জুমবাংলা ডেস্ক : ‘বীজযুক্ত কলম’ উদ্ভাবনের পর তা বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন যশোরের নাছিমা আক্তার। প্লাস্টিকমুক্ত সবুজ পৃথিবী গড়ার উদ্দেশ্যে চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে কলমটি বাজারজাত করছেন। কলমের কালি শেষ হওয়ার পর এটি মাটিতে রোপণ করলে হবে গাছ। এভাবে গড়ে উঠবে সবুজ পৃথিবী। এর আগে ‘পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম’ উদ্ভাবন করেছিলেন এই নারী উদ্যোক্তা। বর্তমানে দুই ধরনের কলমই তৈরি করছেন। এরই মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার পিস বীজযুক্ত কলম যুক্তরাষ্ট্রে গেছে।
খুচরায় বীজযুক্ত কলম ১৫ ও এবং কাগজের কলম ১০ টাকায় বিক্রি করছেন। তবে পাইকারিতে নিলে দাম কিছুটা কম রাখেন। গড়ে দিনে এক হাজার পিস তৈরি করেন। এর মধ্যে বীজযুক্ত ৭০০ পিস এবং কাগজের ৩০০ পিস। মাসে বীজযুক্ত কলম বিক্রি হয় তিন লাখ ১৫ হাজার টাকার। আর কাগজের বিক্রি হয় ৯০ হাজার টাকার।
এক ছেলে এক মেয়ে ও স্বামীকে নিয়ে নাছিমার পরিবার। সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় এবং পরিবেশ দূষণের কথা চিন্তা করে প্রথমে পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম উদ্ভাবন করেন। পরে বীজযুক্ত কলম উদ্ভাবন করেন। সাংসারিক কাজের ফাঁকে এসব কলম তৈরি করছেন। নাছিমার বড় মেয়ে রেবেকা সুলতানা ঢাকার একটি কলেজ থেকে ইংরেজিতে অনার্স করে মাকে সহযোগিতা করছেন। ছেলে মীর নাঈম আলম শুভ তালবাড়ীয়া ডিগ্রি কলেজে ডিগ্রিতে পড়াশোনার পাশাপাশি কলম তৈরি করছেন।
হয়েছে নারীদের কর্মসংস্থান
নাছিমা যশোর শহরের লোন অফিস পাড়ার বাসিন্দা। বাড়িতে গিয়ে যায়, বারান্দায় কলম তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন নারী কর্মীরা। নিপুণ হাতে রংবেরঙের কাগজ, আঠা আর কলমের শীষ দিয়ে দুই ধরনের কলম তৈরি করছেন তারা। এর মধ্যে কাগজ দিয়ে তৈরি করছেন কাগজের কলম। পাশাপাশি ওই কলমের পেছন দিকে সংযুক্ত করা হয় ফুল, ফল ও সবজির বীজ। মোট কথা যেসব বীজ ক্ষুদ্র আকৃতির সেগুলো সংযুক্ত করা হয় কলমে। যেমন পেয়ারা, টমেটো, মরিচ, বেগুন, লালশাক, ডাঁটা শাকসহ বিভিন্ন ফল ও ফুলের বীজ।
নারী কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুই হাজারের বেশি নিয়মিত ক্রেতা রয়েছে এই কলমের। বিশেষ করে বিভিন্ন এনজিও যেমন—নারীপক্ষ, জগো নারী উন্নয়ন সংস্থা, নারী মৈত্রী, পরিবেশবাদী সংগঠন বেলা, সিসিডিবি, বন্ধু ফাউন্ডেশন ও বিআইজিডি প্রভৃতি।
শুভ পরিবেশবান্ধব কলম
‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ নাছিমার ব্র্যান্ড। এই নারী উদ্যোক্তার বাড়ির বারান্দায় বসে ১০ নারী কর্মী দুই ধরনের কলম তৈরি করছেন। এর মধ্যে চার জন স্থায়ী কর্মী, বাকিরা অস্থায়ী। স্থায়ী কর্মীরা মাসে পাঁচ হাজার এবং অন্যরা আড়াই হাজার করে বেতন পান।
লোন অফিস পাড়ার বাসিন্দা কলম তৈরির কারিগর শাহনাজ পারভীন বলেন, ‘সাংসারিক কাজের ফাঁকে ঘরে বসে কলম তৈরির কাজ করতে ভালো লাগে। এই উপার্জন দিয়ে তিন সন্তানের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছি। নাছিমা আপা ও তার পরিবারের সদস্যরা ভালো মানুষ। তাদের সহযোগিতায় কাজ করে যাচ্ছি।’
একই কথা বললেন আরেক কর্মী একই এলাকার বাসিন্দা দুই সন্তানের জননী আম্বিয়া খাতুন। তিনি বলেন, ‘এখানে কাজের পরিবেশ খুব ভালো। সংসারের প্রয়োজনে কাজ করছি। এই আয় দিয়ে সংসার চলে।’
১০০ নারীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্য
এই প্রকল্পে বর্তমানে ১০ জন কাজ করলেও ১০০ নারীকে সম্পৃক্ত করার লক্ষ্যের কথা জানালেন নারী উদ্যোক্তা নাছিমা আক্তার। সে জন্য বড় পরিসর ও আরও বেশি পুঁজি দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রেবেকা সুলতানা বলেন, ‘বীজযুক্ত কলমের প্রচুর চাহিদা আছে। এ জন্য দিনে ৭০০-এর মতো তৈরি করা হয়। কলমে যেসব বীজ সংযুক্ত করা হয়, সেগুলো হাইব্রিড। হাইব্রিড বীজে অঙ্কুরোদগম ৯৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। যারা এই কলম কিনবেন, তারা অবশ্যই চাইবেন সবুজায়ন। সে কারণে কলমে উন্নত বীজ ব্যবহার করা হয়। ফলে দেশে প্লাস্টিকের পরিমাণ যেমন কমবে তেমনি বৃক্ষরোপণের বিশাল কর্মসূচি বাস্তবায়িত হবে।’
