আন্তর্জাতিক ডেস্ক : ইসলামিক স্টাইলের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখা চীনের সর্বশেষ প্রধান মসজিদটি তার গম্বুজ হারিয়েছে। আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে এর মিনারগুলোতে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে দেশটির মুসলমানদের উপাসনালয়গুলোকে চাইনিজ স্টাইলে করার জন্য একটি সরকারি প্রচারণা সমাপ্ত হলো। চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় ইউনান প্রদেশের ছোট্ট শহরের সবচেয়ে বড় ও জাঁকজমকপূর্ণ মসজিদ শাদিয়ানের গ্র্যান্ড মসজিদ।
গত বছর পর্যন্ত ২১ হাজার বর্গমিটারের মসজিদ ভবনটির মাথায় টাইলসের সবুজ গম্বুজ ছিল। একটি অর্ধচন্দ্র, চারটি ছোট গম্বুজ ও উঁচু মিনারের সমন্বয়ে সজ্জিত ছিল এটি। ২০২২ সালের স্যাটেলাইট চিত্রেও দেখা যায়, মসজিদের প্রবেশপথটি উজ্জ্বল কালো টাইলস দিয়ে তৈরি একটি বড় অর্ধচন্দ্র এবং তারা দিয়ে সজ্জিত।
অথচ এ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণে দেখা যায়, মসজিদের গম্বুজটি সরানো হয়েছে এবং হান চীনা স্টাইলের প্যাগোডার ছাদ দিয়ে তা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মিনারগুলো ছোট করে প্যাগোডা টাওয়ারে রূপান্তরিত করা হয়েছে। কেবল অর্ধচন্দ্র এবং তারা টাইলসের একটি ক্ষীণ চিহ্ন দৃশ্যমান রয়েছে, যা একসময় মসজিদের সামনের ছাদকে চিহ্নিত করেছিল।
শাদিয়ান থেকে ১০০ মাইলের কম দূরত্বে অবস্থিত ইউনানের আরেক ঐতিহাসিক মসজিদ নাজিয়াং-এও সম্প্রতি সংস্কারের মাধ্যমে ইসলামিক বৈশিষ্ট্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়েছে।
২০১৮ সালে চীন সরকার ‘ইসলামের সিনিফিকেশন’ নিয়ে পাঁচ বছর মেয়াদি একটি পরিকল্পনা প্রকাশ করে। পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল ‘বিদেশি স্থাপত্যশৈলী’ প্রতিরোধ করা এবং ইসলামী স্থাপত্যগুলো চীনা বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ করা। চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ফাঁস হওয়া একটি মেমোতে দেখা গেছে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে ‘আরও ভেঙে ফেলার এবং কম নির্মাণের নীতি মেনে চলার’ নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃতত্ত্ববিদ রুসলান ইউসুপভ বলেন, এই বড় দুটি মসজিদ চীনা ‘ইসলামের সিনিফিকেশন’ অভিযানের সাফল্যকে নির্দেশ করে। গ্রামে থাকা আরব রীতির ছোট ছোট মসজিদ অবশিষ্ট থাকলেও স্থানীয় সম্প্রদায়ের পক্ষে সিনিকাইজেশনের বিরোধিতা করা কঠিন হবে।
চীনের প্লাইমাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী ইতিহাসের শিক্ষক ও ইতিহাসবিদ হান্নাহ থেকার বলেন, মসজিদ সিনিকাজেশন অভিযান ‘প্রদেশ বাই প্রদেশ’ এগিয়ে গেছে। বেইজিংয়ের অন্যতম দূরবর্তী প্রদেশ ইউনানকে সর্বশেষ সিনিকাজেশন অভিযান চালানো হয়েছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক চীনা হুই কর্মী মা জু বলেন, চীনা সরকারের এই সংস্কার ‘ধর্ম ও জাতিসত্তা ধ্বংস করার একটি স্পষ্ট বার্তা’।
মিং রাজবংশের সময় একটি বিদ্রোহে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় শাদিয়ানের গ্র্যান্ড মসজিদটি ধ্বংস হয়ে যায়। পরবর্তীতে পিপলস লিবারেশন আর্মি এই অঞ্চলে হুই মুসলমানদের বিদ্রোহ দমন করে। সে সময় এক হাজারেরও বেশি মানুষ নিহত হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরে সরকারি সহায়তায় গ্র্যান্ড মসজিদটি পুনর্নির্মাণ ও সম্প্রসারণ করা হয়।
