মুফতি মীযানুর রহমান রায়হান : মহানবি হজরত মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (স.) মানব জাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার। মানবসভ্যতার সমৃদ্ধ পর্যায়গুলোর প্রতিটি ক্ষেত্রে তার অতুলনীয় মহত্ত্ব ও গুণের ছাপ রয়েছে। সুরা আহযাবের ৪৫ ও ৪৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘হে নবি! আমি আপনাকে সাক্ষী, সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে পাঠিয়েছি এবং আপনি আল্লাহর আদেশক্রমে তার দিকে আহ্বানকারী এবং উজ্জ্বল প্রদীপ হিসেবে প্রেরিত হয়েছেন।’
ইসলাম কেবল আধ্যাত্মিক বিধান অথবা ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের নাম নয়। বরং এটি পূর্ণাঙ্গ একটি জীবব্যবস্থা, যার মধ্যে মুসলমানদের সামগ্রিক জীবনবিধান, ধর্মীয়, সামাজিক, দেওয়ানি, ফৌজদারি, ব্যবসাসংক্রান্ত, সামরিক, বিচার বিভাগীয় এবং দণ্ডবিধিবিষয়ক আইনকানুন রয়েছে। আরবে গোত্রভিত্তিক শাসনব্যবস্থার বদলে তিনি এমন একটি আদর্শ ও জনকল্যানকর রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে গেছেন, যার উদাহরণ আজও ইতিহাসে বিরল। প্রখ্যাত ব্রিটিশ মনীষী বার্নার্ড শ বলেন, If all the world was under one leader then Mohammad (sm) would have been the best fitted man to lead the peoples of various creed dogmas and ideas to peace and happiness. অর্থাৎ, ‘গোটা বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মের সম্প্রদায় ও মতবাদসম্পন্ন মানব জাতিকে যদি ঐক্যবদ্ধ করে একনায়কের শাসনাধীনে আনা হতো, তাহলে একমাত্র মুহাম্মদ (স.)ই সর্বাপেক্ষা সুযোগ্য নেতারূপে তাদের শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করতে পারতেন।’
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.) আল্লাহ রব্বুল আলামিনের সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত পয়গাম নিয়ে দুনিয়ায় এসেছিলেন। ২৩ বছরের নবুয়ত জিন্দেগির মধ্যেই তিনি মানব জাতি, মানবসভ্যতা ও মানুষের অগ্রগতির কাফেলা যাতে অত্যন্ত সাফলতার সাথে চলতে পারে এবং রবের দরবারে গিয়ে সাফল্যের সঙ্গে তার সন্তুষ্টি ও ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য হতে পারে, তারই একটা রূপরেখা তিনি রেখে গেছেন। জীবন ও জগতের ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্ সব ক্ষেত্রে রসুলুল্লাহ (স.) ছিলেন সর্বোত্কৃষ্ট আদর্শ।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (স.)-এর ঐতিহাসিক একটি সাফল্য হলো, তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম একটি লিখিত শাসনতন্ত্র উপহার দিয়েছিলেন। ‘মদিনা সনদ’ নামে ৪৭টি ধারা সংবলিত এ ধরনের মানবিক সমঝোতামূলক শাসনতন্ত্র প্রায়োগিকভাবে আর কেউ উপহার দিতে পারেনি। প্রথম দিকে ইহুদি ও পৌত্তলিকরাও তার নেতৃত্ব মেনে নিয়ে চুক্তিবদ্ধ হন। গোটা ‘জাজিরাতুল আরব’ বা আরব উপদ্বীপের একচ্ছত্র আধিপতি হিসেবে তিনি মদিনাকে কেন্দ্রীয় রাজধানী করে সমগ্র শাসন এলাকা ১০টি প্রদেশে বিভক্ত করেন। প্রতিটি প্রদেশে গভর্নর নিযুক্ত করে প্রতিটি অঞ্চলে শান্তি-শৃঙ্খলা, ন্যায়বিচার-নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন। মসজিদে নববি ছিল তার প্রধান কার্যালয়, নবপ্রতিষ্ঠিত অসাম্প্রদায়িক মদিনা রাষ্ট্রের পার্লামেন্ট। মজলিসে শুরা বা আইনসভা হিসেবে তিনি মসজিদে নববিকে বেছে নিয়েছিলেন। প্রধান বিচারালয়, বাইতুল মাল বা সরকারি ট্রেজারি হিসেবেও তিনি মসজিদে নববিকে ব্যবহার করতেন। এই মসজিদ ছিল জেনারেল হেডকোয়ার্টার, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন। পথিক, গৃহহীন, শরণার্থীদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র, নিঃস্ব ও অভাবগ্রস্তদের ত্রাণ ও সাহায্য সংস্থা। আহত ও অসুস্থদের চিকিত্সালয়, জ্ঞান অন্বেষীদের গবেষণাগার, যুগশ্রেষ্ঠ শিক্ষায়তন এবং মদিনার প্রধান শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। রসুল (স.)-এর মসজিদের দুয়ার কখনো বন্ধ হতো না। এক কথায়, রাষ্ট্রীয় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ এখান থেকে সম্পাদিত হতো। জনসেবার প্রতিটি দপ্তরের জন্য নবিজি পৃথক দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন সাহাবীকে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
জগতের অতুলনীয় প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক হয়েও নবিজি অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। দিনে শাসনকার্য পরিচালনা করতেন আর রাতে প্রভুর দরবারে অঝোর নয়নে কাঁদতেন। ৮ লাখ বর্গমাইলের এই মহান রাষ্ট্রনায়ক মহানবি মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহ (স.) চিরবিদায়কালে রেখে গিয়েছিলেন কিছু গৃহস্থালি ও প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধাস্ত্র। আর রেখে গিয়েছিলেন একটি পূর্ণাঙ্গ নিখুঁত কালজয়ী সর্বোত্কৃষ্ট আদর্শ।
লেখক: বাংলাদেশ বেতারের উপস্থাপক ও খতিব, আজিমপুর দায়রা শরিফ মসজিদ, ঢাকা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।