অনলাইন সাংবাদিকতা কেবল গতিবেগ বাড়ায়নি, এটি পাঠকের মনস্তত্ত্ব, সাংবাদিকতার নীতি এবং সামাজিক তথ্যগ্রহণের পদ্ধতিতেও গভীর পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশের প্রায় ৩,৮০০ অনলাইন নিউজ পোর্টাল প্রতিদিন সক্রিয়ভাবে সংবাদ প্রকাশ করছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার অন্য কোনো দেশের তুলনায় অনন্য। গবেষণা দেখিয়েছে, এই পোর্টালের ৬৫ শতাংশের স্থায়ী নিউজরুম নেই, এবং প্রায় ৪০ শতাংশ সাংবাদিক ও সম্পাদক প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই ছাড়া সংবাদ পরিবেশন করছেন। ফলে ভুয়া খবরের বিস্তার বেড়েছে। MIT-এর ২০১৮ সালের গবেষণা অনুযায়ী, ভুল তথ্য সত্যের তুলনায় ছড়াতে ছয়গুণ দ্রুত। বাংলাদেশে রাজনৈতিক বা সামাজিক সংঘর্ষের সময় এই হার দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়।
অনলাইন সাংবাদিকতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো বিশ্বাসযোগ্যতা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সংবাদ গ্রহণকারীর সংখ্যা যেমন বেড়েছে, তেমনি সন্দেহ ও বিভ্রান্তির মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির ২০২৪ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের পাঠকের ৫৭ শতাংশ সংবাদ দেখার পরও তার সত্যতা নিয়ে সন্দিহান থাকে। হার্ভার্ডের Nieman Lab অনুসন্ধান বলছে, মানুষের গড় মনোযোগ সময় এখন ৮–১২ সেকেন্ড, অর্থাৎ সংবাদ যত ছোট, পাঠক গ্রহণ করবে বেশি, কিন্তু বিশ্লেষণমূলক গভীরতা কমছে। এই ‘সংক্ষিপ্ততা–অভ্যাস’ পাঠকের বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা ও তথ্য যাচাইয়ের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করছে। অন্যদিকে অ্যালগরিদম সাংবাদিকতার পরিসরকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকের অ্যালগরিদম যেসব কনটেন্ট বেশি এনগেজমেন্ট বা আবেগ জাগায়, তা দ্রুত ছড়ায়। MIT, BBC এবং ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যালগরিদমের কারণে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ অনেক সময় চোখের আড়াল হয়ে যায়। মানুষ ক্রমশ এমন ‘ইকো চেম্বার’-এ আটকে যায়, যেখানে তার কাছে কেবল সেই সংবাদই আসে যা তার পূর্বধারণার সঙ্গে মেলে। এতে তথ্যবৈচিত্র্য, বিপরীত মতাদর্শ এবং সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ প্রবেশের সুযোগ প্রায় শূন্যে নেমে আসে। ফলে সমাজে বিভাজন বাড়ে এবং অপতথ্য ও গুজব প্রবাহ সহজ হয়।
পাঠকের ভূমিকাও আজ সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আগে পাঠক ছিল নিষ্ক্রিয় গ্রহণকারী; আজ সে সংবাদের উৎস, সমালোচক এবং সক্রিয় অংশগ্রহণকারী। মাঠ থেকে সরাসরি ছবি-ভিডিও পাঠিয়ে সাধারণ মানুষ সংবাদ উৎপাদনের অংশ হয়ে উঠছে। ২০২৫ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে আপলোড হয়, যার উল্লেখযোগ্য অংশ সংবাদ দাবিতে ছড়ায়। কিন্তু এই কনটেন্টের ৮০ শতাংশে থাকে যাচাইহীন তথ্য বা অভিমুখভ্রান্ত উপাদান। এই প্রক্রিয়ার ফলে সাংবাদিকতা ও প্রোপাগান্ডার মধ্যে পার্থক্য অস্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
চিনির সঙ্গে রং মিশিয়ে তৈরি হচ্ছিল খেজুর গুড়, ৫ কারখানায় অভিযান
ভুয়া খবর, গুজব, এবং বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণ। আবেগপ্রবণ সংবাদ বেশি ক্লিক আনে, যার মাধ্যমে বিজ্ঞাপন, ট্রাফিক এবং আয় বৃদ্ধি পায়। ব্রিটিশ রয়্যাল সোসাইটির গবেষণা অনুযায়ী, অ্যালগরিদম-নিয়ন্ত্রিত নিউজ প্ল্যাটফর্মে ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে আবেগ উসকে দেওয়া কনটেন্ট বেশি জনপ্রিয় হয়। এ কারণে, সত্যকে চাপা দিয়ে প্রায়শই ক্লিকবেইট শিরোনাম, বিভ্রান্তিকর গল্প এবং সেনসেশনাল কনটেন্ট ছড়ায়। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি আরও জটিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা, নির্বাচনী প্রচারণা বা জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সংকটের সময় ভুয়া তথ্যের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ICFJ-এর ২০২৪ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, রাজনৈতিক বা ধর্মীয় বিষয়ক গুজব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ৪৫–৫০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে জনগণ বিভ্রান্ত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভ্রান্ত পথে চলে। এটি গণতন্ত্রের মৌলিক ভিত্তি, স্বাধীন মত প্রকাশ এবং সামাজিক…
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