চাহিদা অনুযায়ী কলম উৎপাদন করতে পারছি না উল্লেখ করে রেবেকা বলেন, ‘আরও বড় পরিসর, কাঁচামালের সরবরাহ, পেপার কাটিং মেশিন ও ডিজিটাল প্রিন্টারসহ একটি কম্পিউটার হলে আমরা শতাধিক নারীর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারতাম। সেইসঙ্গে উৎপাদন বাড়িয়ে বাজারজাত করতে সক্ষম হতাম।’
যা বলছে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
পরিবেশবান্ধব কলমের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন যশোরের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) মো. গোলাম হাফিজ বলেন, ‘নাছিমার পরিবেশবান্ধব কলমের বিষয়টি আমরা জানি। এই কাজে বড় পরিসর ও পুঁজি দরকার হলে আমাদের জানালে সে ব্যাপারে আলোচনা করা যেতে পারে। আলোচনার মাধ্যমে হয়তো আমরা তাকে সহযোগিতা করতে পারবো।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাছিমা আক্তার চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। ১৯৯২ সালে বিডিআর সদস্য (বর্তমানে বিজিবি) মীর রবিউল আলম বাচ্চুর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২০০০ সালে বাচ্চু অবসর নেন। অবসর গ্রহণের পর কিছু টাকা পেয়েছিলেন। যৌথ পরিবারের সংসারে সেই টাকা ব্যয় হয়ে যায়।
শখের বসে শুরু, এখন পুরোদস্তুর উদ্যোক্তা
নাছিমা জানিয়েছেন, স্বামী অবসর গ্রহণের পর সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। এরপর বিভিন্ন জনের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে থ্রিপিস, শাড়ি আর নকশিকাঁথা সেলাই করে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়। ২০১৬ সালে পরিবেশ রক্ষায় সবুজায়নের কথা চিন্তা করে প্রথম কাগজের কলম তৈরি করেন। সেই কলম বাজারে বিক্রি করতে গিয়ে লোকলজ্জায় পড়তে হয়েছিল। ফলে বিক্রি হয়নি। ২০১৯ সালের জুন মাসে সংসারে অর্থনৈতিক সংকট চরম আকার ধারণ করে। এ অবস্থায় ১০০টি কাগজের কলম তৈরি করে হাজির হন যশোর সদরের বাহাদুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। ওই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষককে কলমগুলো দেখিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে বিক্রির অনুমতি চান। প্রধান শিক্ষক এমন কলম উদ্ভাবন দেখে খুশি হন। শিক্ষার্থীদের কাছে সেগুলো বিক্রি করে দেন। ওই শিক্ষকই তাকে পরামর্শ দেন, কলমগুলোতে যেন পরিবেশবান্ধব সিল লাগিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ‘শুভ পরিবেশবান্ধব কলম’ সিলটি যুক্ত করেন। ধীরে ধীরে এসব কলম বিক্রি করে সংসারের হাল ধরেছেন তিনি। চলতি বছরের শুরুতে তৈরি করেন বীজযুক্ত কলম। যার চাহিদা এখন সবচেয়ে বেশি।
ছোটবেলা থেকেই হাতের কাজ করতে ভালো লাগতো জানিয়ে নাছিমা বলেন, ‘শখের বসে বাড়িতে বসে কাগজ, কাপড় আর সুতা দিয়ে নানা রকম জিনিস তৈরি করতাম। সেই শখ থেকেই পরিবেশবান্ধব কাগজের কলম তৈরির অনুপ্রেরণা পাই। এরপর বীজযুক্ত কলম তৈরি করি। কলমের রিফিল, এ-৪ সাইজের রঙিন কাগজ, বিভিন্ন ফল, ফুল, সবজি বীজ, ফেবিকল আঠা, কালার স্টিকার দিয়ে পিনআপ করা হয়। কলম তৈরি শেষে পরিত্যক্ত কাগজ দিয়ে ফুলদানি, অ্যাশ-ট্রেসহ বিভিন্ন জিনিস তৈরি করে বিক্রি করি।’
বীজযুক্ত কলম যুক্তরাষ্ট্রে
দেশের সব জেলায় এবং বিদেশে এই কলমের চাহিদা আছে উল্লেখ করে এই নারী উদ্যোক্তা বলেন, ‘বীজযুক্ত কলম দেশে কর্মরত বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা, আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি-বেসরকারি দফতর কিনে নিয়ে যায়। গত ফেব্রুয়ারি মাসে পাঁচ হাজার পিস বীজযুক্ত কলম যুক্তরাষ্ট্রে গেছে। সামনে আরও যাবে। এসব কলমে সংযুক্ত করা হয়েছে ডালিয়া ফুলের বীজ। কেউ চাইলে তার পছন্দের বীজ দিয়ে কলম তৈরি করে দেওয়া যাবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।