সাইফুল ইসলাম, মানিকগঞ্জ : বড় ভাই মামলা করেছেন। আসামি করা হয়েছে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের। হুমকি দেয়া হচ্ছে ওই মামলায় নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার। আর ছোট ভাই কন্ট্রাক্ট নিচ্ছেন নাম কাটানোর। বিনিময়ে দাবি করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। চাঁদাবাজির এমনই এক নয়া মডেল দাঁড় করিয়েছেন মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শাহীন আলমের ছোট ভাই শহীদুল আলাম।
সূত্র বলছে, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ ও নাশকতায় একটি মামলা দায়ের করেছেন মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলা যুবদলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শাহীন আলম। সেই মামলায় আসামি করা হয়েছে বেশকিছু অজ্ঞাত ব্যক্তিকে। আর এই মামলাকে কেন্দ্র করে চাঁজাবাজির দোকান খুলে বসেছেন মামলার বাদী ওই যুবদল নেতার ছোট ভাই শহীদুল ইসলাম। তিনি মামলার এজাহার থেকে নাম কাটাতে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করছেন। এ ব্যাপারে চাঁদা দাবির একটি অডিও কল রেকর্ড জুমবাংলার হাতে এসেছে।
অডিও রেকর্ডের কথোপকথন হুবহু তুলে ধরা হলো-
শহীদুল: আমরা ডিসি অফিসে আসছিলাম, বাবলুর সাথে বসছি। এজাহার কমপ্লিট। আমরা এখন মানিকগঞ্জ কোর্টে আছি। এখান থেকে সব কমপ্লিট করে দৌলতপুর থানায় ঢুকে সবকিছু এন্ট্রি কইরা থুইয়া আসুম। ভালোমন্দ আর তো ফোন দিলা না। ফাঁকে চাকরি করতেছো, ফাঁকেই চাকরি করো। মামলার মতো মামলা থাকবেনে, বাড়ি আসার দরকার নাই। চাকরি-বাকরি কইর্যা খাইও। এইড্যা জানাইয়া দিলাম তোমারে।
জাকির: এখন কী করা লাগবে সেইটা কও।
শহীদুল: আমি এখান থেকে যামু থানায়। এই কয় মিনিট, সময় লাগতে পারে এক-দেড় ঘণ্টা। এর মধ্যে তুমি কিছু করলে করতে পারো, না করলে নাই, তোমার ইচ্ছা। আমি তোমাকে তেলও মারতেছি না, আর কিছুই না।
জাকির: না, না। এখন কি টাকা লাগবো? কতডি লাগবো?
শহীদুল: ওইদিন কইলাম না তোমারে।
জাকির: ট্যাকার আলাপ করো নাই তো। ফোন দিয়ে কইল্যা আমি অমুক জায়গায় আছি। পরে কথা কমুনি। আর তো তুমিও ফোন দেও নাই, আমিও দেই নাই।
শহীদুল: তুমি আমারে কইল্যা ভাঙ্গা মাসে চাকরিতে ঢুকছি। বেতন টেতন পাই নাই।
জাকির: তাইল্যা কত ক্যামনে লাগবো কও শুনি।
শহীদুল: ১৫ হাজার ট্যাকা দিও।
জাকির: ১৫ হাজার দেওয়া লাগবো ন্যা?
শহীদুল: হ। এই দৌলতপুর থানায় রাজনীতি করতেছে আমার বড়ভাই। তুমি মনে হয় জানো। যদি শাহীন ভাইরে আল্লায় একটা পদে দেয়, তারপরে তার আপন ভাই হিসেবে কিন্তু আমি।
জাকির: হু, ওইডাই।
শহীদুল: আর আমার সার্কেল হইলো খলিলরা, উজ্জলরা, সাইফুলরা। আর ঠাণ্ডু, রাসেল-মাসেল এগুলা বালের বন্ধু। এখন আমি তোমাকে ফোন দিছি, খোলামেলা সত্যি কথা। সার্জেন্ট রাজ্জাক সকালে আমাকে ফোন দিয়ে কইতেছে, তোরে আমি এক লাখ টাকা দিমানি, তোরা আমারে ঝামেলায় ফালাইস না। আমি কইছি কাম হইবো না। আমারে কইছে, তোরা রাজনীতি করোস। যা ছোট-খাটো একটি গাড়ি হোন্ডা কিন্যা দিমুনি। আমি কইছি, না কাকা হইবো না। কিছু কিছু জিনিস হইতেছে আমার জায়গা থেকে ক্ষমতার বাইরে। এই জায়গায় ট্যাকা খাইয়্যা আমি দুর্নাম করতে পারুম না। আর যেইটা ক্ষমতায় আছে, সেইটা আমি কইরা দিতে পারি। এই আমি তোমারে বলছি। তোমার নাম মনে করো এজাহারেই থাকবো না। খোলামেলা কথা। খিচ খাইয়্যা থাকবা। কোনো সমস্যা হইলে তুমি আমারে জানাইবা।