জুমবাংলা ডেস্ক : বাংলাদেশের টাঙ্গাইলের শাড়িকে ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক বা জিআই ঘোষণা নিয়ে গত সপ্তাহ থেকেই চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। এরই মধ্যে টাঙ্গাইলের শাড়ির পাশাপাশি নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা ও গোপালগঞ্জের রসগোল্লাকেও জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ নিয়ে দেশে জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে ২৪টি পণ্য।
বাংলাদেশের প্রায় সব জায়গায়ই কলা চাষ হয়। বারো মাসি ফল হিসেবে এর সুনাম রয়েছে।
তবে, নরসিংদীর এই অমৃত সাগর কলা কেন জিআই পণ্য? অথবা গোপালগঞ্জের রসগোল্লারই কি এমন বিশেষত্ব রয়েছে যা এটিকে ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে?
নরসিংদীর অমৃত সাগর কলা চাষ করেন এমন কয়েকজন চাষী ও কৃষি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মুঘল আমল থেকে এই কলার চাষ হয় এ এলাকায়। এর স্বাদ ও ঘ্রাণই একে অন্য কলার চেয়ে আলাদা করেছে। শুধু নরসিংদীর মাটিই এই কলা চাষের জন্য উপযোগী।
তেমনি, গোপালগঞ্জের রসগোল্লার রয়েছে ৮৬ বছরের ইতিহাস। দত্তের মিষ্টান্ন ভাণ্ডার নামে বংশ পরম্পরায় তিন প্রজন্ম এ রসগোল্লা তৈরির ব্যবসা করছেন।
এ মিষ্টির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হিসেবে বলা হচ্ছে, যতটুকু না দিলেই নয় চিনি ততটুকু দেয়া হয়, দুধের মিষ্টিটাই এর অন্যতম অনুষঙ্গ।
রোববারই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে টাঙ্গাইলের শাড়িসহ তিন পণ্যের স্বীকৃতির সনদ হস্তান্তর করা হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর জিআই স্বীকৃতির এই গেজেট প্রকাশ করে।
নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার বৈশিষ্ট্য
মুঘল আমল থেকেই এই এলাকায় অমৃত কলার চাষ হয় বলে দাবি করেন জেলা কৃষি কর্মকর্তারা।
ঢাকায় নিযুক্ত ২৯ জন মুঘল সুবেদার, ৪৮ জন ইংরেজ লর্ডসহ পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শাসকদের জন্য এই অমৃতসাগর কলা সরবরাহ করা হতো।
শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রীয় অতিথিদেরও নরসিংদীর সাগর কলা দিয়ে আপ্যায়ন করা হতো। এখনও বিভিন্ন সরকারি অনুষ্ঠানে এই কলার বিশেষ চাহিদা রয়েছে বলে জানা যায়।
বারোমাসি এই অমৃতসাগর কলার জন্য নরসিংদী বিখ্যাত।
এ কলা নরসিংদী সদর, পলাশ, রায়পুরা, ঘোড়াশাল, শিবপুর, শিলমান্দি ও মনোহরদী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় চাষ করা হয়।
অমৃত সাগর কলার সাথে অন্য কোনো কলার তুলনা হয় না বলে জানান কলা চাষি ও কৃষি কর্মকর্তারা।
মাঝারি আকার ও হলুদ রঙের এ কলার স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয়। অমৃত সাগর কলা পাকলে বাগান সুগন্ধে ভরে যায়।
অমৃত সাগর কলাকে ‘নরসিংদীর ব্র্যান্ড’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
নরসিংদীর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা স্বাক্ষর চন্দ্র বণিক বিবিসি বাংলাকে বলেন, “নরসিংদীর মাটির গুণেই এই কলার মিষ্টি গন্ধ ও মিষ্টি স্বাদ হয়। এখানকার অম্লীয় লাল মাটি এই কলা চাষের জন্য যথার্থ। যে আবহাওয়া দরকার তা শুধু নরসিংদীর মাটিতেই রয়েছে”।
‘এই কলা অন্য কোনো জেলায় রোপণ করলেও নরসিংদীর অমৃত সাগর কলার মতো গন্ধ ও স্বাদের হয় না’, দাবি বণিকের।
