জুমবাংলা ডেস্ক : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে প্রতিদিনের আবহাওয়া আর প্রকৃতিতে। আবহাওয়াবিদদের কাছেও অনেক সময় রহস্যময় হয়ে উঠে ঝড়-বৃষ্টি বা বন্যার চরিত্র। এমন পরিস্থিতে পূর্বাভাস দিতে গিয়ে অনেক সময় হাসির খোরাক হতে হয়েছে তাদের। তবে আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগের চেয়ে প্রযুক্তি আর দক্ষতায় অনেকটা এগিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। তাই অনেক বেশি নির্ভুল পূর্বাভাস দিতে পারেন দেশের আবহাওয়াবিদরা। ফলে গত কয়েক বছরে আগের তুলনায় ঝড়, বন্যা, সাইক্লোনে মানুষের মৃত্যুসহ ফসলের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কমে এসেছে।
আবহাওয়াবিদদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৮৬৭ সালে সর্বপ্রথম দেশের আবহাওয়া কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলা সাতক্ষীরায় একটি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৭ সালে এ সংস্থাটি নাম পরিবর্তন করে পাকিস্তান আবহাওয়া সার্ভিস করা হয় এবং সর্বশেষ ১৯৭১ সালে দেশের স্বাধীনতার পর এটি বাংলাদেশ আবহাওয়া বিভাগ হয়ে ওঠে।
দেশের আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে অ্যানালগ ও ডিজিটাল দুই পদ্ধতিতেই অনুসরণ করা হয়। আবহাওয়াবিদেরা পূর্বাভাস তৈরির জন্য এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিভিন্ন উৎস থেকে উপাত্ত সংগ্রহ করেন এবং উন্নত কম্পিউটারে সেসব উপাত্ত বিশ্লেষণ করেন তারা। সঠিকভাবে পূর্বাভাস দেওয়ার লক্ষ্যে অনেকগুলো গাণিতিক মডেলেরও সহায়তা নিয়ে থাকেন। সেই তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করে পূর্বাভাস প্রস্তুত করা হয়।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. হাফিজুর রহমান বলেন, একজন আবহাওয়াবিদ যখন ওয়েদার ফোরকাস্ট করে থাকেন তখন তাদের ঋতুবৈচিত্র্য সম্পর্কে জানাটা জরুরি। কোন ঋতুতে কি আবহাওয়া তৈরি হয় এটা জানাটা জরুরি। তখন ফোরকাস্ট দেওয়াটা সহজ হয়। কিন্তু আমাদের পূর্বাভাস নিয়ে সবচেয়ে বেশি চ্যালেঞ্জ থাকে মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত। কারণ এ সময়টা আবহাওয়ার গতি-প্রকৃতি একটু ভিন্ন থাকে। দেখা যায় এ সময় অসংখ্য বজ্রঝড় তৈরি হয়। আধা ঘণ্টা বা এক ঘণ্টার মধ্যে তৈরি হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া এ সময় বজ্রঝড়, বৃষ্টিপাত ও বজ্রপাতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি থাকে। ফলে এই সময়টা সাধারণ মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়।
তিনি বলেন, আমাদের বড় দুর্যোগ ছিল ঘূর্ণিঝড়। বিভিন্ন সময় ঘূর্ণিঝড়ে হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। কখন কখন এটা লাখের উপড়ে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু এখন এটা কমে এসেছে। এই মৃত্যু হার কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে আমাদের পূর্বাভাস দেওয়ার সক্ষমতা উন্নত হয়েছে আর মানুষও সচেতন হয়েছে।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আমরা ২০১০ সাল থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে গাণিতিক মডেলের ব্যবহার করে আসছি। বল যায় ২০১০ সালের পর থেকে আমাদের ফোরকাস্ট সিস্টেম উন্নত হয়েছে। এর আগে গতানুগতিক পদ্ধতিতে পূর্বাভাস দেওয়া হতো।এ ছাড়া আমাদের দেশের আবহাওয়াবিদরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। প্রতিনিয়ত আমাদের গবেষণা হচ্ছে। আমাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত টেকনোলজি ব্যবহার করছি। উন্নত বিশ্বের মডেলগুলো সঙ্গে আমাদের নিজস্ব মডেল সমন্বয় করা হয় । সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ফোরকাস্টের মান উন্নতি হয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাস কতটা নির্ভরযোগ্য— এমন প্রশ্নের জবাবে আবহাওয়া অধিদপ্তরের আরেক আবহাওয়া বিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, সারা পৃথিবীতে তিন দিনের পূর্বাভাস গ্রহণযোগ্য। আবহাওয়ার পূর্বাভাস ভুল বলার অধিকার মেট্রোলজিতে নেই। আপনাকে স্কিল অনুযায়ী বলতে হবে। অর্থাৎ আমি একটা পূর্বাভাস দিলাম ঢাকায় বৃষ্টি হবে। কিন্তু সেটা ভেরিফিকেশন করতে হবে। যে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে