আন্তর্জাতিক ডেস্ক : প্রিয় মানুষটির জন্য বিশাল দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার, এমনকি এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যাওয়ার অনেক নজির পাওয়া যায়। তবে তাই বলে বন্যপ্রাণীর রাজ্যে এমন কাণ্ড নিশ্চয় আপনি আশা করবেন না। তবে এমনই এক কাণ্ড করেছে সাইবেরিয়ার এক বাঘ। সঙ্গীর খোঁজে সে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাড়ি দেয় ২০০ কিলোমিটার পথ।
২০১৪ সালে রাশিয়ার পুব সীমানার দুর্গম এক অরণ্যে দুই অনাথ আমুর বাঘশাবককে মুক্ত করে দিয়েছিলেন রুশ বিজ্ঞানীরা। উদ্দেশ্য ছিল একটি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে বাঁচানো। আমুর টাইগার, যাকে সাইবেরিয়ান টাইগারও বলা হয়, এখনো বিপন্ন। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় আকারের বাঘ। কিন্তু সেই দিন বিজ্ঞানীরা নিজেদের অজান্তেই আশ্চর্য একটি কাণ্ড ঘটিয়েছিলেন, অসাধারণ এক প্রেমের গল্পের সূচনা।
শাবক দুটি বরিস ও স্ভেতলায়া, তাদের জন্মের কয়েক মাসের মধ্যেই মা-বাবাকে হারায়। তখন তাদের বয়স মাত্র তিন থেকে পাঁচ মাস। আমুর বাঘদের প্রধান ঘাঁটি শাখোতে-অ্যালিন পর্বতমালা থেকে তাদের উদ্ধার করা হয় । বন্দী অবস্থায় বেড়ে ওঠার পর ১৮ মাস বয়সে তাদের মুক্ত করে দেওয়া হয়। বিজ্ঞানীরা ইচ্ছা করেই তাদের আলাদা করে দিয়েছিলেন। বরিস ও স্ভেতলায়াকে পরস্পর থেকে ১০০ মাইলেরও বেশি দূরে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে আমুর অঞ্চলে বাঘের বিস্তৃতি আরও বাড়ানো যায়।
কিন্তু মুক্তির এক বছরেরও বেশি সময় পর আশ্চর্য এক ঘটনা ঘটল। বরিস প্রায় ১২০ মাইল (১৯৩ কিলোমিটার) পথ পাড়ি দিয়ে একদম সোজাসুজি স্ভেতলায়ার কাছে হাজির হয়ে যায়। যেন প্রকৃতি নিজেই তার জন্য এ পথের দিশা দেখিয়েছিল।
আর বাঘ দুটির এই দেখা হওয়ার ছয় মাস পর কয়েকটি শাবকের জন্ম দেয় স্ভেতলায়া।
এসব তথ্য জানা যায় মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন থেকে।
এটি ছিল বড় বিড়াল অর্থাৎ, বিগ ক্যাট প্রকৃতিতে পুনঃস্থাপনে এক ঐতিহাসিক সফলতা। স্পেনের আইবেরিয়ান লিংকস পুনর্বাসন প্রকল্প সফল হলেও এত দিন বড় বিড়ালদের ক্ষেত্রে এটি প্রায় অসম্ভব মনে করা হতো। কিন্তু জার্নাল অব ওয়াইল্ডলাইফে গত মাসে অর্থাৎ, নভেম্বরে প্রকাশিত একটি গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বলছেন, বরিস ও স্ভেতলায়ার এই গল্পটি বাঘ প্রকৃতিতে পুনঃস্থাপনে নতুন আশার দ্বার খুলে দিয়েছে।
রাশিয়ায় বর্তমানে আনুমানিক ৪৮৫ থেকে ৭৫০টি সাইবেরিয়ান বা আমুর বাঘ রয়েছে। কিন্তু গবেষকদের মতে, রাশিয়া-চীন সীমান্তের প্রি-আমুর অঞ্চলসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে আরও কয়েক শ বাঘের আশ্রয় দেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে।
বরিস ও স্ভেতলায়ার মিলনই এই প্রকল্পের একমাত্র সফলতা তা নয়। এর আগে এক শিকারি বরফের ঢিবিতে একটি মেয়ে বাঘ শাবককে খুঁজে পান। তার নাম রাখা হয়েছিল জোলুশকা—রুশ ভাষায় যার অর্থ ‘সিনড্রেলা’। পরবর্তীতে সংরক্ষণবাদীরা জোলুশকাকে অরণ্যে ফিরিয়ে দেন।
কিছুদিন পর ক্যামেরা ট্র্যাপে একটি পুরুষ বাঘের দেখা মেলে ঠিক সেই এলাকাতেই, যেখানে জোলুশকাকে ছাড়া হয়েছিল। বিশাল সেই এলাকায় এমন মিলন ছিল প্রায় অলৌকিক। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সংস্থার প্রধান বাঘ বিশেষজ্ঞ ডেল মিকুয়েল মজা করে বলেন, ‘সিনড্রেলার রাজকুমার ঠিক সময়ে হাজির হয়েছিল, আর তারা সুখে-শান্তিতে জীবন কাটাতে লাগল।’ জোলুশকা ও সেই পুরুষ বাঘের সংসারেও জন্ম নিয়েছিল শাবক, যেগুলো ছিল ১৯৭০-এর দশকের পর সেই অঞ্চলে জন্ম নেওয়া প্রথম বাঘশাবক।
