তানভীর এ মিশুক : বছরখানেক আগের কথা, একটা খবর পড়ে আনন্দ আর ভালো লাগায় আমার বুকটা ভরে উঠেছিল। বড়রা তো অবশ্যই, ছোট ছোট বাচ্চাদের মধ্যেও প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর গড়ে ওঠা সেতুর গর্ব অনুভূতি ছড়িয়ে পড়েছে—এমন একটা খবর কোনো এক নিউজ পোর্টালে পড়লাম। জাতি হিসেবে নিজেদের অর্জন নিয়ে যদি গর্বই না করতে পারি, তাহলে কীসের দেশপ্রেম, কীসের জাতীয়তা বোধ! ভালো লাগার জায়গাটা এখানেই।
ভালো লাগার গল্প বলি। ঢাকার পাশেই ধামরাই উপজেলার সুতিপাড়া গ্রামের কিশোর সোহাগ হোসেন নিজের বাড়িতেই বানিয়েছে পদ্মার ডামি সেতু। ১০ম শ্রেণির বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থী সোহাগের আবেগের জায়গাটা বুঝতে একটুও বেগ পেতে হয়নি। কারণ, আমি বা আমরা বাংলাদেশের প্রায় সব নাগরিকই গর্বের এই জায়গাতে অন্তত সোহাগের মতোই কমবেশি একই অবস্থানে আছি।
আবেগটা আসবেই-বা না কেন? নিজেদের ঘামে-শ্রমে-অর্থে বানানো দেশের সবচেয়ে বড় সেতু এটা তো আমাদের শানিত দৃঢ় অহংকার আর কোমল ভালোবাসার জায়গা। অহংকারটা আসলে অশুভকে পরাজিত করারও। দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে তবেই পদ্মার বুকে জেগে ওঠে স্বপ্নের এই সেতু।
সোহাগের ডামি সেতু দেখতে প্রতিদিন শত শত মানুষ ওদের বাড়িতে ভিড় করেছে। তাহলে প্রমত্তা পদ্মা শাসন করে দাঁড়িয়ে যাওয়া সত্যিকারের সেতুটাকে দেখতে মানুষের কী পরিমাণ আগ্রহ হওয়ার কথা! হয়েছেও তাই। দেশের দীর্ঘতম সেতুটির নান্দনিক সৌন্দর্য সচক্ষে দেখতে প্রতিদিন সহস্র-অজুত মানুষ ভিড় করছেন। যে যখনই সেতুটির নিচ দিয়ে যাচ্ছেন, একটা সেলফি ঠিকই তুলছেন। কারণ প্রত্যেকের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে অহংকার।
২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর যখন মূল সেতুর সর্বশেষ স্প্যানটি বসানো হয় তখনই আসলে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতুর পুরোটা দৃশ্যমান হয়। মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ও শরীয়তপুরের জাজিরাও এভাবেই যুক্ত হয় এই সেতুর মাধ্যমে। এর আগে থেকেই ইতিহাসের সাক্ষী হতে মানুষ যাচ্ছিল সেতুর কাজ দেখতে। তবে দুই প্রান্ত যুক্ত হওয়ার পর থেকে তো যেমন গৌরবান্বিত নাগরিকের ঢল নামে। আমি নিজেও গিয়েছি, কাছ থেকে গৌরবগাথাকে স্পর্শ করতে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এতে দেশের প্রতি ভালোবাসা আরো দৃঢ় হয়েছে। আরো জমাট বেঁধেছে।
ট্রলারে করে সেতুর যতই কাছাকাছি যাচ্ছিলাম, ততই যেন আবেগে আবিষ্ট হয়ে যাচ্ছিলাম। মূল সেতুর নিচে পৌঁছানোর পর তো গর্ব আর আনন্দের অশ্রু চোখের কোণে। সঙ্গী যারা ছিলেন, তাদের চোখেমুখেও দেখছিলাম আনন্দ আর আবেগের ঝিলিক। আমাদের সবারই যেন গর্বে বুকটা কয়েক ইঞ্চি পর্যন্ত চওড়া হয়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত, সবার মধ্যেই তখন একই অনুভূতি খেলা করছে, ‘আমার নিজের গাটের টাকায় বানানো এই সেতু—এটা তো আমারই।’
আমাদের ট্যাক্সের টাকায় বানানো বলে এত গর্বের ভাগ নিচ্ছি, কিন্তু সব চ্যালেঞ্জ মাথায় নিয়ে যিনি পুরো কাজটি করালেন স্থানীয়, আন্তর্জাতিক নানা চক্রান্তেও যিনি মাথা নোয়াননি, তার প্রতি আমরা আসলে কতটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি? যে চ্যালেঞ্জ তিনি নিজে নিয়ে আমাদেরকে জয়ী করেছেন তার প্রতিদানে সত্যিই কি আমরা দিতে পেরেছি? এমন কিছু কি আমরা করেছি, যা দিয়ে অন্তত কিছুটা হলেও তার ঋণ শোধ হয়?
