জুমবাংলা ডেস্ক : প্রশান্ত কুমার হালদার ওরফে পিকে হালদার দেশের আর্থিক খাত ধ্বংসের অন্যতম হোতা। কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে লুট করেছেন হাজার হাজার কোটি টাকা। নানান কৌশলে সাধারণ মানুষের আমানত লুট করে বিদেশে পাচার করেছেন।
তার লুটপাট যেন পুকুর চুরি নয়, রীতিমতো সাগর চুরির মতো। এই পিকে হালদার ফতুর করেছেন ব্যাংকবহির্ভূত চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে।
জানা গেছে, পিকে হালদারের বাবা মৃত প্রাণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন গ্রাম্য বাজারের দর্জি। আর তার মা স্কুলের শিক্ষিকা। ভাই প্রাণেশ হালদার বুয়েট থেকে পাস করেন।
স্থানীয়রা বলছেন, ১৬-১৭ বছর আগে ভিন্ন ধর্মের এক নারীকে বিয়ে করার পর পিকে হালদার গ্রামছাড়া হন।
২০১৯ সালে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় প্রথম পিকে হালদারের নাম সামনে আসে। এ সময় দুদক যে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে, পিকে হালদার ছিলেন তাদের একজন।
অভিযোগ আছে, পিকে হালদার লুট করেছেন প্রায় চার হাজার কোটি টাকা, যার অধিকাংশ তিনি পাচার করেছেন। তবে শেষ রক্ষা হয়নি তার। বিভিন্ন দেশে পালিয়ে থেকেও গত বছর ভারতে ধরা পড়েন।
দেশটির কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গের নয়টি স্থানে একযোগে অভিযান চালিয়ে পিকে হালদার ছাড়াও তার অপকর্মের অন্যতম সহযোগী ছোট ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার ও প্রাণেশ কুমার হালদারকে আটক করে। বর্তমানে ভারতের কারাগারে আছেন তারা।
আর্থিক জালিয়াতিতে বহুমুখী ধুরন্ধরতার পরিচয় দিয়েছেন পিকে হালদার। নানা কৌশলে নামে-বেনামে একের পর এক কোম্পানি খুলে, প্রভাব খাটিয়ে প্রতারণা ও জালিয়াতি করে দেশের গুরুত্বপূর্ণ একাধিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ধসিয়ে দিয়েছেন তিনি।
ঋণের নামে টাকা লোপাট, নামে-বেনামে পুঁজিবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কেনার অভিযোগ রয়েছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পিকে হালদারের বিরুদ্ধে। পাশাপাশি তিনি ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে নিজের আত্মীয়, বন্ধু, সাবেক সহকর্মীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে পর্ষদে বসিয়ে অন্তত চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করেন।
এই চার কোম্পানি হলো- ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস (আইএলএফএসএল), পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)। বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ১০ হাজার ২০০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। রয়েছে বিপুল অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ।
অস্তিত্বহীন ৩০-৪০টি প্রতিষ্ঠানের বিপরীতে ঋণের নামে জালিয়াতি করে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সরিয়েছেন পিকে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং থেকে ২ হাজার ৫০০ কোটি, এফএএস ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি, রিলায়েন্স ফাইন্যান্স থেকে প্রায় ২ হাজার ৫০০ কোটি ও পিপলস লিজিং থেকে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে মর্টগেজ (জামানত) নেই বলে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে উঠে এসেছে।
নিজের নামের সঙ্গে মিল রেখে পিকে হালদার গড়ে তোলেন একাধিক প্রতিষ্ঠান, যার বেশির ভাগই কাগুজে। এর মধ্যে রয়েছে পিঅ্যান্ডএল অ্যাগ্রো, পিঅ্যান্ডএল ইন্টারন্যাশনাল, পিঅ্যান্ডএল ভেঞ্চার, পিঅ্যান্ডএল বিজনেস এন্টারপ্রাইজ, হাল ট্রাভেল, হাল ইন্টারন্যাশনাল, হাল ট্রিপ, হাল ক্যাপিটাল, হাল টেকনোলজি, সুখাদা লিমিটেড, আনন কেমিক্যাল, নর্দার্ন জুট, রেপটাইল ফার্মসহ আরও একাধিক প্রতিষ্ঠান।
এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানায় আছেন পিকে হালদারের আত্মীয়রা। তার মা লীলাবতী হালদার, ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার ও তার স্ত্রী সুস্মিতা সাহা, খালাতো ভাই অমিতাভ অধিকারী, অভিজিৎ অধিকারীসহ বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের নামে প্রতিষ্ঠান খোলা হয়। ব্যাংক এশিয়ার সাবেক এমডি ইরফানউদ্দিন আহমেদ ও সাবেক সহকর্মী উজ্জ্বল কুমার নন্দীও আছেন কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানায়।
কে এই পিকে?
পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে পিকের জন্ম। বাবা প্রয়াত প্রাণবেন্দু হালদার ও মা লীলাবতী হালদার। মা ছিলেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। পিকে হালদাররা দুই ভাই। তিনি ও প্রীতিশ কুমার হালদার দুই ভাইই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। পিকে হালদার ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি বনে যান অদৃশ্য ইশারায়।
যেভাবে গ্রেপ্তার হন পিকে
কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার অশোকনগরে গা-ঢাকা দিয়েছিলেন পিকে হালদার। তিনি নিজেকে শিবশংকর হালদার নামে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিতেন। বানিয়েছিলেন ভারতীয় ভোটার কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড, রেশন কার্ডসহ বিভিন্ন ভারতীয় নথি। নিয়মিত ভোট দিতেন, নিযুক্ত ছিলেন সরকারি চাকরিতেও। কিন্তু ১৪ মে ইডির হাতে ধরা পড়েন তিনি।
নাম পাল্টে বাংলাদেশেও আসেন
ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনায় পিকে হালদারের বিষয়ে ২০১৯ সালে রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল সরকার। ভারতীয় গোয়েন্দা দপ্তর জানায়, এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে কানাডা, কখনও কলকাতা; আবার কখনো উত্তর ২৪ পরগনা যাতায়াত করেছেন পিকে হালদার। এর মধ্যেই তিনি ভারতীয় নথিগুলো তৈরি করেন। নাম পাল্টে হয়ে যান শিব শংকর হালদার। এ নামে কয়েকবার তিনি বাংলাদেশেও যাতায়াত করেছিলেন।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।