মাসুম খান : আব্দুস সোবহান খান, ডাকনামও একটা ছিল, কিন্তু তা এখানে উল্লেখ করব না। ওনার এক চাচাতো ভাই সবার সামনে নামটা উচ্চারণ করায় ওনার রাগের সম্মুখীন হয়েছিলেন। আমাদের দাদা, কারও কারও নানা; ওনার ভাতিজা-ভাতিজিদের কাছে চাচা, ভাগনে-ভাগনিদের কাছে মামা। ওনার বিদায় নেওয়ার তিন মাসেরও বেশি সময় পার হয়ে গেল, পরম করুণাময় তাকে শান্তিতে রাখুন।
৯৫ বছর বয়সে দাদা বিদায় নিলেন, যে বাড়িতে জন্মেছিলেন, সে বাড়িতেই। দাদার কথা ভাবতে গিয়ে মনে পড়ে যায়, “তালগাছ এক পায়ে দাঁড়িয়ে, সবগাছ ছাড়িয়ে” কবিতাটির কথা। আমাদের দাদা বট বৃক্ষ ছিলেন না, ছিলেন মাঠের কোনায় দাঁড়ানো তালগাছ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় তালগাছ একাকী, বটগাছের তুলনায় আস্থার প্রতীক নয়, বরং বিস্ময় উদ্রেককারী। কিন্তু তার ফলের এবং পাতার বিবিধ ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের জীবনের নানান কিছুতে তা কাজে লাগে, বিশেষ রস-সঞ্চার করে।
দাদা আজীবন অবিবাহিতই থাকলেন, তাঁর ভাতিজা-ভাতিজি, ভাগনে-ভাগনি, নাতি-নাতনিরাই ওনার পরিবার। আমাদের জীবনের প্রতিটি স্তরে স্তরে ওনার ভূমিকা ছিল। জন্মের পর সবার জন্ম তারিখ ওনার মনের খাতায় (এবং নোটবুকে) লিখে রাখতেন। সবার নামকরণে ওনার বিশেষ ভূমিকা থাকতো। সেই নতুন সদস্য যখন বড় হয়ে উঠছে, তখন তাদেরকে মসজিদের পুকুরে, বা রাম কৃষ্ণ মিশনের দিঘিতে গোসল করাতে নিয়ে যাওয়া, ভালো করে ডলে সাফ-সুতরা করা (অন্যত্র লিখেছিলাম, যেন মনে হতো চামড়ার নিচের ময়লা তুলে ফেলবেন), স্কুলে আনা-নেওয়া, আত্মীয়-স্বজনদের বাসায় নিয়ে যাওয়া, কিংবা শহরের নানান প্রান্তে দর্শনীয় স্থানগুলোতে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব উনি স্বেচ্ছায়, সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। আমাদের দুই প্রজন্মের বাইরের জগতের প্রথম গাইড ছিলেন দাদা। সবচেয়ে বড় বিষয় ছিল, সব জায়গায় যাতায়াত হতো পায়ে হেঁটে। দাদা নিজে চলাচলের সময় পদযুগলের ওপর নির্ভর করতেন। দুই প্রজন্মের সবারই একই অভিজ্ঞতা: দাদা দ্রুত গতিতে হাঁটছেন, আর সাথের বালক-বালিকারা হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটছে।
দাদার বিশেষ কিছু গুন ছিল, যা ছিল অতুলনীয়। প্রথম হচ্ছে ওনার স্মরণশক্তি। যে কোন তথ্য ধরে রাখার একটা বিস্ময়কর প্রতিভা ওনার ছিল। ওনার বিশেষ আগ্রহের বিষয় ছিল ইতিহাস: মানুষে মানুষে সম্পর্কের ইতিহাস। নানান তথ্য-ঠিকুজি ওনার মনে ধারণ করে রাখতেন। নিজের পরিবারের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশের প্রথিতযশা মানুষদের তথ্যও ধারণ করতেন। ওনার স্মরণশক্তিকেই বলে encyclopaedic memory। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, ৯৫ বৎসরে পৌঁছেও তার ধার কখনও কমেনি।
