হাসিন আরমান : ২০০৫ সালের ১০ই জুন। চাঁদপুর সদর হাসপাতাল রাতটা প্রতিদিনকার মতোই কর্মচঞ্চল। পরিবারের সবাই অপেক্ষা করছে নতুন অতিথি আসবে বলে। সবার মাঝেই অদৃশ্য এক স্তব্ধতা কাজ করছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত তিনটা বাজতেই ভাঙল সকলের নিরবতা–দু’জন নবজাতকের কান্না! একই মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিল দুটি ফুটফুটে জমজ বোন।

প্রবাসী বাবা সৈয়দ মোশারফ হোসেন ও গৃহিণী মা রোকেয়া বেগম বড় মেয়ের নাম রাখলেন খাদিজাতুল মীম, ছোটোটার নাম দিলেন আরোয়াতুল মুনতাহা। জন্ম পরবর্তী ২০ বছরে এই দুই বোনের জীবন যেন স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার হাতে লেখা–স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে যাত্রা একসাথে, একই বেঞ্চে। বর্তমানে তারা কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষে রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়ে অধ্যয়নরত রয়েছেন।
যাত্রাটা শুরু স্কুল থেকে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন সুদ্রা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, এরপর সুদ্রা তৈয়ব আলী উচ্চ বিদ্যালয়ে একইসাথে মাধ্যমিক এবং ছোটতুলাগাঁও মহিলা কলেজে উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার করেন। এদিকে মেধার দিক দিয়েও কেউ কারোর থেকে কম না। এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই দুজনের জিপিএ-৫।
স্কুল-কলেজ গণ্ডি পার করে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতে দু’জন দুই হলে বসেও ৭৭.৫০ (মীম) এবং ৭৬.৭৫ (মুনতাহা) প্রায় কাছাকাছি নম্বর পাওয়ার মাধ্যমে বিস্ময়করভাবে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই বিভাগে ভর্তিও হয়েছেন। এসবকিছুই তাদের কাছে এখনও স্বপ্নের মতো মনে হয়।
খাদিজাতুল মীম এবং আরোয়াতুল মুনতাহা–দুই জমজ বোনের ছোট থেকে বেড়ে উঠা, অভিজ্ঞতা, পথচলা, ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা জানতে এবং জানাতে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন হাসিন আরমান।
প্রতিবেদক: ছোটোবেলা থেকে একসাথে পড়ার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
খাদিজাতুল মীম: ‘বলতে গেলে অনেক ভালো। কারণ একসাথেই পড়তে বসতাম, কোনো সমস্যা হলে আমরা দুইজন মিলে সলভ করতাম। এখন কুবিতে ও ইনশাআল্লাহ একসাথে আছি।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘ছোটোবেলা থেকে একসাথে থাকা এটা সত্যি আল্লাহর আশীর্বাদ। ছোটোবেলার কথা বা এখনকার কথাও যদি বলি, আমি আর মীম একসাথে পড়তে বসলে কঠিন পড়াগুলোও অনেক সহজে গুছিয়ে আনতে পারি। মীমকে আমি সহপাঠী হিসেবে যখন আড়াই মাস এর জন্য হারিয়েছি (বিইউপিতে), তখন আমার পড়াশোনায় কিছুতেই মন বসতো না। এরপর যখন দুই জনেরই কুবিতে একই সাবজেক্ট এ আসে তখন একসাথে ভর্তি হয়। ছোটোবেলা থেকে ওর সাথে থাকার কারণেই সত্যি আজ পর্যন্ত কোনো কঠিন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়নি।’
প্রতিবেদক: আপনাদের দীর্ঘ পথচলায় পরিবারের ভূমিকা কেমন ছিল?
দুইবোন: ‘পরিবার অনেক সাপোর্ট দিয়েছে আমাদের পথ চলায়। বিশেষ করে ভাইয়ারা অনেক সাপোর্ট করতো। সবাই অনেক হেল্প করেছে।’
প্রতিবেদক: স্কুল ও কলেজে একসাথে পড়ার কারণে কি কি সুবিধা ও অসুবিধার মুখোমুখি হয়েছেন?
খাদিজাতুল মীম: ‘পড়াশোনায় তেমন সমস্যায় পরতে হয় নাই। বরং আরো উপকার হয়েছে। এছাড়া ও(মুনতাহা) অলওয়েজ সাপোর্ট করে যে-কোনো কাজে। আর অসুবিধা বলতে এখনো কোনো ছেলের দিকে ও (মুনতাহা) তাকাতে দেয়নি।”
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘একসাথে পড়তে গেলে সুবিধার মধ্যে ছিল যেমন একটা ম্যাথ করতে গেলে দুই জনের দুই ধরনের চিন্তা থেকে দুই ধরনের প্রসেস পাওয়া আর অসুবিধার মধ্যে স্পেশাল ছিল সিঙ্গেল থাকাটা।’
প্রতিবেদক: পরীক্ষার সময়টাতে একে অপরকে কীভাবে সহযোগিতা করতেন?