সে অনুযায়ী বৃষ্টি হল কিনা। এখানে কতগুলো স্কিল টেস্ট হয়। সেটার আবার অ্যানালাইসিস করতে হয়। সুতরাং আমরা যে পূর্বাভাস দিই বা সারা পৃথিবী যে পূর্বাভাস দেয় তার তিন দিন পর্যন্ত একদম সঠিক থাকে। পাঁচ দিনে গেলে সময় এবং স্থানের ব্যত্যয় ঘটতে পারে। পাঁচ দিন পর্যন্ত মোটামুটি সহনশীল। অর্থাৎ যে স্থানে বলা হয় তার পাশে ঘটতে পারে আবার যে সময় উল্লেখ করা হয় তার থেকে কিছু সময় আগে পরে হতে পারে। যদি সাত দিন বলা হয় তখন আরেকটু ব্যত্যয় ঘটতে পারে। তবে সার্বিকভাবে তিন দিন থেকে ১০ দিন পর্যন্ত কিছুটা সম্পূর্ণ না হলেও অনেকটা নির্ভুল তথ্য দেওয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, আমরা আগে পূর্বাভাস দিয়েছি ২৪ ঘণ্টা করে। এটা এখন পরিবর্তন হয়েছে। গত বছর থেকে আমরা তিন দিনের পূর্বাভাস দেওয়া শুরু করেছি।
তাহলে কেন এত বিতর্ক হয়— এমন প্রশ্নে এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে বলা হল আজ ঢাকায় বৃষ্টি হবে। দেখা গেল কিছু জায়গায় বৃষ্টি হয়েছে আবার কিছু জায়গায় হয়নি। যেখানে বৃষ্টি হয়েছে তারা মনে করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ঠিক আছে। আবার যেখানে বৃষ্টি হয়নি তখন ওই এলাকার সাধারণ মানুষ মনে করে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস ভুল। এ নিয়ে মানুষের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। কারণ একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা অনেকটাই অসম্ভব কেন ঢাকার একাংশে বৃষ্টি হল অন্য অংশে হল না।
এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, যখন একটি বজ্রমেঘ তৈরি হয়, তখন তার দৈর্ঘ্য হয় ১৮ থেকে ২৪ কিলোমিটার। এর প্রস্থ ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার। যেটা ঢাকার দৈর্ঘ্য-প্রস্থর চেয়ে ছোট। বজ্রঝড় সাধারণত উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে চলাচল করে। অর্থাৎ মেঘটি সিলেটে তৈরি হলে এটি কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ঢাকা পর্যন্ত আসতে পারে। এটি কখন সরল রেখা বরাবর আসে আবার কখন কোন উঁচু স্থানে সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে জিগজ্যাগ বা আঁকাবাঁকা পথে আসে। এটা যে বরাবর যায় সে বরাবর বৃষ্টি হয়।
তিনি বলেন, একটি বজ্রঝড় উপরের বাতাসের গতিবেগের ওপর নির্ভরশীল। উপরের বাতাসটা পশ্চিম দিক থেকে পূর্ব দিকে যাচ্ছে এখন। ঘনীভূত মেঘের ত্রিমাত্রিক একটি অংশটিকে পশ্চিমা বাতাস তাকে পূর্ব দিকে পুশ করে। সে জন্য পশ্চিমের মেঘগুলো পূর্ব দিকে যায়। এই ঝড়ের সঙ্গে বৃষ্টিপাত থাকে এবং প্রচণ্ড বেগে বাতাস নিচে নেমে আসে। কিছু বাতাস আবার মেঘের মধ্যে দিয়ে উপরেও যায়। যখন বজ্রঝড় পরিপক্বতা পায় তখন বজ্রঝড়ের ভেতরের বাতাস বৃষ্টিসহ নিচের দিকে ধাবিত হয়। পরে এটি পৃষ্ঠের সঙ্গে আঘাত লাগে পূর্বদিকে অথবা উত্তর পূর্ব দিকে ধাবিত হয়। বজ্রঝড়ের ত্রিমাত্রিক গঠন প্রক্রিয়ার কারণেই তার গতি বিভিন্ন স্পাইরাল মুভমেন্টে ধাবিত হয়। যে বরাবর এই মেঘটা যায় সেদিকে বৃষ্টিপাত হয়। আবার যখন পাশাপাশি অনেকগুলো মেঘ অবস্থান করে তখন দেখা যায় অনেক এলাকা জুড়ে বৃষ্টি হয়।
এই আবহাওয়াবিদ বলেন, আমাদের দেশে প্রযুক্তির অগ্রগতির পাশাপাশি আবহাওয়া নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জানা বোঝার উন্নতি হয়েছে। তবে দীর্ঘতর পূর্বাভাসের ক্ষেত্রে এখনো অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমরা চেষ্টা করছি আরও বেশি নির্ভুল তথ্য সরবরাহ করতে। আমাদের রাডারের সংকট রয়েছে। রাডার যদি বেশি থাকে তাহলে নাউ কাস্টিং এর সুবিধাটা পাব। এ ছাড়া আমাদের যে স্যাটেলাইট রয়েছে সেটা কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট ডেটা আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহার করে থাকি। আমাদের জন্য আলাদা করে পে-লোডের প্রয়োজন। সেখানে বিভিন্ন ধরনের ক্যামেরা থাকে আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য। কিন্তু সেসব নেই। আমাদের এয়ারক্রাফট পর্যবেক্ষক দরকার, আমাদের ফোর কাস্টিং এর জন্য দক্ষ প্রোগ্রামার দরকার। আবহাওয়া অধিদপ্তরের যে সাংগঠনিক কাঠামো বাস্তবে রূপ নিলে আবহাওয়া অধিদপ্তর আরও স্মার্ট হয়ে উঠবে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।