তাঁর দ্বিতীয় গুনটি হলো কোনো কিছু জানার প্রতি আগ্রহ, তাঁর অবিরল ঔৎসুক্য। নিয়মিত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দৈনিক খবরের কাগজ সহ নানান ধরনের পত্র-পত্রিকা পড়তেন, গুরুত্বপূর্ণ হলে তা সংগ্রহ করে রাখতেন। লেখার খাতায় তা কখনও নোট নিতেন। জানার আগ্রহ বা তথ্য সঞ্চারই তাঁর শেষ উদ্দেশ্য ছিল না। তথ্য-সম্প্রচারেও ওনার ছিল অপার আগ্রহ। আমরা নাতিরা কোনো প্রশ্ন করলে উৎসাহভরে সব তথ্য আমাদেরকে জানাতেন। ছোটবেলায় আমার একটি প্রিয় স্মৃতি হচ্ছে ওনার কক্ষে বসে ওনার সাথে প্রশ্ন-উত্তরে কথাবার্তা। গ্রীষ্মের দিনগুলোতে সাহরির আগ পর্যন্ত সজাগ থাকার একটা চল তখন ছিল। তারাবির নামাজ, খাওয়া দাওয়া শেষ করে, দাদার কক্ষে এসে সেই সব Socratic session চলতো সাহরির আগ পর্যন্ত: রুমের বাতি নেভানো, বারান্দার আলোতে আধো-আলোকিত ঘরে দাদা ওনার হুক্কা টানছেন, আর আমি তাকে প্রশ্ন করে যাচ্ছি। আজও কল্পনায় সেই সব কথা-বলার-রাতগুলো আর হুক্কার তামাকের গন্ধ মনে পড়ে।
দাদার তথ্য বিতরণের আরও একটি মাধ্যম ছিল চিঠি লেখা। কিছু ভাতিজা-ভাতিজি যখন প্রবাসী হয়ে গেলেন, তখন উনি তাদের কয়েকদিন পরপর চিঠি লিখতেন। সেসব চিঠি একান্ত ব্যক্তিগত চিঠি নয়, দু’এক শব্দ বা লাইনে ‘আশা করি ভালো আছো, শরীর-স্বাস্থ্যের যত্ন নিয়ো, খাওয়া দাওয়ায় অবহেলা হেলা করিও না” শেষ করে লেখা চলে যেতো সিলেটে কী হচ্ছে না হচ্ছে, দেশের খবরাখবরের একটা আপডেট জানানোতে। আমি দেখেছি দাদা একাধিক পত্রিকা নিয়ে বসতেন, সে আমলে প্রচলিত এয়ার মেইলের লম্বা পাতায় গোটা গোটা অক্ষরে ছোট ফুফু বা ছোট চাচাকে চিঠি লিখছেন। অনেকগুলো সিটিং শেষে সব চিঠি লেখা শেষ হতো, তারপর ডাকে পাঠানো হতো। চাচার মুখে শোনা: জার্মানির ম্যানহাইম শহরে চাচার বন্ধুরা, বা একই বাসার বাসিন্দারা, গোল হয়ে বসে দাদার চিঠি পড়ছেন। প্রাক-ইন্টারনেট যুগে, আশির দশকের সেই দিনগুলোতে দাদার সেই সব চিঠিগুলো জার্মানি বা সুইডেনের শীতল, বিরাণভূমে চাচা-ফুফুর কাছে যেন বাংলাদেশের রৌদ্র-জলের নমুনা, দাদার কলমে লেখা দেশ আর মাটির খবর। চাচার সেই সব দিনের বন্ধুরা আজকে নানান জায়গায় উচ্চ প্রতিষ্ঠিত, তারা সেই সব চিঠির কথা এখনও মনে রেখেছেন।
দাদার পরবর্তী আগ্রহ ভূগোল এবং ভ্রমণ। ছোট বেলায় দেখতাম প্রায়ই দাদা কয়েকদিনের জন্য ভ্রমণে বেরিয়ে যেতেন। হাতেকলমে দেশ দেখাতে ওনার অপার আগ্রহ। বাংলাদেশের কোন জেলায় যে উনি যাননি, তা ভাবার বিষয়। আমরা বলতাম দাদা ট্যুরে বেরিয়েছেন। জিজ্ঞেস করলে বলতেন কোন কোন জায়গা দেখে আসলেন। বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা-থানার নামও যেন ওনার সব জানা। একবার