মো. হাসান-উল-বারী : ইন্টারনেট-আসক্তি বলতে বোঝায় স্কুল-কলেজের ক্লাস, প্রাইভেট টিউশন, পড়াশোনায় ফাঁকি দিয়ে, বই পড়ার নেশাকে ‘গুড বাই’ জানিয়ে, বাড়ির অন্যান্য কাজে অনীহা দেখিয়ে দিন-রাত শুধুই ইন্টারনেটে ডুবে থাকা। অনলাইন গেম, চ্যাটিং, টিকটক, ইউটিউব, জুয়া বা পর্নোগ্রাফিক সাইটগুলিতে আকণ্ঠ ডুবে থাকা। অল্প বয়সি ছেলেদের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলপড়ুয়া মেয়েরাও একই ভাবে আসক্ত হয়ে পড়ছে ইন্টারনেটে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। বর্তমান যুগে সবাই কোনো না কোনোভাবে নানা প্রয়োজনে ইন্টারনেট ব্যবহার করি। কিন্তু আমরা হয়তো-বা বুঝতেই পারি না, ইন্টারনেট ব্যবহার করা কেবল আমাদের অভ্যাসই নয়, ধীরে ধীরে এটি আসক্তিতে পরিণত হচ্ছে। এই আসক্তির কারণেই আমরা সারা বিশ্বের মানুষের মধ্যে মানসিক ব্যাধির অত্যধিক বৃদ্ধি লক্ষ করছি। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক নির্ভরতা, যা জীবনের বিভিন্ন ক্রিয়াকলাপের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শুধু ইন্টারনেট-আসক্তি নয়, ইন্টারনেট গেমিং ডিসঅর্ডার (আইজিডি) আমাদের মনস্তাত্ত্বিক ক্রিয়াকলাপের ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শুধু তা-ই নয়, শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিঃসঙ্গতা-একাকিত্বের অনুভূতিও আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাচ্ছে। কম্পিউটার অ্যাসিস্টেড লার্নিং জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা-প্রতিবেদনে এমন তথ্যই উঠে এসেছে।
যুক্তরাজ্যের সোয়ানসি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ফিল রিড বলেন, যেসব শিক্ষার্থীর মধ্যে ইন্টারনেট ব্যবহারের অতিরিক্ত নেশা আছে, তারা পড়াশোনায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছেন। ইন্টারনেট আসক্ত শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্সও খুবই দুর্বল। একাডেমিক ফলাফল বিবেচনায় দেখা যায়, ইন্টারনেট আসক্তরা শিক্ষাগত যোগ্যতার মানে পিছিয়ে থাকছেন। গবেষণায় ২৮৫ জন বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্ট কোর্সের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছেন। গবেষণা-প্রতিবেদন তৈরিতে তাদের ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার, অধ্যয়নের দক্ষতা, পড়াশোনার আগ্রহ, উদ্বেগ ও একাকিত্বসহ আরো কিছু বিষয় মূল্যায়ন করা হয়েছিল। পরিশেষে দেখা যায়, অতিরিক্ত ইন্টারনেটের আসক্তি পড়ুয়াদের পড়াশোনা বিমুখ করে তুলছে। পড়াশোনার প্রতি শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও দক্ষতা দুটোই কমিয়ে দিচ্ছে। গবেষণাটিতে অংশ নেওয়া ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী চার ঘণ্টার বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। বাকিরা এক থেকে তিন ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিলেন। জরিপে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের ৪০ শতাংশ জানায় তারা বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার সাইট ব্যবহার করতেন। এছাড়া ৩০ শতাংশ জানায় তারা বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য জানতে ইন্টারনেট ব্যবহার করেছেন।
বিশ্বব্যাপী শিক্ষার মান খারাপ হওয়ার জন্য শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট-আসক্তিকে দায়ী করেছেন গবেষকরা। তাদের দাবি, ইন্টারনেট-আসক্তি শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় অনীহার প্রধান কারণ। এর ফলে বাড়ছে একাকিত্ব, যা হতাশাগ্রস্ত করছে শিক্ষার্থীদের। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক শিক্ষার ওপর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ডয়চেভেলেকে বলেন, ‘আমাদের তরুণদের ব্যস্ত রাখার মতো কোনো ব্যবস্থা আমরা রাখছি না। বিনোদন বা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটানোরও এখন তেমন সুযোগ নেই। ঢাকা শহরে খেলার মাঠ নেই, ফলে তরুণরা ইন্টারনেটে সময় কাটাচ্ছে। এটা একসময় তাদের মধ্যে আসক্তি তৈরি করে। তারা বাস্তব দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা হয়ে উঠছে। এতে তাদের মানসিক এবং শারীরিক দুই ধরনের সমস্যাই হচ্ছে।’
