জুমবাংলা ডেস্ক : প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল। চলছে আরো দুটি মেট্রোরেলের কাজ, খরচ হবে ৯৪ হাজার কোটি টাকার মতো। ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআটি) গড়ার কাজে।
এর আগে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে আটটি ফ্লাইওভার ও ওভারপাস। সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। বিনিয়োগ করা হয়েছে ফুটওভার ব্রিজ, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ফুটপাতসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে। বিপুল এ বিনিয়োগের পরও ঢাকা এখন বিশ্বের শীর্ষ ধীরগতির শহর। এ বিষয়ে জানতে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব ও দুজন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কথা বলেছে এই প্রতিবেদক।
বিনিয়োগের ফল পেতে শুরু করেছে ঢাকাবাসী
এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী
সচিব, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ
ঢাকায় বলতে গেলে এখন আর তেমন যানজট হয় না। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর ১০ মিনিটে ফার্মগেট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চলে যাওয়া যাচ্ছে। বিমানবন্দরে নেমেই উত্তরা ফ্লাইওভার। এরপর টঙ্গী ফ্লাইওভার। ২০ মিনিটের মধ্যে ফার্মগেট থেকে টঙ্গী যেতে পারছে মানুষ, যা আগে কল্পনাই করা যেত না। আগামীকাল-পরশুর মধ্যে টঙ্গীতে আরেকটি ফ্লাইওভার চালু হবে।
মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কোনো জ্যাম নেই। ২০ অক্টোবরের পর মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে যানজট পরিস্থিতিই বদলে যাবে। ঢাকার পূর্ব দিকে ইস্টার্ন বাইপাস হচ্ছে—মোহাম্মদপুর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত। এর কাজ শেষ হবে আগামী বছর। শিগগির এর সুফল পাওয়া যাবে।
ঢাকা ছোট্ট শহর। অনেক বেশি মানুষ। এ অবস্থার মধ্যে সরকার ঢাকার পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, যেগুলোর ফল আমরা পেতে শুরু করেছি। চলমান প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতির আরো উন্নতি হবে। এ শহরের যানবাহনের গতি নিয়ে ম্যাসাচুসেটসের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের প্রতিবেদনের সঙ্গে আমি একমত নই। এটা অনেক আগের স্টাডি। নিশ্চয়ই আপডেটেড না। বর্তমানে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আর পৃথিবীর সব শহরে পিক আওয়ারে, অফিস-আদালত কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শুরু ও ছুটির সময় যানজট হয়। একটা শহরও পাওয়া যাবে না, যেখানে পিক আওয়ারে ট্রাফিক জ্যাম হয় না।
ঢাকার অবকাঠামো যেভাবে হচ্ছে তাতে ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়ছে
ড. সামছুল হক
অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
ঢাকা শহরে যানবাহনের গড় গতি প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে, এ তথ্য অনেক পুরনো। ১৯৯৭ সালে গড় গতি ছিল ঘণ্টায় ২৫ কিলোমিটার। সেখান থেকে কমতে কমতে ২০১৫ সালে তা ঘণ্টায় ৬ দশমিক ৭ কিলোমিটারে নেমে আসে। এসব তথ্য খোদ সরকারের বিভিন্ন প্রতিবেদনেই উঠে এসেছে। তবে ঢাকা দিন দিন স্থবির হয়ে যাচ্ছে, সেটা জানার পরও শহরটির গতি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
ঢাকার গতি বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হতে পারত যানবাহন, বিশেষ করে ছোট ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। উল্টো পাঁচ বছরে আট লাখ মোটরসাইকেল নামিয়ে দেয়া হয়েছে। যারাই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে নিবন্ধনের জন্য আসছে, সবাইকে ঢালাওভাবে তা দিয়ে দেয়া হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ইচ্ছেমতো গাড়ি কেনার সুযোগ করে দেয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য নমনীয় ঋণসহ দেয়া হচ্ছে নানা সুযোগ-সুবিধা। আমরা একদিকে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো বানিয়ে সড়কের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি, আবার একই সঙ্গে ইচ্ছেমতো যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
