ধর্ম ডেস্ক :
ধর্মীয় ইতিহাসে এমন কিছু নিদর্শন থাকে যা মানুষের আত্মাকে স্পর্শ করে — মসজিদে শাজারাহ ঠিক তেমনই এক স্থান। সাধারণ দর্শকের চোখে এটি কেবল একটি ছোট মসজিদ। কিন্তু যারা এর পেছনের কাহিনি জানেন, তাদের কাছে এটি এক অলৌকিক ঘটনার স্পর্শধন্য পবিত্র স্থান। নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনের একটি বিশেষ মুহূর্তকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই মসজিদ এখন ইসলামী ঐতিহ্যের এক অনবদ্য স্মারক।মসজিদে শাজারাহ – ‘গাছের মসজিদ’ নামের পেছনের গল্প
“শাজারাহ” শব্দটি আরবি ভাষায় অর্থাৎ গাছ। নবী মুহাম্মদ (সা.) মক্কায় দাওয়াত দেওয়ার সময়ে অনেক কঠিন মুহূর্ত অতিক্রম করেন। যখন কুরাইশদের চরম বিরোধিতা, বিদ্রূপ ও হুমকির সম্মুখীন হন, তখন তিনি মহান আল্লাহর সান্ত্বনা ও দয়া কামনা করে নির্জনে সময় কাটাতেন।
ইসলামি ইতিহাসবিদদের মতে, এমনই একদিন তিনি নির্জনে একটি গাছের দিকে তাকিয়ে বললেন —
“আল্লাহ যদি ইচ্ছা করেন, তবে এই গাছ আমার কাছে এসে সালাম দেবে।”
তাৎক্ষণিকভাবে গাছটি নড়ে উঠে তাঁর দিকে এগিয়ে আসে, সালাম দেয় এবং ফিরে যায়।
এই অলৌকিক ঘটনা শুধুমাত্র নবুওয়তের নিদর্শন হিসেবেই নয়, বরং তা রাসূল (সা.)‑এর একাকিত্বের মুহূর্তে আল্লাহর তরফ থেকে এক চরম সান্ত্বনার বার্তা ছিল। পরে সাহাবায়ে কিরামরা এই ঘটনাকে স্মরণ করে সেখানে একটি ছোট্ট মসজিদ নির্মাণ করেন, যা আজ “মসজিদে শাজারাহ” নামে পরিচিত।
অবস্থান ও স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য
বিষয় | বিবরণ |
অবস্থান | মক্কার ঐতিহাসিক Shi’b Aamir উপত্যকায়, Ma’la district-এ অবস্থিত। |
আশেপাশের মসজিদ | মসজিদ আল-জিন, মসজিদ আল-রায়াহ, কবরস্থান জান্নাতুল মা’লা |
গঠন | এক গম্বুজ ও এক মিনারবিশিষ্ট ছোট্ট মসজিদ |
ধারণক্ষমতা | আনুমানিক ২০–২৫ জনের জামাত আদায় উপযোগী |
নিরিবিলি পরিবেশ | পর্যটন নয়, বরং আত্মিক ভাবনায় নিমগ্নদের জন্য উপযুক্ত স্থান |
আজকের দিনে, এই মসজিদে ভিড় না থাকলেও যারা জানেন—তারা একে অবহেলা করেন না। সৌদি সরকারের অধীনস্থ ইসলামি পর্যটন উন্নয়ন সংস্থা এই মসজিদকে নতুনভাবে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিচ্ছে।
মদিনার শাজারাহ বনাম মক্কার শাজারাহ: বিভ্রান্তির অবসান
বিভ্রান্তির একটি বিষয় হলো, অনেকেই মদিনার “মসজিদে শাজারাহ” বা “মসজিদে যুল হুলাইফাহ” এর সঙ্গে মক্কার এই মসজিদকে গুলিয়ে ফেলেন।
➡️ মদিনার মসজিদে শাজারাহ হজ ও উমরাহর সময় মিকাত পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যেখানে হাজীরা ইহরাম বেঁধে হজের নিয়ত করেন।
➡️ মক্কার মসজিদে শাজারাহ, বিপরীতে, একটি ঐতিহাসিক অলৌকিক ঘটনার চিহ্নমাত্র।
এই দুটি মসজিদের নামের মিল থাকলেও উদ্দেশ্য ও গুরুত্ব ভিন্ন।
তীর্থযাত্রীদের অভিজ্ঞতা
মক্কার পুরাতন এলাকা ঘুরে আসা বাংলাদেশি তীর্থযাত্রী আবুল হোসেন জানান,
“আমরা যখন কাবা শরিফে গিয়ে ফজরের নামাজ পড়ি, তার আগে গাইড আমাদের মসজিদে শাজারাহ ঘুরিয়ে আনেন। জায়গাটা নিরিবিলি, ছোট, কিন্তু ভিতরে ঢুকলেই মনে হয় কিছু একটা বিশেষ আছে। দোয়া করতে করতে চোখে পানি চলে আসে।”
অন্যদিকে, ভারত থেকে আসা এক দম্পতি বলেন,
“আমরা আগে এই মসজিদের নামই শুনিনি। যখন গাইড বললেন এখানে নবীজির অলৌকিক ঘটনা ঘটেছিল, তখন আর দেরি করিনি। এত ছোট একটা জায়গা, কিন্তু ইতিহাসের ভার অনেক বেশি।”
ঐতিহাসিক সংরক্ষণ ও চ্যালেঞ্জ
বর্তমানে মক্কা ও মদিনা জুড়ে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প চলছে। রাস্তা, হোটেল, মেট্রোসহ নানা সুবিধা তৈরি করা হচ্ছে। এর ফলে অনেক ছোট ছোট ঐতিহাসিক নিদর্শন হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা উপেক্ষিত হয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, মসজিদে শাজারাহর মতো স্থানগুলো সংরক্ষণের জন্য আলাদা বরাদ্দ ও আইন প্রয়োজন। ইতোমধ্যে সৌদি আরবের “Reviving Islamic Heritage Initiative” এই ধরনের স্থানগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু করেছে।
আধ্যাত্মিক গুরুত্ব ও প্রতিফলন
মসজিদে শাজারাহ শুধুমাত্র এক ঐতিহাসিক স্থান নয়—এটি এক আধ্যাত্মিক চেতনার বাহক। এটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে, সবচেয়ে দুঃখজনক সময়েও আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ছেড়ে দেন না।
এই মসজিদের বার্তা হলো—
“যে একাকী, সে একা নয়। যে আশ্রয় চায়, তার জন্য রহমত অপেক্ষা করে।”
মসজিদে শাজারাহ—একটা ছোট মসজিদ, কিন্তু ইতিহাসে তার স্থান মহৎ। যারা মক্কায় আসেন, তারা কেবল কাবা শরিফ বা জমজম কূপ দেখে ফিরে না গিয়ে এই ছোট্ট মসজিদেও কিছু সময় কাটালে, তাঁদের সফর আরও হৃদয়ছোঁয়া হতে পারে।
মসজিদে শাজারাহ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—
ঈমানের গভীরতা গম্বুজ বা মিনারের উচ্চতায় নয়, বরং একটি নিঃশব্দ বিশ্বাসে — যে বিশ্বাস একটি গাছকেও হাঁটিয়ে আনতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।