আন্তর্জাতিক ডেস্ক : রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক মেরুকরণ, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের অঘোষিত বাণিজ্যিক যুদ্ধ, দেশে দেশে চলমান মূল্যস্ফীতি এবং আগামীর জলবায়ু সংকটের পূর্বাভাসের প্রভাব পড়েছে বিশ্ব ব্যাংকিং খাতে। এসবের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিন বিশ্বসেরা ব্যাংকের তালিকা প্রকাশ করেছে।
সম্প্রতি গ্লোবাল উইনার্সের বরাত দিয়ে গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে খাতভিত্তিক সেরা ব্যাংকগুলোর একটি তালিকা প্রকাশ করা হয়।
এতে বলা হয়, চলতি বছর মার্চে সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার পর অনেকেই ভেবেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং খাতে বড় রকমের ধস নামতে পারে। তবে সব আশঙ্কা উড়িয়ে দিয়ে ২০২৩ সালে সেরা ব্যাংকের তালিকায় প্রায় প্রতিটি খাতে ভালো ফল করে জায়গা করে নিয়েছে ব্যাংক অব আমেরিকা।
এ ব্যাপারে ব্যাংক অব আমেরিকার আন্তর্জাতিক পরিচালন এবং প্রযুক্তি প্রধান অ্যান্ড্রু ম্যাককিবেন বলেন, একটি ব্যাংক যদি ব্যাংক, গ্রাহক এবং বাজারের মধ্যে সমন্বয় সাধন করতে পারে, তাহলে তার ভালো কর্মক্ষমতা প্রমাণ করা কঠিন কিছু নয়। ব্যাংক অব আমেরিকা ঠিক এই কাজটিই করেছে।
নিজেদের ভালো ফলের সূত্র উল্লেখ করে ব্যাংকটির সিইও ব্রায়ান ময়নিহান বলেন, এটি এক বছরের কর্মের ফসল নয়। ২০১৪ সাল থেকে একটি সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে হয়েছে। বিশেষ করে, করোনা-পরবর্তী সময়ে ব্যাংকের কার্যক্রম আগের গতিতে ফিরিয়ে আনা বড় রকমের একটি চ্যালেঞ্জ ছিল।
ব্যাংকের ব্যয়ের খাতগুলোকে চিহ্নিত করা এবং আয়ের ওপর জোর দেয়ার মাধ্যমে ব্যাংক অব আমেরিকা আজ এ অবস্থানে এসে পৌঁছেছে বলে মন্তব্য করেন ময়নিহান।
তিনি জানান, বর্তমানে তার ব্যাংক ২০৫০ সালকে লক্ষ্য ধরে জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগের দিকে জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে, নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের মাধ্যমে আগামী ২৬ বছরের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ শূন্যে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে ব্যাংক অব আমেরিকা।
সামগ্রিকভাবে সেরা ব্যাংকের তালিকায় ব্যাংক অব আমেরিকার পরে সেরা করপোরেট ব্যাংকের খেতাব পেয়েছে স্পেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম ব্যাংক বিবিভিএ করপোরেট অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক। বিগত এক বছর ব্যবসা খাতের জন্য সংকটময় সময় গেলেও, এ সময় সুদহার এবং ঋণের সামঞ্জস্যতা বজায় রেখে ভালো মুনাফার মুখ দেখেছে স্পেনের এই ব্যাংকটি।
ব্যাংকটির আন্তর্জাতিক গ্রাহকসেবার প্রধান হোসে র্যামন ভিজমানোস বলেন, করপোরেট ব্যাংকের মূলশক্তি তার গ্রাহকদের কাছে পৌঁছানো এবং ঋণ কার্যক্রম সমানতালে বজায় রাখা। এ চেষ্টা অব্যাহত রেখে ২০২২ সালে বিবিভিএ ৫০ বিলিয়ন ইউরো মুনাফা করতে সক্ষম হয়েছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৪১ শতাংশ বেশি। ২০২৫ সালকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে ব্যাংকটি প্রযুক্তি এবং জলবায়ু খাতে বিনিয়োগ আরও বৃদ্ধির কথা ভাবছে।
এদিকে গ্রাহকসেবার ওপর ভিত্তি করে সেরা ব্যাংকের তালিকায় উঠে এসেছে ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক অব সিঙ্গাপুরের (ডিবিএস) নাম। শুধু উন্নত গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করেই ২০২২ সালে ব্যাংকটি ৮ দশমিক ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছে, যা ২০২১ সালের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি।
ব্যাংকটির উচ্চপদস্থ নির্বাহী কর্মকর্তা সি জি কুন বলেন, গ্রাহকসেবা প্রযুক্তি নির্ভর করার কারণে এ ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ বেড়েছে। এ ছাড়া সঞ্চয়ের ওপর সর্বোচ্চ সুদহার থাকায় ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের আগ্রহ আগের থেকে অনেক বেশি বেড়েছে।