শুধু নরসিংদী জেলা সদরেই ৫০ শতাংশ অমৃত সাগর কলা চাষ হয়। যে কয়টি এলাকায় এই কলার চাষ বেশি হয় তার মধ্যে শিলমান্দি ইউনিয়ন অন্যতম।
এই ইউনিয়নে ৩৫০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়। আর এর ২০০ হেক্টর জমিতেই শুধু অমৃত সাগর কলা চাষ হয় বলে জানান বণিক।
কৃষি কর্মকর্তারা জানান, শিলমান্দি, মনোহরদি এসব ইউনিয়নের প্রতিটি বাড়ির সাথেই অমৃত সাগর কলা গাছের বাগান দেখা যায়।
বাগান থেকে পাইকারি দরে এক ছড়ি কলা এখন ৯০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এক হালি কলার দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা। অন্য যে কোনো কলার অমৃত সাগরের দাম ও বেশি বলে জানান কৃষি কর্মকর্তা ও কলা চাষিরা।
এক সময় নরসিংদীর এই কলা এতই জনপ্রিয় ছিল যে তা পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়ের বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালু করা হয়। যে ট্রেনের নাম ছিল ‘কলার গাড়ি’।
সন্ধ্যার পর ‘কলার গাড়ি’তে তুলে এসব কলা দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠানো হতো।
শিলমান্দি ইউনিয়নের অধিবাসী মাসুদ ভুঁইয়া বংশ পরম্পরায় অমৃত সাগর কলা চাষ করেন।
তিনি বিবিসি বাংলাকে জানান, ‘বংশ পরম্পরায় প্রায় ৬০ বছর ধরে এই অমৃত সাগর কলার চাষ করি। বাবার পর এখন আমিও এই কলা চাষ করি’।
সারা বছরই এই অমৃত সাগর কলা চাষ হয় তবে, শীতকালে একটু কম হয় এই কলা।
ভুঁইয়া জানান, ‘এক শ’ শতাংশের উপরে জমিতে অমৃত সাগর কলা চাষ করি। অন্য যে কোনো কলার চাইতে এটি অনেক বেশি সুস্বাদু। তবে, দেশের অন্য কোনো এলাকার মাটিতে এটি ভালো হবে না’।
২০২৩ সালে এই অমৃত সাগর কলা ও সবজি চাষের জন্য সফল কৃষক হিসেবে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর থেকে পদক পেয়েছেন মাসুদ ভুঁইয়া।
নরসিংদীর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক সালাহ উদ্দিন টিপু বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘জেলার ৫০০ থেকে ৫৬০ হেক্টর জমিতে এই অমৃত সাগর কলার চাষ হয়। আগে আরো বেশি চাষ হতো। এখন বাগান কেটে শিল্পায়নের কারণে তা কমে গেছে’।
‘আবার কেউ কেউ বেশি লাভের আশায় অন্য কলা চাষের দিকে ঝুঁকছে, শাকসবজির চাষ বেশি করছে’, জানান উদ্দিন।
তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর ৬০ থেকে ৭০ কোটি টাকার এই অমৃত সাগর কলা বিক্রি করা হয়। দেশের বাহিরেও রপ্তানি করা হয় এই কলা’।
গোপালগঞ্জের রসগোল্লা বিখ্যাত যে কারণে
১৯৩৮ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে গোপালগঞ্জের তৎকালীন মুনসেফ আদালত এলাকা, বর্তমান সাব রেজিস্টার কার্যালয়ের সামনে একটি আমগাছের নিচে বসন্ত কুমার দত্ত এই রসগোল্লার ব্যবসা শুরু করেন।
ছোট্ট একটা ঘরে বসন্ত কুমার তার ১৪ বছরের ছেলে সুধীর কুমার দত্তকে নিয়ে মিষ্টি তৈরি শুরু করেন। স্বাদের কারণে সে সময়ই এই রসগোল্লা সাড়া ফেলে।
দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মালিক সবুজ দত্ত বিবিসি বাংলাকে বলেন, ‘তিন প্রজন্ম ধরে এই ব্যবসা চলছে। না খেলে এর বিশেষত্ব বোঝা মুশকিল। ঠাকুরদাদা বসন্ত কুমার দত্তের হাত ধরে ব্যবসা শুরু। পরে বাবা সুধীর কুমার দত্ত এতে নিয়োজিত হন’।
‘২০১৯ সালে বাবা সুধীর কুমার দত্ত মারা যাওয়ার পর পৈত্রিক ব্যবসায় রয়েছেন তিন ভাই’ জানান সবুজ দত্ত।
এই রসগোল্লার বৈশিষ্ট্য কী? জানতে চাইলে দত্ত জানান, ‘অনেক তুলতুলে, হাল্কা মিষ্টির জন্য এটি বেশ বিখ্যাত। মুখে দিলে নিমেষেই এটি মিলিয়ে যায় অর্থাৎ মুখে লেগে থাকে না, এতো মোলায়েম হয়’।
