জুমবাংলা ডেস্ক : তেল দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অনেক বেশি। এ ছাড়া তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দেওয়ার দাবি রয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। অথচ এরই মধ্যে আবার ৬টি তেলভিত্তিক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সম্প্রতি এগুলোর মেয়াদ শেষ হয়েছে। গত মাসে মেয়াদ বৃদ্ধির সারসংক্ষেপ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হলে তিনি অনুমোদন দিয়েছেন। আগামী মাসে ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে এ প্রস্তাব তোলা হবে। সেখানেও এটি অনুমোদন হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তবে এ উদ্যোগকে বিতর্কিত এবং জনস্বার্থবিরোধী বলছে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়শেন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
এসব বিদ্যুৎকেন্দ্র ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ চুক্তিতে মেয়াদ নবায়ন করা হচ্ছে। অর্থাৎ এ বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে আগের চুক্তির মতো বিদ্যুৎ না দিলে কোনো ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এসব কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিটপ্রতি খরচ হয় ১৬ থেকে ১৮ টাকা। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর খরচ আরও বেশি। তবে সরকার অধিকাংশ ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে।
আবার মেয়াদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে রয়েছে- সামিট নারায়ণগঞ্জ পাওয়ার লিমিটেডের মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট, ওরিয়ন পাওয়ার মেঘনাঘাট লিমিটেডের মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট, ডাচ-বাংলা পাওয়ার অ্যান্ড অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, খুলনা পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট ও খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট এবং অ্যাকর্ন ইনফ্রাস্ট্রাকচারাল সার্ভিসেস লিমিটেডের জুলদা চট্টগ্রাম ১০০ মেগাওয়াট। এর মধ্যে মদনগঞ্জ কেন্দ্রের মেয়াদ গত ২২ মার্চ শেষ হয়েছে। মেঘনাঘাট, সিদ্ধিরগঞ্জ, নোয়াপাড়া ও খুলনা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ২৩ মার্চ এবং জুলদা কেন্দ্রের মেয়াদ শেষ হয়েছে গত ১৬ এপ্রিল।
বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, জরুরি বিদ্যুৎ সরবরাহের স্বার্থে তেলভিত্তিক বিশেষ করে ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সঙ্গে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু রেখে জরুরি সংকট সমাধান করা হয়।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাবের যুক্তিতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে-বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনার আওতায় ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বর্তমানে ক্যাপটিভ ও নবায়নযোগ্য জ্বালানিসহ বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ৩০ হাজার ২২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। বৃহৎ আকারের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পর দেশের বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় কুইক রেন্টাল ও রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্রমান্বয়ে অবসর দেওয়া হচ্ছে। ডিজেলভিত্তিক মোট ১৪০৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি, ফার্নেস অয়েলভিত্তিক মোট ৩৮০ মেগাওয়াট ক্ষমতার চারটি এবং গ্যাসভিত্তিক মোট ৬১৩ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আটটিসহ সর্বমোট ২৩৯৮ দশমিক ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৪টি আইপিপি রেন্টাল-কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রকে অবসর দেওয়া হয়েছে। সিস্টেম ফ্রিকোয়েন্সি রক্ষা, রিলায়াবিলিটি বৃদ্ধি এবং ট্যারিফ তুলনামূলক কম হওয়ায় কিছু কিছু রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ ‘নো ইলেকট্রিসিটি নো পেমেন্ট’ ভিত্তিতে বাড়ানো হচ্ছে। এরই মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ফার্নেস অয়েলভিত্তিক ৭৫৭ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৯টি এবং গ্যাসভিত্তিক ৫৫৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার পাঁচটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদনক্ষমতা ১১ হাজার ২৪০ মেগাওয়াট। জ্বালানির সীমাবদ্ধতার কারণে তরল জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ক্ষমতায় চালানোর ক্ষেত্রে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। গ্যাসের অপ্রতুলতার এ বাস্তবতা বিবেচনায় ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রসমূহ জরুরিভিত্তিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ বজায় রাখতে সহায়ক হবে।
সারসংক্ষেপে আরও বলা হয়, ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জ ১০০ মেগাওয়াট, মেঘনাঘাট ১০০ মেগাওয়াট ও মদনগঞ্জ ১০২ মেগাওয়াট রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ঢাকা অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে এরই মধ্যে অবসর দেওয়া হয়েছে, বিধায় ঢাকা অঞ্চলের বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও সিস্টেম রিলায়াবিলিটি রক্ষার স্বার্থে এ তিনটি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন। এ ছাড়া ডিজেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো জাতীয় গ্রিডে সংযুক্ত না থাকায় গ্রিড সচল রাখা, তাৎক্ষণিক বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলা ও লোডশেডিং এড়ানোর লক্ষ্যে নোয়াপাড়া ৪০ মেগাওয়াট, খুলনা ১১৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন। অন্যদিকে জুলদা ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে চট্টগ্রামের হালিশহর ও শিকলবাহায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। সে বিবেচনায় গ্রীষ্ম মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা মোকাবিলায় এ ছয়টি বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখা প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা পুরোপুরি কাজে লাগানো যাচ্ছে না জ্বালানি সংকটে। সরকারি হিসাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু জ্বালানি সংকটের কারণে গড়ে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের বেশি উৎপাদন করা যাচ্ছে না। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট ও ক্যাপাসিটি চার্জ দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের জন্য গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ থেকে যত দ্রুত সম্ভব মুক্ত হওয়া দরকার। তা না করে মেয়াদ বারবার বৃদ্ধি করা এ খাতের ওপর বোঝা আরও বাড়িয়ে দেবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেন, প্রথমত ক্রয়চুক্তিগুলো বিতর্কিত এবং জনস্বার্থবিরোধী। সে কারণে গণউপলব্ধিকে বিবেচনায় না নিয়ে সরকার এগুলোর মেয়াদ বাড়ালে তা আমাদের জন্য কল্যাণকর হবে না। রেন্টাল বিদ্যুৎ ক্রয়, দ্রুত বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ আইন করা, মেয়াদ বৃদ্ধি করা, বিইআরসির আইন পরিবর্তন করে নির্বাহী আদেশে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে মূল্য বৃদ্ধি-সবকিছু এ খাতে অসাধু ব্যবসার ক্ষেত্র বিস্তৃত করেছে এবং ব্যক্তিখাত বিনিয়োগকারীদের অবাধ মুনাফার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। রেন্টালের এই মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া এর থেকে বিচ্ছিন্ন কিছু নয়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।