সেতু দেখে ঢাকায় ফিরতে ফিরতেই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল চিন্তাটা। বঙ্গবন্ধু স্বাধীন দেশ উপহার দিয়েছেন, তাকেও আমরা বিশেষ কিছু দেওয়ার সুযোগ পাইনি। মাওয়া থেকে ঢাকায় ফেরার যে আলোকোজ্জ্বল পথ, সেটাও সেতুর সঙ্গে সঙ্গে গর্বের আরেক উদাহরণ। পুরো পথটা জুড়ে আমি কেবল আনমনা হয়ে ভেবেছি, কীভাবে কৃতজ্ঞতা জানানো যায়? কোটি মানুষ দিনে শত-সহস্র বারও যদি তার প্রতি ‘ধন্যবাদ’, ‘ধন্যবাদ’ বললে তাও তো এই কৃতজ্ঞতা শেষ হবে নয়।
আমি অর্থনীতিবিদ নই, তবে যেহেতু উদ্যোক্তা এবং ব্যবসাদার মানুষ—সেই দৃষ্টিকোণ থেকে যতটুকু বুঝি, এই একটা সেতু শুধু দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল নয়, গোটা দেশের চেহারাই সমূলে বদলে দেবে। ঢাকার সঙ্গে দুটি সমুদ্রবন্দরের দূরত্ব আরো কয়েক ঘণ্টা করে কমে যাবে। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর যে বেনাপোল তার সঙ্গেও রাজধানীর দূরত্ব কমবে। বাঁচবে কোটি কোটি শ্রমঘণ্টা। ফলে ব্যবসায়-বাণিজ্যে গতি সঞ্চার হবে, বদলে যাবে সামগ্রিক আর্থসামাজিক দৃশ্যপট, যার প্রভাব পড়বে সুদূরের তেঁতুলিয়া-টেকনাফ বা হাওড়-বাঁওড়ের দুর্গম অঞ্চলেও। আর বিশ্বদরবারে মর্যাদা অর্জনের হিসেব! সে তো বলার অপেক্ষা রাখে না। পদ্মার এই সেতু মানেই এখন বিশ্বদরবারে কেবল বাংলাদেশের জয়, যেখানে বাংলাদেশ দলটির ক্যাপ্টেন শেখ হাসিনা।
যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে এত মানুষকে গর্বিত করেছেন, কৃতজ্ঞতা প্রকাশের জন্য হলেও সেতুটির নাম তো তার নামেই হওয়া উচিত। যুগ যুগ ধরে মানুষ যখন এই সেতু ব্যবহার করবে তখন যেন সবাই মনে রাখেন যে, আমাদের একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দেশমাতৃকার প্রতি তার অঘাত ভালোবাসার সেতু এটি। আমাদের অনাগত নাগরিকদেরও এই দৃঢ়চেতা নেতৃত্বের অধ্যায়টা জানার দরকার আছে।
সেতুটির নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করার বিষয়ে আমি দাবি তুলতে চাই। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নিজেও যদি এ বিষয়ে ইতিবাচক নাও থাকেন, তা-ও আমাদের কর্তব্য হবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দাবি তোলা। নিশ্চয়ই আমার মতো আরো কোটি কোটি মানুষের চাওয়াকে তিনি অগ্রাহ্য করবেন না।
আর মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে সেতুটির উদ্বোধন হবে। ইতিমধ্যে প্রায় সব কাজ শেষ। আমি দেশবাসীর হয়ে প্রস্তাব রাখছি উদ্বোধনের আগেই সেতুটির নাম ‘শেখ হাসিনা সেতু’ করা হোক। এটি এখন জনদাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক: ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ‘নগদ’
বিএনপির কাজ হলো দেশে গুজব ছড়িয়ে আতঙ্ক তৈরি করা : খালিদ মাহমুদ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।