বিজ্ঞান ও প্রযক্তি ডেস্ক : স্মরণকালের ভয়াবহ তাপদাহে অতিষ্ঠ মানুষ। পারদ চড়তে চড়তে ৪৩ ডিগ্রিতে উঠেছে। প্রচণ্ড গরম আর লু হাওয়ায় জনজীবনে হাঁসফাঁস অবস্থা। বৃষ্টির কোন দেখা নেই। খরার মতো পরিস্থিতি। এর মধ্যে কোন সুখবর তো নেই-ই, উল্টো মে মাসেও এমন ধরনের তাপদাহ থাকবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়াবিদরা।
এমন অসহনীয় গরমের পরিস্থিতির মধ্যে আবারও জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে এল নিনোর কথা। বলা হচ্ছে এল-নিনোর প্রভাবেই প্রকৃতিতে এমন রিরূপ পরিস্থিতি, বদলে গেছে আবহাওয়ার খবর। আবার যখন প্রচণ্ড শীত পড়ে তখনও আলোচিত হয় লা-নিনা। আসলে কি এই এল নিনো এবং লা লিনা।
এল-নিনো আর লা-নিনো হলো স্প্যানিশ শব্দ। যার অর্থ হলো ‘ছোট্ট ছেলে’ আর অন্যটির অর্থ হলো ‘ছোট্ট মেয়ে’। দু’জনই দক্ষিণ আমেরিকার উপকূলের বাসিন্দা। প্রায় ১০০ বছর আগে সেখানকার জেলেরা সমুদ্রে মাছ ধরার সময় ওদের দেখতে পায়। সেই থেকেই তাদের এমন নামকরণ।
স্বভাবে একদমই বিপরীতধর্মী। এল-নিনো উষ্ণ, আর লা-নিনা শীতল। দু’জনের সঙ্গে সমুদ্রের গভীর সম্পর্ক। আসলে এল-নিনো এবং লা-নিনা হলো প্রাকৃতিকভাবে তৈরি একটি জলবায়ুর ধরন। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা এবং বায়ুমণ্ডলীয় চাপের ক্রমাগত পরিবর্তন থেকে এদেরকে মূলত চিহ্নিত করা হয়।
এই দুই পরিস্থিতির সাথে সমুদ্র ওতপ্রোতভাবে জড়িত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জলবায়ু তিনটি ধাপের মাধ্যমে একটি চক্র অতিক্রম করে। এই চক্রকে বলা হয় এনসো চক্র। এই তিনটি ধাপ হলো এল-নিনো, লা-নিনা; আর এ দুটি যখন প্রবল থাকে না, তখন তাকে বলা হয় এনসো নিউট্রাল।
আগেই বলা হয়েছে এই দুটো জলবায়ু পরিস্থিতির চরিত্র একেবারে উল্টো। এল নিনো হলো শুষ্ক মওসুম, যখন স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম বৃষ্টি হয় এবং বন্যাও কম হয়। এ সময় তাপমাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যায়। আর লা-নিনার সময় বেশি বৃষ্টি আর বেশি বন্যা দেখা যায়। তাপমাত্রা কমে যায় স্বাভাবিকের চেয়ে।
মধ্য ও পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের তাপমাত্রার ওপর নির্ভর করেই এর সংজ্ঞা। এখানে তাপমাত্রার একটা সীমা নির্ধারণ করে দেয়া আছে। দীর্ঘকালীন গড় তাপমাত্রা এই সীমার ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে নেমে গেলে তাকে বলা হয় লা নিনা আর ওপরে গেলে বলা হয় এল নিনো।
সচরাচর এই অবস্থা ৯ মাস থেকে ১২ মাস পর্যন্ত চলতে থাকে। কখনো কখনো ৩ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। দুই থেকে সাত বছর পরপর এই চক্র ফিরে আসতে পারে। সাধারণত এল নিনো শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লা নিনার গঠন শুরু হয়। অর্থাৎ এল নিনো হলে লা নিনা হতে পারে বলে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা এল-নিনো ও লা-নিনার কারণ প্রমাণসহ জানাতে । এল নিনো বিরাজ করে প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিম প্রান্তে। এটি সেই সময়, ওই অঞ্চলের বায়ুমণ্ডলের চাপ বাড়িয়ে দেয়। অন্যদিকে, লা নিনার সময় প্রশান্ত মহাসাগরের পশ্চিমে শীতল আবহাওয়া বিরাজ করে, কারণ সেখানে নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়।
আসলে, এল নিনো মানে প্রশান্ত মহাসাগরে উষ্ণ সমুদ্রস্রোত। এর ফলে উষ্ণ হয়ে ওঠে দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, বিশেষ করে পেরুর দিকের পানি। পুবালী বায়ু সাধারণত পেরু থেকে অস্ট্রেলিয়ায় দিকে বয়ে যায়। কিন্তু এল নিনো পরিস্থিতিতে এই বায়ুপ্রবাহ কমে যায় কিংবা উল্টো দিকে বয়ে যায়।
বায়ু তখন পূর্ব থেকে পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। ফলে যে সমুদ্রস্রোত উষ্ণ পানিকে অস্ট্রেলিয়ার দিকে নিয়ে যাবার কথা, তার দিকও উল্টে যায়। সমুদ্রস্রোতের টানে উষ্ণ পানি বয়ে যায় দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিম উপকূলের দিকে। এই পানি আসে অস্ট্রেলিয়া উপকূল থেকে। ফলে অস্ট্রেলিয়া উপকূলে পানি নেমে যায়।