এক বন্ধুপত্নী তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া বলায় উনি পাল্টা প্রশ্ন করলেন “কোন উপজেলা, কোন গ্রাম?” সদ্য-পরিচিত কাউকে সাধারণ অন্য কেউ ভাল-মন্দ প্রশ্ন করবে, দাদা প্রশ্ন করতেন তার বাড়ি বা উৎসস্থল নিয়ে। তাঁর ভূগোলজ্ঞান শুধু বই পড়ে নয়, হাতে-কলমে দেখার মাধ্যমে, শোনার মাধ্যমে। আমার সাথে শেষবার দেখার সময়, অসুস্থ শরীরেও প্রশ্ন করলেন, বিমানটা কোন দেশের মাধ্যমে আসল, কতক্ষণ সেই বিমানবন্দরে ছিলাম। আমি যেদিন চলে যাব, ওনার খুব আগ্রহ বিমানবন্দরে আমাকে তোলে দিয়ে আসবেন, এক সুযোগে বাইরের জগৎটা দেখে আসবেন, অথচ দুইজন মানুষ লাগে তাকে তুলে বসিয়ে খাওয়াতে। শেষ দিনগুলোতে চলৎশক্তি রহিত হয়ে গেলেও বাইরের জগতের টান আর জানার আগ্রহ তখনও অটুট।
ব্যক্তি হিসাবে দাদা ছিলেন স্বল্পভাষী। সব কথা, সব ধরনের যোগাযোগ অল্প বাক্য-ব্যয়ে করতে চাইতেন। অনেক সময় ভাববাচ্যে কথা বলতেন, কর্তা বা subject এর নাম মুখে উচ্চারণ না-করে। আপাতদৃষ্টিতে এক ধরনের ঔদাসীন্য বা নিস্পৃহতা মুখে ধরে রাখতেন, কারও মনে হতে পারতো দুনিয়াদারি-সংসারে তাঁর কোনো আগ্রহ নেই: তবে বাস্তবে তা কিন্তু নয়। আমাদের সবার জীবনে কী ঘটছে তার প্রতি তাঁর অপার আগ্রহ ছিল, পরম মমতায়। মমতা প্রকাশের রীতিও ছিল তাঁর মত একক। কারও অসুখ-বিসুখ হলে চুপচাপ তাদের পাশে এসে বসে থাকতেন। আমরা নাতি-নাতনিরা কখনও তাকে খালি হাতে বাসায় আসতে দেখিনি, ‘বাচ্চাদের জন্য’ কিছু একটা থাকতো, বেশির ভাগ সময় বিস্কুট। ওনার নিজের খাওয়ার জন্য তাঁর কক্ষে বিস্কুটের কৌটা থাকতো, যা থেকে আমরাও ভাগ পেতাম। তাই তো তাঁর নাম পড়েছিল ‘বিস্কুট-দাদা’।
নতুন কিছু জানা, নতুন জায়গায় যাওয়া, ভালো কিছু পড়া, ভালো খাবারের প্রতি উনার আগ্রহ ছিল অপরিসীম। সামাজিক অনুষ্ঠান উনি বাদ দিতে চাইতেন না, গেলে পরিবারের তথা পরিচিত লোকজনদের সাথে দেখা হবে বলে। সারা জীবন এক ধরনের সন্যাস-জীবন কাটালেন, অথচ জীবন থেকে দূরে থেকে নয়। তাঁর জীবন-লিপ্সা (lust for life)ও তাঁর মত অতুলনীয়। তালগাছের কথায় ফিরে যাই: রবীন্দ্রনাথের তালগাছের মতো দাদারও যেন ইচ্ছা হতো সংসারের যাবতীয় “কালো মেঘ ফুঁড়ে” চলে যান, কারণ তাঁরতো “উড়ে যেতে মানা নেই,” কিন্তু শেষ পর্যন্ত মাটির টানে, নাড়ির টানে দাদা বাড়িতেই ফিরতেন। বিশ-বাইশ বছর দুই ভাতিজাদের পরিবারের সাথে থেকে দাদা পৈতৃক ভিটায় ফিরে আসলেন। তার অল্পদিনের ভেতরে তাঁর মায়ের কাছের মাটিতে শেষ শয্যা নিলেন।
আব্দুস সোবহান খান (২৯ অক্টোবর ১৯২৮ — ৮ ডিসেম্বর ২০২৩)
পিতা: করিম খান; মাতা: সাইফা বানু; “নিরিবিলি” নাইওরপুল, সিলেট।
লেখক: ইংরেজি প্রভাষক, নিউহাম কলেজ, লন্ডন, ইউকে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।