‘মিষ্টি তৈরিতে যতটুকু চিনি না দিলেই নয় শুধু ততটুকুই দেয়া হয়, বাকিটা দুধের ঘনত্বের কারণে মিষ্টি হয়। মিষ্টি তৈরিতে কোনো সুজি, রং বা পাউডারের দুধ ব্যবহার করা হয় না’, জানান দত্ত।
একটাই শোরুম রয়েছে এই দত্ত মিষ্টান্ন ভান্ডারের।
বর্তমানে গোপালগঞ্জের কোর্ট চত্বরের কাছে ডিসি মার্কেটে এই দোকানটির অবস্থান।
কেজি হিসেবে নয় বরং পিস হিসেবে এই রসগোল্লা বিক্রি হয় বলে জানান দত্ত।
‘ছোট, বড় দুই সাইজেই পাওয়া যায় এই রসগোল্লা। প্রতিদিন ৫০০ পিসেরও বেশি রসগোল্লা তৈরি করা হয়। তবে, চাহিদা থাকলে আরো বেশিও তৈরি করতে হয়’, বলেন সবুজ দত্ত।
প্রতি পিস রসগোল্লা দশ টাকা করে বিক্রি করা হয়।
যারা এই দত্তের মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে কারিগর তাদের কেউ কেউ ২০-৩০ বছর ধরে কাজ করছেন বলে জানা যায়।
অন্য স্থানের রসগোল্লার সাথে এর পার্থক্য স্বাদ ও মান দুই ক্ষেত্রেই বলে দাবি করেন দত্ত।
তিনি বলেন, বিভিন্ন জায়গা থেকেও লোকজন এই রসগোল্লা খেতে আসেন, নিয়েও যান। একই সাথে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানসহ স্থানীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানেও এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
২০১৯ সালে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত রবার্ট মিলার গোপালগঞ্জ সফরে যান।
সে সময় তিনি তার স্ত্রীকে নিয়ে এই দত্ত মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের মিষ্টি খেতে সেখানে যান।
এছাড়া, ২০২২ সালে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির জন্য ২০ কেজি ছানার সন্দেশ পাঠানো হয়।
আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব বিষয়ক সংস্থা ‘ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস অর্গানাইজেশনে’র (ডব্লিউআইপিও) নিয়ম মেনে বাংলাদেশের শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে পেটেন্টস, ডিজাইন এবং ট্রেডমার্ক বিভাগ (ডিপিডিটি) জিআই স্বীকৃতি ও সনদ দিয়ে থাকে।
ডিপিডিটির তথ্য অনুযায়ী, রংপুরের হাড়িভাঙ্গা আম, নরসিংদীর লটকন, যশোরের খেজুর গুড়, জামালপুরের নকশী কাঁথা, মধুপুরের আনারস, সুন্দরবনের মধু, শেরপুরের ছানার পায়েস, নওগাঁর নাগ ফজলি আমসহ আরো মোট ১৩টি পণ্য জি আই বা ভৌগোলিক নির্দেশক সনদ প্রাপ্তির তালিকায় রয়েছে।
কোনো দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে; সেই সাথে, ভৌগোলিকভাবে ও ঐতিহ্যগতভাবে যে পণ্যগুলোকে ‘নিজস্ব’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা যায়, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ‘ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
যে সব পণ্য এই স্বীকৃতি পায়, সেগুলোর মাঝে ভৌগোলিক গুণ, মান ও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য থাকে।
একটা পণ্য যখন জিআই স্বীকৃতি পায়, তখন সেটিকে বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ডিং করা সহজ হয়।
তখন দেশে বিদেশে ওই পণ্যগুলোর একটি আলাদা কদর থাকে। শুধু তাই নয়, সনদ প্রাপ্তির পর ওই অঞ্চল বাণিজ্যিকভাবে পণ্যটি একাধারে উৎপাদন করার অধিকার এবং আইনি সুরক্ষা পায়।
অন্য কোনো দেশ বা অন্য কেউ তখন আর এই পণ্যের মালিকানা বা স্বত্ব দাবি করতে পারে না।
সূত্র : বিবিসি
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।