সৌদি আরবের মদিনায় অবস্থিত মসজিদে নববীর মতো করে শাদিয়ানের গ্র্যান্ড মসজিদটির নকশা করে তৈরি করা হয়েছিল। এটিতে তিনটি প্রার্থনা কক্ষ এবং ১০ হাজার মুসল্লির ধারণক্ষমতা রয়েছে।
হুই একটি চীনা মুসলিম জাতিগত সংখ্যালঘু, যাদের বেশিরভাগই পশ্চিম চীনে বাস করে। ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুসারে ১ কোটি ১০ লাখেরও বেশি হুই মানুষ আছেন, যা উইঘুরদের সমান জনগোষ্ঠী।
মসজিদগুলোর পুনঃনির্মাণের বিরোধিতাকারী একজন হুই মুসলিম বলেন, শাদিয়ান মসজিদ শুধু সাদিয়ান নয়, সব মুসলমানের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা একটা বড় ক্ষতি।
চীন ছেড়ে চলে যাওয়া এক মুসলিম ব্যক্তি নিজের নিরাপত্তার ভয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, আমরা কেবল আমাদের শেষ মর্যাদাটুকু রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কারণ, শাদিয়ান ও নাজিয়াইং ছাড়া দেশের প্রতিটি মসজিদকে নতুন করে সাজানো হয়েছে।
স্থাপত্যশৈলীর পাশাপাশি গ্র্যান্ড মসজিদে আনা আরেকটি পরিবর্তন হলো, ভবনের সামনের অংশে সোনার প্রলেপযুক্ত আরবি লেখার নিচে নতুন করে ‘চীনা অক্ষর’ যুক্ত করা হয়েছে। চীনা লেখাটি হলো: ‘সর্বোচ্চ সত্যের রাজকীয় প্রাসাদ’- যা একটি তাওবাদী শব্দ। এর আগে লেখাটি সাদিয়ানের মসজিদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল না।
ধর্ম নিয়ে লেখা বই ‘দ্য সোলস অব চায়না’র লেখক ইয়ান জনসন বলেন, এই মসজিদের দুঃখজনক ইতিহাস- বিশেষ করে হান উগ্র জাতীয়তাবাদের কবলে পড়ে ধ্বংস হয়েছিল। এখন নতুন করে মসজিদটির পুনর্গঠন ও পুনঃনামকরণ স্থানীয় জনগণের বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য মুছে ফেলার আরেকটি প্রচেষ্টা।
২০১৪ সালে চীন সরকার উইঘুরদের বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ অভিযান শুরু করে, যারা মূলত জিনজিয়াংয়ের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বাস করে। নীতিগুলোর মধ্যে নিপীড়নমূলক নজরদারি ব্যবস্থা এবং ইসলামী বিশ্বাসের বিস্তৃত প্রকাশের জন্য কঠোর শাস্তি অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই অভিযানের ফলে শেষ পর্যন্ত প্রায় এক মিলিয়ন উইঘুর এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু বিচারবহির্ভূত আটক বা বন্দির শিকার হয়। জাতিসংঘ সে সময় বলেছিল, এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হতে পারে। চীন সরকার চরমপন্থা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় বলে তার নীতির পক্ষে সাফাই গেয়েছে।
আর ২০১৮ সাল থেকে ইসলামি স্থাপত্যের ওপর আনুষ্ঠানিকভাবে চীন সরকারের অভিযানের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। গত বছর ফিন্যান্সিয়াল টাইমসে প্রকাশিত এক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে চীনজুড়ে ২ হাজার ৩০০টি মসজিদের তিন-চতুর্থাংশ পরিবর্তন বা ধ্বংস করা হয়েছে। গত বছর নাজিয়াইং মসজিদে পরিকল্পিত সংস্কারের প্রতিবাদে শত শত পুলিশ বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। অবশেষে বিক্ষোভ দমন করা হয় এবং সংস্কার কাজ এগিয়ে যায়।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।