একটি শহরের পরিবহন ব্যবস্থার দুটি প্রধান দিক হলো চাহিদা ও জোগান। চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সড়কের সক্ষমতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে যানবাহনের জোগান দিতে হয়। ঢাকার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, এখানে সড়কের সক্ষমতার চেয়ে যানবাহন বেশি। আবার মোটা অংকের বিনিয়োগ করে সক্ষমতা যা একটু বাড়ানো হচ্ছে, তার বেশি গাড়ি জোগানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এর সিংহভাগই আবার ব্যক্তিগত গাড়ি। উল্টোদিকে যে গণপরিবহন ঢাকার যানবাহনের চাহিদা পূরণ করতে পারত, সেদিকে নজরই দেয়া হচ্ছে না।
ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় টেকসই উন্নয়ন করতে হলে ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বড় গাড়ি দিয়ে ছোট গাড়িকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এগুলো না করে যত উন্নয়নই করা হোক না কেন, তা টেকসই হবে না। স্বল্প মেয়াদে হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যাবে, কিন্তু তা কখনো স্থায়ী সমাধান হবে না।
গবেষণা ছাড়াই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে
ড. হাদিউজ্জামান
অধ্যাপক, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়
রাজধানীর পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ছিল পরিকল্পিত বিনিয়োগ। সড়কগুলোর সক্ষমতা কতটুকু এবং এসব সড়কে কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে তা নিরূপণের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর সে অনুযায়ী সমন্বিতভাবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টোটি। কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা না করেই নানা ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন সংস্থা, যাদের মধ্যে আবার কোনো সমন্বয় নেই। ঢাকায় গবেষণাভিত্তিক কোনো বিনিয়োগ যেহেতু হয়নি, ফলে এগুলো অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। সেহেতু বলা যায় সব বিনিয়োগ তলা দিয়ে বের হয়ে গেছে।
ঢাকা শহরের যানজটের যে কথাটা আমরা বলছি, এর দায়ভার সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে নিতে হবে। ঢাকা শহরের ভূমি ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে নাজুক। এখানে আর্টারি বা ধমনী রোড নামে যেসব সড়ককে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে, তার কোনোটিই আর্টারি রোডের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে যায় না। এসব সড়কের দুপাশে অনিয়ন্ত্রিতভাবে সুউচ্চ ভবন গড়ে তোলা হয়েছে। প্রত্যেকটা ভবন তাদের প্রয়োজনের স্বার্থে সড়কের সঙ্গে সংযোগ দিয়েছে। তাহলে এখানে গতি কীভাবে উঠবে? এ ভূমি ব্যবস্থাপনা দেখভালের দায়িত্ব তো রাজউকের। সরকারের এ সংস্থাটির পাশাপাশি সিটি করপোরেশনও পরিকল্পিত সড়ক অবকাঠামো গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে। ঢাকা শহরের সড়কগুলোর যানবাহন ধারণের সক্ষমতা কতটা তার উত্তর রাজউক বা সিটি করপোরেশন কেউই দিতে পারবে না। আবার ঢাকায় কত যানবাহন চলছে তার উত্তর দিতে পারবে না বিআরটিএ (বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি)। এমন অবস্থায় ঢাকায় যত বিনিয়োগই হোক না কেন, তার সুফল পাওয়া যাবে না।
যানজট নিরসনের মূল ভিত্তি হলো তিনটি—যানবাহনের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, সঠিক ভূমি ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা। এর জন্য কিন্তু বিনিয়োগের প্রয়োজন হয় না। এগুলো নীতিনির্ধারণী বিষয়। বছরের পর বছর এ বিষয়গুলোয় আমরা এতটা অবহেলা করেছি, যে ঢাকা শহর এখন অচল অবস্থার কাছাকাছি চলে এসেছে। পরিকল্পিত বিনিয়োগের পাশাপাশি সঠিক নীতিনির্ধারণ এবং প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীকরণের মতো পদক্ষেপ ঢাকার এ অচলাবস্থা কাটাতে পারে।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।