হাসনাইন তোহা : যুগে যুগে প্রাচীন শহর ঢাকা অনেক কিছুই হারিয়েছে। এই শহর থেকে বিলুপ্ত হয়েছে অনেক স্থাপনা, জায়গা, এমনকি নদীও। তবে বিলুপ্ত কিংবা হারিয়ে যাওয়ার স্রোত থেকে বেঁচে গেছে ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ। অনেকে আবার এটিকে ‘মুঘল ঈদগাহ’ নামেও চেনেন। কালের বিবর্তনে ঈদগাহটির অনেক অংশ বিলীন হয়ে গেলেও, নানা উদ্যোগের ফলে মূল অংশটি সগৌরবে টিকে আছে।
একসময় পান্ডু নদীর ধারে ছিল এই ঈদগাহের অবস্থান। বর্তমানে এই নদীর নিশানাটুকুও অবশিষ্ট নেই। বর্তমান প্রেক্ষাপটে ধানমন্ডির পুরোনো ১৫ এবং নতুন ৮/এ সড়কে এটির অবস্থান। জিগাতলা থেকে মোহাম্মদপুরের দিকে যেতে বড় রাস্তার পাশেই চোখে পড়বে প্রাচীন স্থাপনাটি। ভেতরে ঢুকতেই প্রশান্তি দেবে এখানকার সবুজ অবয়ব। ঈদগাহের আশেপাশে নিমগাছ, নারকেলগাছ, তেঁতুলগাছ ও আমগাছের শীতল ছায়া। মাঠে নির্মল সবুজ ঘাস। দুপুর গড়ালেই অনেকে আড্ডা দিতে আসেন। খেলাধুলায় মত্ত থাকে কচি-কাঁচারা। তবে বছরের দুই ঈদে বেশ ভালো প্রস্তুতি নিয়েই এখানে নামাজ আদায় করেন ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা। এই রীতি ৩৮৪ বছর ধরে চলমান।
শাহি ঈদগাহ নির্মিত হয় ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের সুবাদার ছিল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। তার দেওয়ান ছিলেন মীর আবুল কাসেম; তিনিই নির্মাণ করেন এই শাহি ঈদগাহ। মূল শহর অর্থাত্ পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি সুলতানি ঈদগাহ থাকলেও বড় আকারে কোনো ঈদগাহ ছিল না। তাই মীর আবুল কাসেম ঈদগাহের জন্য শহর থেকে একটু দূরে, নিরিবিলি ও প্রশান্তিদায়ক জায়গা খুঁজতে থাকেন। অবশেষে, তিনি পেয়ে যান ধানমন্ডি এলাকায়, পান্ডু নদীর ধারে।
প্রথমদিকে এখানে শুধু মুঘল আমলে সুবাদার, নায়েবে নাজিম, অমাত্য (মন্ত্রী) ও গণ্যমান্য ব্যক্তি এবং তাদের স্বজনরাই নামাজ পড়তে পারতেন, সাধারণ নগরবাসীরা এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না। পরবর্তী সময়ে এটি গণমানুষের ঈদগাহ হয়ে ওঠে। অনেকে দলবল নিয়ে এখানে নামাজ পড়তে আসতেন।
১৭২৯ সালের রমজান মাসের কথা। বাংলায় তখন শাসন করছেন সুবাদার দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ। এই সময়ে ত্রিপুরা জয়ের খবর এল সুবাদারের কাছে। আনন্দে উদ্বেলিত সুবাদার তত্ক্ষণাত্ হুকুম দিলেন গরিবদের মধ্যে হাজার টাকা বিতরণের। শুধু তাই নয়, তার নির্দেশে ঈদের দিনে সুবাদারের আবাস লালবাগ কেল্লা থেকে ঈদগাহে যাওয়ার পুরো পথের দুই পাশে দাঁড়ানো মানুষের মাঝে ছড়ানো হয়েছিল মুঠি মুঠি মুদ্রা। সেই মুঘল আমল থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এখানে ঈদের নামাজ আদায় হতো। ঈদের দিন নানা রঙের পতাকা হাতে নিয়ে ঈদ মিছিল সহকারে ধানমন্ডি ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাওয়া হতো।
ঢাকার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিচর্চা প্রতিষ্ঠান ঢাকা কেন্দ্রের তথ্য মতে, ঈদগাহের সামনে পান্ডু নদীতে একটি সুন্দর ব্রিজ ছিল, যা এখন নেই। পার্শ্ববর্তী ভূমি থেকে প্রায় ৪/৫ ফুট উচ্চ ভূমির ওপর স্থাপিত ঈদগাহটির মূল আয়তন ছিল ২৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ১৪৭ ফুট। উত্তর, পূর্ব এবং দক্ষিণ দিকে ৬ ফুট করে উচ্চ প্রাচীর দ্বারা ঈদগাহের স্থানটি ঘেরা ছিল। দেয়ালগুলো কালক্রমে জীর্ণ ও ধ্বংস হয়ে যায়। ঈদগাহের পশ্চিম দিকে জুড়ে রয়েছে ১৫ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন বৃহদাকার দেয়াল। এই পশ্চিম দেয়ালের কেন্দ্রস্থলে রয়েছে খিলানের সাহায্যে নির্মিত সুদৃশ্য মেহরাব। এই মেহরাবের উভয় পার্শ্বে আছে খাঁজকাটা ও ধনুকাকৃতির প্যানেল নকশা। এগুলোর পরে উভয় দিকে রয়েছে তিনটি করে ছোট ও অগভীর মেহরাব। কেন্দ্রীয় মেহরাবের সামনে দাঁড়িয়ে ইমাম সাহেব ঈদের নামাজে খোতবা দেন এবং নামাজের নেতৃত্ব দেন। ১৯৮১ সাল থেকে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণ করছে। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আওতায় যে ৫০৪টি সংরক্ষিত পুরাকীর্তি রয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম। সংরক্ষণের কারণে ধানমন্ডির শাহি ঈদগাহ এখনো বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। তবে মাঝে বেশ কয়েকবছর অযত্ন অবহেলায় ছিল ঈদগাহটি।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক এ কে এম শাহনাওয়াজ বলেন, বাংলাদেশের এই একটি ঈদগাহ হলো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন—যা মুঘল আমলে নির্মিত হয়েছে। এছাড়া বাকি যেগুলো প্রাচীন বলা হয় সেগুলো মূলত ইংরেজ আমলে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।