…… এখন আমি তোরে একটা কথা কই। বিশ্বাস কইর্যা তুমি এই কথাডা রাইখো ভেতরে। ময়নাল-টয়নালরা আমার সাথে ফাইজলামি করছে তো। ওগো কপালে শাস্তি আছে। আরও যারা কয়েকজন আছে, ওগো ওপরে আমার রাগ হইয়া গেছে। আমরা তো সিদ্ধান্ত নিছি, এই ব্যাপারে আর কারও সাথে কথা বলবো না। একশন হবে থানায়, একশন হবে প্রশাসনে। এখন তোমারে আমি দুই দিন আগে ফোন দিছিলাম। আর তোমার আত্মীয় আছে কবির, ওর সাথে আমার ভালো একটা সম্পর্ক। সানোয়ার আছে। সানোয়ার আমারে কইছে, মামলায় ফালাইসনা, ট্যাকা পয়সা মাইনষে কামায়। ২০ হাজার টাকার কথা কইছিলো, বিশ হাজার টাকা না, তুমি হাজার পাঁচেক টাকা কম নিও। এইডা সানোয়ার আমারে কবিরের সামনে বইল্যা দিছে। আমি আর কোনো দাবি করি নাই। …এখন জাকির ভাই, এক কথা হইলো টাকা। কি করবা? যা করার এখন আমারে তুমি কও। এরপরে আমার হাতে আর সময় থাকবো না।
জাকির: টাকার কথা ভাই মুখ দিয়ে সারা যায় না। তোমার সাথে কথা কমানি আমি।
শহীদুল: জাকির, আমি একটা কথা কই ভাই।
জাকির: হু কও।
শহীদুল: আমরা এখন এজাহার লেখতেছি। পরে কইয়্যা লাভ নাই। তোমারে তো বিশ্বাস করছি। মুখ দিয়ে একটা কথা কও। তোমর নাম থাকবো না। তখন তুমি তোমার কথাটা ঠিক মত রাখবা। ব্যস।
জাকির: টাকা তো ব্যবস্থা করা লাগবো নাকি? এখন আমার কাছে নাই। আমি যা পারি ব্যবস্থা কইরা একটা কিছু সিস্টেম করা যাইবোনে। যেহেতু তুমি কইছাও ছোট ভাই। তোমার ভাইয়ের সাথে কিন্ত আমি একসাথে লেখাপড়া করছি। শাহীনের সাথে। শাহীনের সাথে আসার কথা হইছে।
শহীদুল: না, না, না। ট্যাকার কথা আমরা জানি। এখানে মাথাপিছু আমাদের ইনচার্জকে ট্যাকা দিতে হয়। একেবারে খোলামেলা কথা। জাকির, তুমি বুঝছো না? তোমারে একটা খোলামেলা কথা কই। দশ হাজার টাকা আমার ইনচার্জকে দেওয়া লাগবো। এইডা তুমি কেইরে কইয়ো না। আর পাঁচ হাজার টাকা আমরা অফিস করতেছি, এখানে খরচ লাগতেছে। খরচ লাগতেছে এজন্য তোমার কাছে আমরা দাবি করতেছি, একেবারে খোলামেলা কথা।
জাকির: না, ঠিক আছে। খোলামেলা বলাই ভালো।
শহীদুল: তুমি যদি আমারে বিশ্বাস না করো বা কিছু করবার যাও শফিকের সাথে….রাজনৈতিক প্যানেলডা তো বুঝই। শিক্ষিত মানুষরে এতো বুঝান লাগে না। বুইজচ্ছ্যাও।
বিষয়টি নিয়ে শহীদুলের সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ওটা আমার ভয়েস না। আপনি জাকিরের সাথে যোগাযোগ করেন। তার সাথে আমার এরকম কথা হয়েছে কি’না, এটা আমার ভয়েস কিনা যাচাই করে দেখেন। এটা একটা ভুয়া নিউজ ছড়াইছে।
তবে অডিও রেকর্ডের ভয়েসটি ছোট ভাইয়ের শহিদুল ইসলামের কণ্ঠস্বর স্বীকার করে যুবদল নেতা শাহিন আলম বলেন, শহিদুলের কোনো পদবী নেই। ও রাজনীতির বাইরে। চাকরি করে ও। আপনি যে রেকর্ডিং পেয়েছেন, সেটা সাত আগস্টের। দুই মাস আগের রেকর্ডিং এর সাথে মামলার কোনো সম্পর্ক নেই। শহীদুল গ্রেপ্তার হয়েছিল। ছয় আগস্টে জামিন পেয়েছে। জামিনের পর ৭ তারিখে ওকে ডেকে নিয়ে ওরা কথা বলেছে। এটা সে সময়ের রেকর্ড। রেকর্ডিংটা আমার কাছে আসেনি। ওটা শুনলে বুঝতে পারব শহিদুল কীভাবে টাকাটা চেয়েছে।
দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জে ও এম তৌফিক আজম বলেন, শুনেছি এটা ৮ আগস্টের অডিও। নতুন করে কিছু হয়েছে কি’না আমার জানা নেই। এ বিষয়ে কোনো অভিযোগও পাইনি। অভিযোগ না পেলে এ বিষয়ে আমি কোনো কথা বলতে পারব না।
উল্লেখ্য, গত মঙ্গলবার রাতে দৌলতপুর থানায় ১২৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১৫০ জনকে অজ্ঞাতনামা করে মামলাটি দায়ের করেন যুবদল নেতা মো. শাহীন আলম। এতে মানিকগঞ্জ-১ আসনের সাবেক এমপি নাঈমুর রহমান দুর্জয়, দৌলতপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আজিজুল হক, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মো. মোশারফ হোসেন, জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক রাজিদুল ইসলাম, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সহ জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পযায়ের যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।