এটি শুধু একটি বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্পের নয়, বরং প্রকৃতির অসাধারণ শক্তি আর ভালোবাসার অনন্য রূপেরও গল্প। সাইবেরিয়ার হিমশীতল পাহাড়ের বুকে বরিস, স্ভেতলায়া আর জোলুশকার কাহিনি যেন বলে যায়—প্রকৃতিতে সবকিছুরই জায়গা আছে, শুধু দরকার একটু যত্ন আর সময়।
রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা যখন ১৩টি অনাথ সাইবেরিয়ান বাঘশাবককে বন্দী অবস্থায় লালন-পালন করছিলেন, তখন তাদের সামনে ছিল এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। বন্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়ার আগে নিশ্চিত করতে হবে, এই শাবকেরা মানুষের কোনো ছোঁয়া পায়নি। কারণ তাদের শিখতে হবে বন্যজীবনের কঠিন বাস্তবতা—শিকার করা, টিকে থাকা।
তাই বিজ্ঞানীরা শাবকদের ক্রমশ পরিচয় করিয়ে দিলেন জীবন্ত শিকারের সঙ্গে। ছোট শাবকগুলো শিখতে শুরু করল শিকার করার কৌশল। কিন্তু এখানেই শেষ নয়, বন্য প্রকৃতিতে ছাড়ার সময়টাও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বসন্তকাল বেছে নেওয়া হয়েছিল, কারণ এ সময় খাদ্যের প্রাচুর্য থাকে।
তবে একটি পুরুষ বাঘ এই স্বাধীনতার পরীক্ষায় ব্যর্থ হয়েছিল। সে চীনে গিয়ে গৃহপালিত পশুর ওপর আক্রমণ চালায়—এক রাতে একটি খোঁয়াড়ে ঢুকে ১৩টি ছাগল মেরে ফেলে। শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা তাকে আবার ধরে এনে একটি চিড়িয়াখানার প্রজনন কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করেন।
কিন্তু বাকি ১২টি বাঘশাবক সফলতার সঙ্গে বন্যজীবনে ফিরে যেতে পেরেছিল। তারা প্রমাণ করল, বন্দী অবস্থায় বেড়ে ওঠা সত্ত্বেও তারা বন্য শিকারের দক্ষতা অর্জন করতে পারে এবং প্রকৃত বন্য বাঘের মতোই টিকে থাকতে পারে।
প্রি-আমুর অঞ্চলে যখন বাঘের সংখ্যা বাড়ছে, তখন রাশিয়ান-আমেরিকান বিজ্ঞানীদের দলটির বড় স্বপ্ন—এই অঞ্চলের বাঘগুলো একদিন সীমান্ত পেরিয়ে চীনের বাঘদের সঙ্গেও মিলিত হবে। ‘আমাদের মহাপরিকল্পনা হলো পুরো এলাকাটি সংযুক্ত করা।’ বলেন বিগ কেট প্রকল্পের নির্বাহী পরিচালক লুক হান্টার, ‘এখানে অনেক এলাকা রয়েছে, যেগুলো বাঘের জন্য পুনরায় উপযোগী করে তোলা যেতে পারে।’
এশিয়াজুড়ে সম্ভাব্য বাঘের আবাসস্থলের এলাকা বিশাল। ২০২৩ সালের একটি গবেষণায় উঠে এসেছে, প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার বর্গমাইল এলাকা বাঘের বসবাসের জন্য উপযুক্ত হলেও সেখান থেকে বাঘ হারিয়ে গেছে।
এই সফল প্রকল্প তাই বড় সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। ‘এই ফলাফল প্রমাণ করে, তরুণ শাবকদের একটি আধাবন্দী পরিবেশে লালন-পালন করে তাদের শিকার শেখানো এবং পরে বন্য প্রকৃতিতে ছেড়ে দেওয়া সম্ভব।’ বললেন রাশিয়ান একাডেমি অব সায়েন্সের অধীনে পরিচালিত সেভার্তসভ ইনস্টিটিউট অব ইকোলজি অ্যান্ড ইভোলিউশনের প্রাক্তন পরিচালক ভিয়াচেস্লাভ ভি রোজনোভ। তিনি প্রকৃতিতে বাঘ পুনঃস্থাপন প্রকল্পের নেতৃত্ব দেন।
তিনি বলেন, ‘এই গবেষণার ফলাফল এশিয়ার বিশাল অংশে বাঘ ফিরিয়ে আনার একটি নতুন পথ দেখায়। এসব অঞ্চলে এখনো উপযুক্ত পরিবেশ রয়েছে, কিন্তু বাঘ হারিয়ে গেছে।’
বরিস ও স্ভেতলায়া প্রায় অসম্ভব প্রেমের মতোই, রাশিয়ান ও আমেরিকান বিজ্ঞানীদের এই যৌথ প্রচেষ্টা প্রমাণ করেছে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার শক্তি।
‘জাতীয়তা আর রাজনীতি পেরিয়ে একসঙ্গে কাজ করলে সত্যিই ভালো কিছু অর্জন করা সম্ভব।’ বলেন প্রকল্পের প্রধান বাঘ বিজ্ঞানী ডেল মিকুয়েল, ‘কীভাবে সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রকৃতিকে পুনরুজ্জীবিত করা যায়, এটি তার একটি অনন্য উদাহরণ।’
এই গল্প শুধু বাঘ পুনর্বাসনের সাফল্যের নয়, বরং প্রকৃতি আর মানুষের একসঙ্গে পথ চলার গল্পও।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।