জাহাঙ্গীর আলম ভূঁইয়া : শত বছরের পুরনো স্থাপত্য নিদর্শন ঐতিহাসিক রায়পুর বড় মসজিদ। মূলত দৃষ্টিনন্দন নির্মাণশৈলী ও অপূর্ব কারুকাজের জন্য মসজিদটি বিখ্যাত। উপমহাদেশে সুন্দরতম স্থাপনা তাজমহলের আদলে তৈরি মসজিদটি রাজকীয় মহিমায় দাঁড়িয়ে আছে। মসজিদটি দোতলা। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে কোনো ধরনের রডের ব্যবহার ছাড়াই সম্পূর্ণ ইটের উপর নির্মিত হয়েছে স্থাপনাটি। ছাদ ও গম্বুজের চারপাশে পাথর খোদাই করা পাতার ডিজাইন গ্রামীণ ঐতিহ্যের জানান দেয়।
রায়পুর বড় মসজিদটি অবস্থান সুনামগঞ্জ জেলার শান্তিগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম পাগলার বাজার সংলগ্ন মহাশিং নদীর কূলঘেঁষে। এই মসজিদটি সম্পর্কে জানা যায়, মসজিদটি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত করেন ইয়াসিন মির্জা ও তার ভাই ইউসুফ মির্জা ১৩৩১ বঙ্গাব্দের ৫ আশ্বিন, শুক্রবার। নির্মাণ কাজে সময় লেগেছিল ১০ বছর। নির্মাণ ব্যয় তখনকার সময়ে ১০ লাখ টাকার বেশি। মসজিদটির নির্মাণকাজে মূল মিস্ত্রিসহ জোগালিরা ছিলেন ভারতীয়। মূল স্থপতির নাম মুমিন উস্তাগার। যার পূর্বপুরুষ ভারতের তাজমহলে কাজ করেছেন। ওই সময়ে মুমিন ঢাকাতে বসবাস করতেন।
৬৮ ফুট দৈর্ঘ্য ও বারান্দাসহ ২৫ ফুট প্রস্থের গম্বুজসহ মসজিদটির উচ্চতা ৪০ ফুট। ছয়টি স্তম্ভের উপর ছয়টি মিনার। তিনটি বিশাল গম্বুজ এবং ছোট আরও ১২টি মিনার রয়েছে। মসজিদের নিচতলায় হিফজখানা আর উপরের তলায় নামাজের স্থান নির্ধারিত। দোতলা এই ভবনের সামনে একটি বড় ঈদগাহ আছে। উত্তর দিকে একটি ফটক আছে। মসজিদে সম্মুখে ওজুখানা ও একটি মাদ্রাসা রয়েছে।
মসজিদের ভূমিকম্প নিরোধক ব্যবস্থা হিসেবে ভূমি খনন করে বেশ মজবুত পাতের উপর স্থাপনাটির ভিত নির্মিত। ফলে ভূমিকম্পও এখন পর্যন্ত মসজিদটিতে ফাটল ধরাতে পারেনি।
মসজিদ নির্মাণের পর এখন পর্যন্ত বড় ধরনের কোনো সংস্কারের প্রয়োজন পড়েনি। ৩০ বছর আগে গম্বুজের এক জায়গায় লিকেজ দেখা দিয়েছিল। তখন গম্বুজের উপরের দিকের কিছু পাথর পরিবর্তন করতে হয়েছিল।
মসজিদের মিহরাব অংশে জমকালো পাথর কেটে আকর্ষণীয় ডিজাইন করা হয়েছে। চারপাশে তিন ফুট উচ্চতা পর্যন্ত কারুকার্যখচিত টাইলস লাগানো হয়েছে। টাইলস আনা হয়েছিল ইতালি ও ইংল্যান্ড থেকে। প্রত্যেকটা প্রবেশদ্বারে পাথরখচিত খিলান মসজিদটিকে দৃষ্টিনন্দন করে তুলেছে। মসজিদের নিচতলার ছাদ ঢালাইয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়েছে রেলের স্লিপার। মসজিদের দোতলার মেঝেতে রয়েছে দুর্লভ শ্বেতপাথর। তার চারপাশে ব্লকে দেওয়া দুর্লভ ব্ল্যাক স্টোন বা কালোপাথর। এগুলো আনা হয়েছে ভারতের জয়পুর থেকে। মসজিদে ব্যবহৃত এ ধরনের পাথর একমাত্র তাজমহলে ব্যবহার করা হয়েছে।
হোসেন আহমেদ, জাকির হোসেনসহ স্থানীয় কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জার পিতা আদিল হাজী ছিলেন খুবই ধার্মিক। ওই সময়ে মুসলমানরা ছিল সংখ্যালঘু। পুরো পরগনার মধ্যে তিনিসহ হাতেগোনা দু-একজন হাজী ছিলেন। আদিল হাজীকে সবাই পায়ে হেঁটে হজপালনকারী হিসেবে জানেন। ধর্ম ও কর্মের প্রতি মনোনিবেশে ও সে সময় ওই এলাকায় মসজিদ না থাকায় নিজ বাড়িতে একটি টিন শেড মসজিদ তৈরি করেন। আশপাশের গ্রামের মুসলমানরাও এখানে এসে নামাজ আদায় করতেন। বিশাল ভূপতির মালিক ইয়াসিন মির্জা ও ইউসুফ মির্জা মসজিদটি নির্মাণ করেন। ইয়াসিন মির্জা ব্যবসা উপলক্ষে ভারতের কলকাতাসহ নানা জায়গায় ভ্রমণ করতেন। ভ্রমণের সুবাদে বিভিন্ন জায়গার স্থাপত্যশৈলী দেখে তিনি এই মসজিদ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
স্থানীয় বাসিন্দা সাকিল আহমেদ জানান, ঐতিহ্যবাহী পাগলা বড় জামে মসজিদটির আনুষঙ্গিক কাজ নিজস্ব ফান্ড বা চাঁদা তুলে সম্পাদন করা হয়। সরকারের তরফ থেকে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ পেলে ঐতিহ্যবাহী এই স্থাপনাটি পর্যটন শিল্পে একটা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে পারত।
ইউসুফ মির্জার প্রপৌত্র শ্যামল মির্জা বলেন, সরকার সম্পত্তি নিয়ে নিলেও মসজিদটি তাদের তত্ত্বাবধানে নেয়নি। আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় আনার বিষয়টি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অধীনে। ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতীক মসজিদটিকে সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় আনার জোর দাবি জানাই।
শান্তিগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) সুকান্ত সাহা বলেন, মসজিদটি খুবই দৃষ্টিনন্দন। ধর্ম মন্ত্রণালয় চাইলে এ মসজিদটি প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের আওতায় আনা হবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।