গত কয়েক বছর আগে, চীনের উয়ানে চাইনিজ একাডেমি অব সায়েন্সের অধ্যাপক হাও লেইর তত্ত্বাবধানে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণা দলটি মোট ৩৫ জন তরুণ-তরুণী যাদের বয়স ১৪ থেকে ২১ বছরের মধ্যে তাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করেছেন। এদের মধ্যে ১৭ জনের মধ্যে ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডার (আইএডি) ধরা পড়েছে। আর এটা বুঝতে তাদের বেশ কিছু সরল প্রশ্ন করা হয়, যার উত্তর হ্যাঁ অথবা না-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। যেমন তাদের জিগ্যেস করা হয়, আপনি কি ইন্টারনেট ব্যবহারকালে, মাঝপথে উঠে আসতে বা নিজেকে একেবারে বিরত রাখার চেষ্টায় প্রায়শই ব্যর্থ হন? এছাড়াও বিশেষায়িত এমআরআই ব্রেইন স্ক্যানে দেখা গেছে, তাদের মস্তিষ্কের সাদা অংশে পরিবর্তন হয়েছে। ঐ অংশটিতে যে স্নায়ুতন্ত্র রয়েছে, সেগুলোই ইন্টারনেট আসক্তির বৈশিষ্ট্য নির্দেশ করছে। স্বাভাবিক মস্তিষ্কে এমনটি থাকে না। মস্তিষ্কের যে অংশটি আবেগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত, সেই অংশের সঙ্গে স্নায়ুতন্ত্রের যোগাযোগে একটা বিঘ্ন ঘটার প্রমাণ পাওয়া গেছে। ড. হাও লেই ও তার সহকর্মীরা বিজ্ঞান সাময়িকী প্লোস ওয়ানে লেখেন, ‘সর্বোপরি আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, আইএডি আক্রান্ত মস্তিষ্কে কিছু অংশে অস্বাভাবিক সাদা অংশ রয়েছে। মস্তিষ্কের ঐ অংশটিই মানুষের আবেগ উত্পাদন ও প্রক্রিয়াকরণ, কোনো কিছুতে মনঃসংযোগ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং জীবনবোধ-সম্পর্কিত নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে জড়িত।’
সুতরাং এটি খুবই স্পষ্ট যে, ইন্টারনেট-আসক্তিতে শিক্ষার্থীরা এত বেশি বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে যে, অধিকাংশই এখন নানাবিধ মানসিক-শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। আমরা যদি আমাদের চারপাশে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে, প্রায় সব শিক্ষার্থীই তাদের ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছে বা সেটি নিয়েই তারা বেশি ব্যস্ত থাকছে। এতে বোঝা যায় যে, তাদের অধিকাংশই ইন্টারনেট অ্যাডিকশন ডিসঅর্ডারে ভুগছে। ইন্টারনেট-নির্ভর লেখাপড়ার অজুহাতে শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ চিত্তবিনোদনের উদ্দেশ্যে ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। দেশে বিনোদনের ক্ষেত্রগুলো সংকীর্ণ থাকায় পর্নো দেখা, অনলাইনে গেম খেলা, অনলাইনে জুয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও দেখার কাজে শিক্ষার্থীদের একটা বড় অংশ যুক্ত থাকছে। এর ফলে পড়াশোনায় যেমন নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তেমনি সামাজিক সম্পর্কেও পিছিয়ে পড়ছে তারা।
তাই ইন্টারনেটের প্রতি শিশু-কিশোরদের আসক্তি কমাতে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন শহরে চালু করা হয়েছে ক্লিনিক ফর ইন্টারনেট গেমিং অ্যান্ড মিডিয়া অ্যাডিকশন সেন্টার। এ বছরই কলকাতার ইনস্টিটিউট অব নিউরোসাইন্সে এই ক্লিনিক চালু হয়েছে। সেখানকার চিকিত্সকরা জানিয়েছেন, শিশুদের মধ্যে মোবাইল ফোন ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে, যার ফলে পড়াশোনায় খারাপ ফল এবং শারীরিক ও মানসিক অসুস্থতা বাড়ছে। সেই সমস্যার সমাধানে এই ক্লিনিক খোলা হয়েছে। যদিও মোবাইল-আসক্তির জন্য বাবা-মাকে দায়ী করেছেন চিকিত্সকরা। চিকিত্সকদের মতে, শিশুকে ভোলানোর জন্য অল্প বয়সে তাদের হাতে মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন অভিভাবকরা। ফলে বাড়ির খুদে সদস্য মোবাইলে আসক্ত হয়ে পড়ছে। পড়াশোনায় খারাপ ফল তো বটেই, বন্ধুদের সঙ্গেও মাঠে খেলাধুলা করছে না। মাঠে খেলাধুলার অভাবে শিশুদের শারীরিক সমস্যাও বাড়ছে। এই অবস্থায় চিকিত্সকরা জানাচ্ছেন, প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময় পর্যন্তই শিশুদের মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া উচিত। সেক্ষেত্রে দুই বছরের শিশুকে মোবাইল ফোন দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। শুধু অভিভাবক থাকলে সেক্ষেত্রে খুব অল্প সময়ের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া যায়। দুই থেকে আট বছরের শিশুদের ক্ষেত্রে ইউটিউবে বিনোদন ভিডিও দেখতে দেওয়া একেবারেই উচিত নয়। তবে শিক্ষামূলক কারণে তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে পারে, তবুও এক ঘণ্টার বেশি নয়। বিনোদনের কারণে একেবারেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে দেওয়া যাবে না শিশুদের।
সুতরাং আমাদের মনে রাখতে হবে, ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই যে শিক্ষার্থীরা খারাপ হয়ে যাবে, তা কিন্তু নয় । এর জন্য দরকার ইন্টারনেট লিটারেসি। এটা পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র সবার দায়িত্ব। আরেকটি বিষয় আমাদের খেয়াল রাখতে হবে যে, আমরা ডিজিটাল যুগে বাস করছি এবং আমরা প্রযুক্তি দ্বারা বেষ্টিত। শিক্ষার্থীদের ইন্টারনেট-আসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে কিংবা এর অধিক ব্যবহার রোধ করতে অভিভাবক ও শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। পরিশেষে, ইন্টারনেট-আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত কাউন্সেলিং, জনসচেতনতা, প্রচার-প্রচারণা, ইচ্ছাশক্তি, চেষ্টা ও পারস্পরিক সহযোগিতা। ইন্টারনেট আমাদের সার্বিক জীবনে অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হোক—এটাই আমাদের সবার প্রত্যাশা।
লেখক: শিক্ষক
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।