উঠতি বাজার উন্নয়নে সেরা ব্যাংকের তালিকায় আছে যুক্তরাজ্যভিত্তিক এইচএসবিসি ব্যাংক। দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, লাতিন আমেরিকার মতো উঠতি বাজারে নিজেদের কর্মদক্ষতার প্রমাণ দিয়ে সেরাদের তালিকায় স্থান পেয়েছে ব্যাংকটি। বিশেষ করে, এশিয়ার বিশাল ভোক্তা বাজারে নানা খাতে বিনিয়োগ করে গত বছর বড় রকমের লভ্যাংশ তুলে নিয়েছে এইচএসবিসি ব্যাংক। ২০২২ সালে ব্যাংকটির মোট আয়ের ৫৬ শতাংশই এসেছে এশিয়ার বাজার থেকে।
স্বল্পোন্নত দেশে ক্ষুদ্রঋণের ওপর ভিত্তি করে সেরা ব্যাংকের তকমা পেয়েছে ফ্রান্সের তৃতীয় বৃহতম সোসাইটি জেনারেল ব্যাংক। বর্তমানে ‘আফ্রিকার উন্নয়ন-২০২৫’ প্রকল্প নিয়ে কাজ করা ব্যাংকটি আফ্রিকা মহাদেশের ১৯টি দেশের অধিবাসীদের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প, কৃষি বাণিজ্য, খাতভিত্তিক বিনিয়োগ এবং নবায়নযোগ্য বিনিয়োগ নিয়ে কাজ করছে।
মূলত ফ্রান্সের এজেন্সি ফ্রান্সিস অব ডেভেলপমেন্টের (এএফডি) সঙ্গে যৌথভাবে ব্যাংকটি বিগত দশ বছরে ১ হাজার ২৫০টি আফ্রিকান ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের মাধ্যমে নিজেদের জায়গা পাকাপোক্ত করে নিয়েছে।
এর আগে বছরের শুরুতে আফ্রিকার দেশ ক্যামেরুন, মাদাগাস্কার ও সেনেগালে সেরা ব্যাংকের তকমা পায় সোসাইটি জেনারেল ব্যাংক। ভবিষ্যতে ব্যাংকটি নিজেদের ক্ষুদ্রঋণ এবং খাতভিত্তিক বিনিয়োগ কার্যক্রম মরক্কো, আলজেরিয়া এবং তিউনেশিয়ার মতো আরও ২৭টি নতুন দেশে বিস্তৃত করতে চায় বলে জানা গেছে।
লেনদেনের ওপর ভিত্তি করে সেরা ব্যাংকের তালিকায় আছে, সিটি ট্রেজারি অ্যান্ড ট্রেড সল্যুশন (টিটিএস)। মিশরভিত্তিক বহুজাতিক এ ব্যাংকটি ৯৬টি দেশে ১৪৪ ধরনের মুদ্রায় লেনদেন করে থাকে। লেনদেনের সেবা নিশ্চিত করতে ব্যাংকটি ২৪ ঘণ্টা গ্রাহকদের সার্ভিস দেয় বলে জানিয়েছেন ব্যাংকটির বৈশ্বিক প্রধান সামির খালিক।
এদিকে টেকসই অর্থনীতির মাপকাঠিতে যুক্তরাজ্যভিত্তিক স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক আছে সেরা ব্যাংকের তালিকায়। বছরান্তে ব্যাংকটির সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে ৪০ শতাংশ। ২০৩০ সালের মধ্যে পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে ব্যাংকটি ৩০০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে চায় বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।
এ ছাড়া ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে কুয়েত ফাইন্যান্স হাউজ জায়গা করে নিয়েছে সবার ওপরে। বিশ্বের সব ইসলামি ব্যাংকের মধ্যে বিনিয়োগ এবং মজুত অর্থের ভিত্তিতে কুয়েতভিত্তিক এ ব্যাংকটির অবস্থান দ্বিতীয়। সৌদি আরবের আহিল ইউনাইডেট ব্যাংকের পরেই অবস্থান করছে কুয়েত ফাইন্যান্স।
চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ব্যাংকটি প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে, যা ভেঙে দিয়েছে বিগত সব রেকর্ড। ২০২২ সালের তুলনায় ব্যাংকটির এ আয় ১৪১ শতাংশ বেশি।
তালিকায় সেরা বেসরকারি ব্যাংকের তকমা পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের জেপি মর্গান প্রাইভেট ব্যাংক। বর্তমানে বহুখাত নির্ভর ব্যাংকটির সম্পত্তির পরিমাণ ২ দশমিক ১ ট্রিলিয়ন। বিভিন্ন আর্থিক গবেষণা সংস্থার প্রতিবেদনে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, ২০৪৫ সালের মধ্যে এ প্রতিষ্ঠানটির সম্পত্তির পরিমাণ বেড়ে ৮৪ দশমিক ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে।
গ্লোবাল ফাইন্যান্স ম্যাগাজিনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি বছর জানুয়ারি থেকে জুন মাসের কর্মযজ্ঞের ওপর ভিত্তি করে এ তালিকা করা হয়েছে। মূলত খাতভিত্তিক বিভিন্ন দক্ষতার বিচারে নানা মানদণ্ডে সেরাদের তালিকায় উঠে এসেছে এসব ব্যাংকের নাম।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।