খাদিজাতুল মীম: ‘আসলে ওই রকম হেল্প করার সুযোগ পাইনি। একাডেমিক এ স্যাররা আলাদা বসাইত আর এডমিশনে সব গুলোই আলাদাই দিতে হয়েছে।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘পরীক্ষার আগের রাতে দুইজনে মিলে পড়া গুছিয়ে আনতে পারার মতো এমন একজন সঙ্গী আমার মীম।’
প্রতিবেদক: আপনাদের দু’জনের মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
খাদিজাতুল মীম: ‘এটা আসলে বলা কঠিন।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘এটা অনেক কঠিন প্রশ্ন ছিল। কারণ একই ড্রেস পরে ছবি তুললে আমি নিজেই গুলিয়ে ফেলি যে আমি কে আর মীম কে।”
প্রতিবেদক: কখনো একে অপরের থেকে দূরে থাকাকালীন অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
খাদিজাতুল মীম: ‘অনেক কষ্ট হয়েছিল। মৌ (মুনতাহা) ১৬ মার্চ যখন বিইউপিতে যায়, তখনই ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময়। তখনই প্রথম একা থাকা হয়। আমি আম্মু-আব্বুকে ছাড়াও থাকতে পারি এতটা খারাপ লাগে না। এখনও ওরে ছাড়া একা থাকাটা ইমাজিন করতে পারি না, জানি না সামনে কী হয়!’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘আমি মীমকে ছাড়া সবসময় একাকিত্ব অনুভব করি। মীমকে ছাড়া আমার আড়াই মাস ছিলো সবচেয়ে কঠিন সময়। তখন কোনো অনুভূতি শেয়ার করতে পারতাম না। আমাদের এইজীবনে একে অপরকে ছেড়ে থাকার সবচেয়ে লং টাইম ছিল এটা।’
প্রতিবেদক: ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে কোনো ভয় কাজ করে?
খাদিজাতুল মীম: ‘আগে আমি সবচেয়ে বেশি ভয় পাইতাম চান্স পাওয়া নিয়ে কারণ ঐটা আমার আম্মুর স্বপ্ন ছিল। আর এখন ভয় কাজ করে সেটা হলো, বাবা-মার সম্মান রেখে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব কিনা সেই ভয়।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘মীম আর আমার মধ্যে কোনো ভুল বোঝাবুঝি নাই। তাই আমাদের বন্ডিং নিয়ে আমার ভয় নাই। জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভয় যেটা এখন কাজ করে, সেটা হচ্ছে নিজের সফলতা অর্জন পর্যন্ত বাবা মাকে পাশে পাবো কি না।”
প্রতিবেদক: ভবিষ্যতে একসাথে কাজ করার সুযোগ তৈরি হলে কেমন লাগবে?
খাদিজাতুল মীম: ‘অনেক ভালো লাগবে, কিন্তু জানি না কি হয়! একসাথে কাজ করতে পারাটা অনেক ভাগ্যের, দোয়া করবেন যেন ভবিষ্যতে একসাথে একই সেক্টর এ কাজ করতে পারি।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘যেহেতু ছোট থেকে আমি মীম এর সাথে থেকেছি, আমার সমস্যার সমাধান হিসেবে সবসময় ওকে পাশে পেয়েছি। তাই ওকে প্রফেশনাল পার্টনার হিসেবে পাওয়াটা আমার কাছে সৃষ্টিকর্তার দেওয়া সবচেয়ে বড়ো পাওয়া হবে। আমাদের জন্য আশীর্বাদ রাখবেন যেন, ভবিষ্যৎ পথচলাটা আমাদের একসাথে হয়।’
প্রতিবেদক: পরিচিতদের মধ্যে কেউ কি আপনাদের গুলিয়ে ফেলে?
খাদিজাতুল মীম: ‘পরিবার বা কোনো কাছের রিলেটিভ ছাড়া প্রায় সবাই গুলিয়ে পেলে। তবে ফ্রেন্ডরা আবার আলাদা করতে পারে।’
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘পরিবারের সদস্যদের ছাড়া প্রায় সবাই গুলিয়ে ফেলে। ফ্রেন্ডরা আলাদা করে চশমার ফ্রেম দিয়ে। আর প্রায় সবাই গুলিয়ে ফেলে।’
প্রতিবেদক: যমজ হিসেবে তোমরা একে অন্যের জন্য কী বার্তা দিতে চান?
খাদিজাতুল মীম: ‘আমি চাই জীবনে ও(মুনতাহা) সবচেয়ে ভালো পর্যায়ে যাক আর ভালো থাকুক এইটুকুই।”
আরোয়াতুল মুনতাহা: ‘আমি লাইফে যেটা অর্জন করি আমি চাই মীম আমার থেকে আরো বেটার কিছু অর্জন করুক। আমি আমার এমন কোনো অবস্থান চাই না যেটা আমার আর মীমের মধ্যে ব্যবধান হিসেবে থাকবে।’
সরকার অবশ্যই শেখ হাসিনার প্রত্যর্পণ চায় : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
এই দুই বোনের গল্প শুধু রক্তের সম্পর্কের নয়; এটি বন্ধুত্ব, ভালোবাসা, পারস্পরিক সমর্থন ও আত্মবিশ্বাসের গল্প। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত তাদের যাত্রা দেখায়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত ভাগাভাগি করাই তাদের শক্তি। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে যখন তারা পাশাপাশি হাঁটে, তখন বোঝা যায়–কিছু সম্পর্ক কখনো আলাদা হয় না, বরং সময়ের সঙ্গে আরও গভীর হয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।



