আব্দুল্লাহ কাফি : মালয়েশিয়ার শ্রমবাজারে বাংলাদেশি কর্মী পাঠানোর জন্য দুদেশের মধ্যকার চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে আজ ৩১ মে। সময় বৃদ্ধি করতে দেশটির সরকারকে সম্প্রতি ঢাকার পক্ষ থেকে চিঠি দেওয়া হলেও কুয়ালালামপুরের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত কোনো জবাব আসেনি। ফলে সে দেশে গমনে প্রস্তুত ৪০ হাজার কর্মীর ভাগ্য অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে; চাহিদাপত্র থাকা সত্ত্বেও চুক্তির মেয়াদ পেরিয়ে যাচ্ছে, অথচ তারা সে দেশে যেতে পারছেন না।
সংশ্লিষ্টদের মতে, এ পরিস্থিতি সৃষ্টির নেপথ্যে দায়ী বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপনের নেতৃত্বাধীন একটি চক্র। চক্রটি ভুয়া কোম্পানি খুলে, প্রয়োজনের অতিরিক্ত চাহিদা দেখিয়ে চাহিদাপত্র তৈরি করে। এর ফলে ইতোমধ্যেই মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত চাহিদার অতিরিক্ত কর্মীরা কর্ম না পেয়ে যারপরনাই বিপাকে পড়েছেন।
জানা গেছে, বেস্টিনেট নামে একটি কোম্পানির যৌথ মালিকানা রয়েছে মালয়েশিয়ান ব্যবসায়ী দাতো শ্রী আমিন এবং বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রুহুল আমিন স্বপনের। তাদেরই আইটি প্রতিষ্ঠান এফডব্লিউসিএমএস। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিতর্কিত বেস্টিনেট কোম্পানির মালিকানাধীন এফডব্লিউসিএমএস প্রযুক্তির মাধ্যমে কর্মী পাঠানোর খেসারত দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। শুরু থেকেই বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ীই এ প্রযুক্তি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছেন। এরপরও দুদেশের চুক্তিতে পদ্ধতিটি অনুমোদন পায়। এর ফলে একটি অশুভ চক্রের অপতৎপরতা শুরু হয়। এর জেরেই ৪০ হাজার কর্মীর ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
জানা গেছে, এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতি ব্যবহার করে রুহুল আমিন স্বপন ও সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপি, এমনকি সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কিছু ব্যক্তির চক্র ১৪ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা অসহায় মানুষদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছে।
ভুক্তভোগীরা এখন মালয়েশিয়ায় কাজ পাচ্ছে না। এ থেকে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রীর আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা। চক্রের সঙ্গে কারা জড়িত, তদন্তের মাধ্যমে তাদেরও শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন তারা। তাদের ভাষ্য, শুরু থেকেই বলা হয়েছিল, বিশে^র অন্য ১৪টি দেশ থেকে মালয়েশিয়া যে পদ্ধতিতে কর্মী নেয়, বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও যেন সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু বৈধ সব এজেন্সিকে সুযোগ না দিয়ে ২৫-৩০ জনের একটি সিন্ডিকেট তৈরি করে তাদের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় কর্মী নেওয়া হয়েছে। এমন সিন্ডিকেটেরই মাশুল আজকের এই পরিণতি।
জানা গেছে, রুহুল আমিন স্বপনের চক্র নানা অজুহাতে কর্মীপ্রতি ৩ লাখ ৬২ হাজার ৫শ টাকা নিয়েছে। এর বাইরেও কর্মীপ্রতি চাহিদাপত্র বিক্রি করেছে ১ লাখ ৬২ হাজার টাকায়। উপরন্তু মাথাপিছু ৪০ হাজার ৫শ টাকা নিয়েছে অনুমোদনের বিপরীতে। মোটা টাকা হাতিয়ে নিয়ে চক্রটি এখন কর্মীদের কাজ দিতে পারছে না।
বাংলাদেশের সঙ্গেও অন্যান্য দেশের মতো চুক্তি কেন হলো না? এমন প্রশ্নে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলেন, দুষ্টু চক্রটি অত্যন্ত কৌশলে চুক্তির মধ্যে এমন সব শর্তজুড়ে দিয়েছে যে, এক্ষেত্রে মালয়েশিয়া এককভাবেই সিদ্ধান্ত নিতে পারবে এবং তাদের পছন্দের প্রতিষ্ঠানকেই কাজ দিতে পারবে। এমন একপক্ষীয় সিদ্ধান্ত ঢাকার পক্ষ থেকে মেনে নেওয়ার কারণেই এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে দুদেশের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলে ঢাকার কী করণীয়? এমন প্রশ্নে প্রবাসীকল্যাণ ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী গতকাল মুঠোফোনে বলেন, চুক্তির মেয়াদ বাড়াতে মালয়েশিয়ার সরকারকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এখনো এর জবাব আসেনি। তাই কিছু বলা যাচ্ছে না।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক এবং রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) চেয়ারপারসন ড. তাসনীম সিদ্দিকী গতকাল বলেন, আমরা সবাই বলেছিলাম, কর্মী প্রেরণে সিন্ডিকেট হলে বিপদ আসবে। কেউ শোনেনি। এখন সত্যিই বিপদ নেমে এসেছে। নেপালসহ অন্য ১৪টি দেশের সঙ্গে মালয়েশিয়া এমন চুক্তি না করলেও বাংলাদেশের সঙ্গে করতে পেরেছে। অথচ অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রে কর্মী প্রেরণ অনেকটাই উন্মুক্ত রয়েছে। সেসব দেশে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বৈধ রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে কর্মী পাঠানোর সুযোগ দেওয়া হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই উল্টোটা ঘটেছে। এর পরিণাম ভোগ করতে হচ্ছে বিদেশে গমনেচ্ছু সাধারণ অসহায় মানুষদের।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) সাবেক মহাসচিব শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান বলেন, বাংলাদেশকে এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতির খেসারত দিতে হচ্ছে। কিছু মানুষের কারণে পুরো জনশক্তি রপ্তানি খাতই এখন হুমকির মুখে। তিনি বলেন, নেপালসহ বিশে^র অন্য দেশগুলো যেভাবে মালয়েশিয়ায় কর্মী প্রেরণ করেছে, আমরাও তো একই পদ্ধতির দাবি জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমাদের দাবি না শুনে সিন্ডিকেটকেই অনুমোদন দেওয়া হলো। এর ফলে লাইসেন্সধারী শত শত এজেন্সি কর্মী পাঠানোর সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে। বাজার হারিয়েছে সুষম প্রতিযোগিতা। মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের কাছে জিম্মি হয়েছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। এফডব্লিউসিএমএস পদ্ধতি থেকে বাংলাদেশকে সরে আসতে হবে। নয়তো দুর্দশা কাটবে না।
বাংলাদেশে নিযুক্ত মালয়েশিয়ার হাইকমিশনার হানজা মোহাম্মদ হাশিম গত বুধবার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৫টি দেশ থেকে কর্মী সংগ্রহ করে মালয়েশিয়া। এসব দেশ থেকে আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ের ভালো কর্মী নিয়ে থাকি। এক্ষেত্রে সিন্ডিকেট থাকতে পারে, যা দুদেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। একটি বিষয় ওপেন সিক্রেট যে, মালয়েশিয়ায় প্রচুর অবৈধ লোকজন বসবাস করছে। তাই মালয়েশিয়া সরকার দেশের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থথে এবং কর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বিদেশি কর্মী সংক্রান্ত রিক্যালিব্রেশন কর্মসূচি নতুনভাবে সাজাচ্ছে। সূত্র : আমাদের সময়
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।