আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের শুরু থেকেই আবারও স্নায়ু যুদ্ধের সমসাময়িক সময়ের মতো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের ক্ষমতা বলয়। একদিকে মার্কিন মদদপুষ্ট পশ্চিমারা। অন্যদিকে আছে রাশিয়া-চীন বলয়। সেই সাথে ডলারের বদলে নিজস্ব মুদ্রা মানে রুপি-রুবলে বিনিময় করার পথে হেঁটেছে ভারতের মতো বড় অর্থনীতির দেশও।
চীনও ব্যাপকহারে অন্যদের সাথে নিজস্ব মুদ্রায় ব্যবসা বাণিজ্য করার পথ ধরেছে এই সুযোগে। সৌদি আরবের মতো মধ্যপ্রাচ্যের আমেরিকা ঘনিষ্ঠ দেশগুলোও এখন ঢুকে পড়ছে চীন-রাশিয়ার নিজস্ব মুদ্রা থিওরিতে। ফলে ডলারের একক আধিপত্যের বিশ্বে খানিকটা ধাক্কা লেগেছে।
এশিয়ান টাইমসের এক প্রবন্ধেও সেই আলাপই করেছেন ব্লুমবার্গের কলামিস্ট ও টোকিও ভিত্তিক সাংবাদিক উইলিয়াম পেসেক। তিনি বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রা মজুদে মার্কিন ডলারের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে কমাচ্ছে চীন। বিপরীতে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্যেও দেদারছে ব্যবহার করছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান। ফলে অনেক অর্থনীতিবিদই ডলারের আধিপত্য ক্রমাগত কমছে কিনা সেই প্রশ্নই তুলছেন।
তবে এরপরও অনেকেই ডলারকে এখনও বেশ মহিমান্বিত মনে করছেন। তারা এখনও এই মার্কিন মুদ্রা ব্যবস্থায় বিশ্বাস রাখার পক্ষেই মত দিয়েছেন। তারা চীন-রাশিয়ার এমন কাণ্ডে হুমকির কিছু দেখছেন না। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যান তাদের একজন। নিউ ইয়র্ক টাইমসের এই কলামিস্ট মনে করছেন, ‘ডলারের আধিপত্য তেমন কোনো হুমকির মুখে নেই’।
পল তার সময়ের অর্থনীতিবিদদের মধ্যে বেশ প্রভাবশালী এটা অনেকেই মানবেন। তবে ডলারের আধিপত্যের বিষয়ে অন্য কেউ তার মতো এতোটা নিশ্চিত হতে পারছেন না। এর অবশ্য কারণও আছে, এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ চীন নিজেদের সম্পদের ভাণ্ডারে ডলারের পরিমাণ কমাচ্ছে। গত জানুয়ারিতে টানা ছয় মাসের মতো এটা কমিয়েছে বেইজিং। অবশ্য, এই তথ্য শুধু জানুয়ারি পর্যন্তই প্রকাশ করা হয়েছে। পরের দুই মাসের তথ্য এখনো অপ্রকাশিত। সেখানেও একই চিত্র দেখা দিতে যেতে পারে।
চলতি সপ্তাহেই খবর জানা গেল যে, গেল ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে প্রথমবারের ইউয়ানের আধিপত্য লক্ষ করা গেছে। অর্থাৎ, সিংহভাগ লেনদেন ডলার বা ইউরোতে হয়নি, সেই সোনালি সিংহাসনে বসেছে ইউয়ান। অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি দু’দিক থেকেই এটি অনেক বড় ঘটনা। এতে প্রথমত ইউয়ানের ওপর রাশিয়ানদের আস্থার বিষয়টি উঠে এসেছে। আর দ্বিতীয়ত বিশ্বের বৃহৎ দুটি দেশের এই সিদ্ধান্ত মুদ্রা বাজারের গতিপ্রকৃতিই বদলে দিতে চলেছে। আর এই কাণ্ডেই বিশ্ববাণিজ্যে প্রধান মুদ্রা হওয়ার দৌড়ে আরো এক ধাপ এগিয়ে গেল ইউয়ান। গত মার্চ মাসে মস্কো এক্সচেঞ্জে ইউয়ানে লেনদেরে পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
ইউয়ানের এমন এবং ডলারের দুর্মতিতে তাত্ত্বিক আলোচনায় যোগ হয়ে নতুন মাত্রা। অনেকেই মনে করছেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকটকালে ‘ডলারকে আর্থিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা এবং বৈশ্বিক মূল্য পরিশোধ ব্যবস্থাকে (রাজনৈতিক) ইচ্ছানুসারে নিয়ন্ত্রিত করার উদ্যোগের’ ফলেই হিতে বিপরীত হয়েছে।
রাশিয়া-চীনকে জোটবদ্ধ হয়ে বিপাকে ফেলতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র নিজেদেরই বিপদ বাড়িয়েছে। খোদ যুক্তরাষ্ট্রেই ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। তার সঙ্গে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারির পর থেকে আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিশৃঙ্খলা এবং জাতীয় দেনার সীমা অতিক্রমের ঘটনাগুলোও দেশটির ঋণমানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
আরেক প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ এল-এরিয়ান অবশ্য মনে করছেন, প্রধান সমস্যা হলো মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা ফেডারেল রিজার্ভে। ফেড এক্ষেত্রে শুধু অর্থনৈতিক পটভূমিতে ব্যর্থ তাই-ই নয়; একইসঙ্গে বিশ্বের অন্যান্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আস্থাও হারাচ্ছে, যে ভরসাকে ফেড তার চিরন্তন অধিকার বলে বিবেচনা করেছে। ফলে ধরেই নিয়েছিল, ডলার অনন্তকাল বিকল্প অন্যান্য মুদ্রার চেয়ে আকর্ষণীয় থাকবে।
আলিয়াঞ্জের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এল-এরিয়ান বলেছেন, ‘ফেডের সমস্যা সবার জন্য উদ্বেগেরই হওয়ার কথা। বিশ্বাসযোগ্যতা হারানোর ফলে আর্থিক স্থিতিশীলতা এবং বাজার পরিচালনার ক্ষেত্রে ফেডের সক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে একইসঙ্গে মূল্য স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং যথাসম্ভব সর্বোচ্চ কর্মসংস্থান সৃষ্টির যে ম্যান্ডেট তাদের রয়েছে সেখানেও এই প্রভাব পড়বে’।
২০২১ সালেই রেখাচিত্রে মূল্যস্ফীতির উত্থান ঠেকানোর দিক থেকে পিছিয়ে পড়ে ফেড। অবশ্য তারপর থেকে মুদ্রা প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণের আগ্রাসী পদক্ষেপ নিয়েছে। ১৯৯০ এর দশকের পর এবারই এতটা চড়াভাবে সুদহার বাড়াচ্ছে ফেড, এতে অনেক ব্যাংক সংকটের খাঁদের কিনারে পৌঁছে গেছে।
সূত্র: এশিয়া টাইমস
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।