মুফতি আশরাফ জিয়া : মানুষ মাত্রই ভুল। বুঝে না বুঝে কখনো অজান্তেই আমরা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ি। মুমিন ব্যক্তির জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। শয়তানের প্ররোচনায় পড়ে পরহেজগার মুমিনও কখনো পাপে লিপ্ত হতে পারে। জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আল্লাহ তাআলার আদেশ-নিষেধ লঙ্ঘন করে বসতে পারে।আল্লাহ তাআলার মর্জি মোতাবেক চলার ক্ষেত্রে ভুল করতে পারে।
কিন্তু বুদ্ধিমান মুমেন কখনোই তার ভুলের উপর অবিচল থাকে না। আল্লাহ তায়ালা মোমেনদেরকে তাদের ভুল থেকে ফিরে আসার জন্য তওবার ব্যবস্থা করেছেন। যেন তওবার পথ ধরে মোমেন ব্যক্তি তৎক্ষণাৎ আল্লাহর পথে ফিরে আসে। শুধু গোনাহের মার্জনাই নয় তওবার মধ্যে রয়েছে দুনিয়াবী বিবিধ কল্যাণ।
তওবা ও ইস্তেগফার নবীদের সুন্নত
নবী-রসুলগণ নিজেরা আপন রবের কাছে তওবা ও ইস্তেগফার করেছেন, এবং উম্মতকেও তওবা ও ইস্তেগফার করতে আদেশ করেছেন। তাওবা-ইস্তেগফার শিক্ষা দিয়েছেন। তবে নবী-রাসুলগণের তাওবা-ইস্তিগফার ও উম্মতের তওবা ইস্তিগফারের মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। নবী-রসুলগণ হলেন নিষ্পাপ। তাদেরকে আল্লাহ গুনাহ থেকে রক্ষা করেন। তাঁদের তওবা ও ইস্তেগফার হয়ে থাকে কেবলমাত্র নিজেদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য।
পবিত্র কোরআন শরিফের বিভিন্ন জায়গায় আল্লাহ তাআলা নবীদের তওবার কথা উল্লেখ করেছেন। সুরা আরাফের ২১ নং আয়াতে হজরত আদম আলাইহিস সালামের তওবার কথা, সূরা নূহ এর ২২ নং আয়াতে হজরত নূহ আলাইহিস সালামের তওবার ঘটনা ও সুরা কাসাসের ২৪ নং আয়াতে হজরত মূসা আলাইহিস সালামের তওবার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। নবীদের সর্দার হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দিনে একশত বার তওবা করতেন।
হজরত আগার ইবনে ইয়াসার আলমুজানি রা. বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, হে লোকসকল! তোমরা আল্লাহর কাছে তওবা কর। কেননা আমি দিনে একশত বার তওবা করি। (সহিহ মুসলিম ২৭০২) তওবা ও ইস্তিগফার মোমেন ও মুত্তাকি বান্দাদের এক বিশেষ গুণ।
পবিত্র কোরআন শরিফে বিভিন্ন জায়গায় মোমেনদের বিভিন্ন গুণাবলীর কথা উল্লেখ করেছেন। এরমধ্যে বিশেষ একটি গুণ হলো, তওবা ও ইসতেগফার। আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেছেন, এবং তারা সেই সকল লোক, যারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে বা (অন্য কোনোভাবে) নিজেদের প্রতি জুলুম করলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহকে স্মরণ করে এবং তার ফলে নিজেদের গুনাহের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে আর আল্লাহ ছাড়া কেইবা আছে, যে গুনাহ ক্ষমা করতে পারে। আর তারা জেনেশুনে তাদের কৃতকর্মে অবিচল থাকে না। (সুরা আলে ইমরান : ১৩৫)
তওবা ও ইসতেগফার করলে আল্লাহ তাআলার ক্ষমা ও দয়া লাভ হয়
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা ইসতেগফারের সাথে নিজের দয়া ও ক্ষমাকে যুক্ত করেছেন। এবং নিজের বান্দাকে নিজের মমতার কথা স্মরণ করিয়েছেন। তিনি এরশাদ করেন, আর তোমরা আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ বড় ক্ষমাশীল ও অতি দয়ালু। (সুরা বাকারা ১৯৯) তিনি আরও বলেন, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তাঁর কাছে ফিরে আস। নিশ্চয়ই আমার রব অতি দয়ালু ও অধিক মমতাময়। (সুরা হুদ ৯০) তওবা ও ইসতেগফারকারীদেরকে আল্লাহর পক্ষ থেকে শাস্তি দেওয়া হয় না। তওবা ইসতেগফারকারীরা আল্লাহর ক্রোধ ও শাস্তি থেকে বেঁচে থাকে। আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে আজাব দেন না।
আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, আপনি তাদের মাঝে থাকা অবস্থায় কিছুতেই আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। আর তারা ক্ষমা প্রার্থনা করা অবস্থায়ও তাদেরকে শাস্তি দেবেন না। (সুরা আনফাল ৩৩) তওবা ও ইস্তিগফার মুমিনের পার্থিব নিয়ামত ও শক্তি সামর্থ্য সমৃদ্ধ করে।
আমরা মাঝেমধ্যেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিভিন্ন সমস্যায় ভুগতে হয়। কখনো অনাবৃষ্টি কখনো অতিবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হয়ে যায়। অনেকেই নিঃসন্তান হয়ে দুঃখের জীবন কাটিয়ে দেয়। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে এশকাল সমস্যার সমাধান হিসেবে তওবার কথা উল্লেখ করেছেন। কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
আমি বললাম, তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাশীল। তাহলে তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। আর তিনি তোমাদেরকে সম্পদ ও সন্তানাদি বৃদ্ধি করে দেবেন। তিনি তোমাদের জন্য বিভিন্ন উদ্যান ও নদ-নদী সৃষ্টি করে দেবেন। (সুরা নূহ : ১০-১২)
অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে, হে আমার সম্প্রদায়! তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। অতঃপর তার কাছে তওবা কর। তিনি তোমাদের প্রতি মুষলধারে বৃষ্টি প্রেরণ করবেন। তোমাদের শক্তিকে আরও বাড়িয়ে দেবেন। আর তোমরা অপরাধী হয়ে মুখ ফিরিয়ে নিও না। (সুরা হুদ ৫২) তওবা করলে চিন্তা পেরেশানি, বিপদ-সংকট থেকে মুক্তি ও রিজিক বৃদ্ধি হয়।
বর্তমান সময়ে বেশিরভাগ মানুষ ডিপ্রেশনে ভুগছে। অনেকে এটা থেকে বাঁচতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। অনেকে বিপদ-সংকটে অতিশয় দুর্বল হয়ে পড়ে। খাদ্য কষ্টে পোহাতে থাকা লোকের সংখ্যাও আমাদের সমাজে নেহায়েত কম নয়। অথচ আল্লাহ তাআলা এই সকল সমস্যা থেকে উত্তরণের পথ রেখেছেন তওবার মধ্যে।
হাদিসে এসেছে, নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বেশি বেশি ইস্তিগফার করবে আল্লাহ তাআলা তার সকল সংকট থেকে উত্তরণের ব্যবস্থা করে দেন, তার সকল পেরেশানি দূর করে দেন এবং তাকে এমন জায়গা থেকে রিজিক দান করেন, যা সে কল্পনাও করতে পারে না। (সুনানে আবু দাউদ : ১৫১৮) এভাবে কুরআন মাজিদে ও হাদিস শরীফের বিভিন্ন জায়গায় তওবা ও ইসতেগফারের অনেক ফায়দা ও উপকারের কথা তুলে ধরা হয়েছে।
আল্লাহ তাআলার ক্ষমা, অনুগ্রহ এবং উভয় জাহানের সকল ক্ষেত্রে তাঁর সাহায্য লাভ করার জন্য আমাদের জন্য তওবা ও ইস্তিগফারের বিকল্প নেই। তওবা ও ইস্তিগফারের মাধ্যমে একজন মোমেনের পার্থিব জীবন সুন্দর ও সুখময় হয়ে উঠে এবং আখেরাতে সে রবের সন্তুষ্টি এবং অনাবিল শান্তি লাভ করে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে গুনামুক্ত জীবন দান করুন এবং আমাদেরকে সকল গুনাহ থেকে তওবা করার তৌফিক দান করুন।
লেখক: শিক্ষক, আল আবরার ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।