আর বেড়ে যায় পেরু উপকূলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ও উচ্চতা। এসব পরিবর্তনের কারণে পেরুতে বায়ুর উর্ধ্বমুখী পরিচলন ঘটে। বাতাসের উর্ধ্বমুখী পরিচলন হলে, তা সঙ্গে করে সামুদ্রিক পানি নিয়ে যায়। পৌঁছে দেয় বায়ুমণ্ডলে। এই পানি বায়ুমণ্ডলে উচ্চচাপে ঘন হয়, ফলে তাপমাত্রাও কমে।
এক সময় ঝরে বৃষ্টি হয়ে। অর্থাৎ যে বৃষ্টি স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্ট্রেলিয়ায় হওয়ার কথা, তা হয় পেরুতে। অর্থাৎ, স্বাভাবিক আবহাওয়াকে একবারে একশ’ আশি ডিগ্রি ঘুরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে এল নিনো। ঠিক এমনটিই ঘটছে চলতি বছরে। গত বছরে শুরু হওয়া এল নিনোর প্রভাব এখন চরম অবস্থায় রয়েছে।
বাংলাদেশ, ভারত বা দক্ষিণ এশিয়ার এল নিনোর প্রভাবটা কী? পুবালী বায়ু যখন পূর্বে না বয়ে পশ্চিমে বয়ে যায়, তখন অস্ট্রেলিয়া থেকে শুরু করে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার- এই পুরো অঞ্চলটিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। কারণ, বাতাসের প্রবাহ সমুদ্রস্রোতকে বয়ে নিতে থাকে পশ্চিম দিকে।
আর বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শুকিয়ে যায় মাটি। এমনকি খরাও দেখা দিতে পারে। এই যে আবহাওয়ার চরিত্র বদলে দেয়া এল নিনো কখন হবে বা কেন হবে তা এখন ঠিক জানেন না বিজ্ঞানীরা।
আবহাওয়াবিদরা আর বিজ্ঞানীরা এল-নিনোর কিছু লক্ষণ বের করেছেন। সেগুলো হলো- ভারত মহাসাগর, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়ার ভূপৃষ্ঠের চাপ বেড়ে যাওয়া। তাহিতি, প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বে বায়ুমণ্ডলের চাপ বেড়ে যাওয়া। এতে করে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে খরা দেখা দেয়।
আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ুর বিপুল পরিবর্তন সাধারণত এল নিনোর সময়ই দেখা যায়। আগামী কয়েক বছরে এল নিনোর প্রভাবে সারা বিশ্বের উষ্ণতার বৃদ্ধির হার আগের সব রেকর্ড ভেঙে চুরমার করে দেবে।ডব্লিউএমও বলছে, এল নিনোর প্রভাবে ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা বেশি৷
২০২৪ সালে এল নিনোর প্রভাব সম্পূর্ণ স্পষ্ট হবে৷ পৃথিবী পরবর্তী অর্ধ দশকে তার উষ্ণতম বছরের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে। ফলে পশ্চিমের দিকে বৃষ্টি বাড়ে। আর বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমার থেকে শুরু করে অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত- এসব অঞ্চলে দেখা দেয় বৃষ্টির অভাব। বেড়ে যায় তাপমাত্রা। শুকিয়ে যায় মাটি।
বায়ুপ্রবাহের দিক বদলের কারণে এল নিনো ও লা নিনা হয়। কিন্তু কেন এই বদলে যাওয়া, তা জানা যায়নি। তাছাড়া প্রতিটি এল নিনো পরিস্থিতি ভিন্ন হয়। এর প্রতি বায়ুমণ্ডলের প্রতিক্রিয়াও তাই ভিন্ন হয় প্রতিবার। এমন ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হওয় ও নির্দিষ্ট নিয়ম না থাকায়, এল নিনোর পেছনের কারণও জানা যায়নি।
সাধারণত তিন থেকে সাত বছর পরপর এই পরিস্থিতি দেখা দেয়। স্থায়ী হয় ১২ থেকে ১৮ মাসের মতো। কিন্তু বর্তমানে এটি আরও ঘন ঘন দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষেণ করেছেন যে, এল নিনোর সময়ে কিংবা এল নিনো পরবর্তী সময়ে সাইক্লোন ও টাইফুনের সংখ্যারও বেড়ে যায়।
লা নিনা। ঠিক এল নিনোর উল্টো। লা নিনার সময়ে পুবালী বায়ুপ্রবাহের গতি বেড়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ায় বায়ুর উর্ধ্বমুখী পরিচলনের ফলে ভারী বৃষ্টি হয়। এর ছোঁয়া লাগে বাংলাদেশ, ভারত, মায়ানমারসহ আশপাশের অঞ্চলেও। ভারী বৃষ্টিপাতের পাশাপাশি এ সময় বন্যাও হতে দেখা যায়।
এক কথায়, এল নিনো সময়ের দুর্বল বা বিপরীত আয়ন বায়ু প্রবাহিত হয়। পশ্চিম-দক্ষিণ আমেরিকায় সমুদ্রের পানি গরম থাকে। পেরুভিয়ান অঞ্চলের সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। দক্ষিণ আমেরিকায় ভারী বৃষ্টিপাত দেখা যায় এবং বিপরীতে অস্ট্রেলিয়ায় খরা দেখা দেয়।
অন্যদিকে, লা নিনা সময়ে পশ্চিম-দক্ষিণ উপকূলীয় অঞ্চলের সমুদ্রের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ঠান্ডা হয়ে পড়ে। আর অষ্ট্রেলিয়ায় ভারী বৃষ্টি এবং বন্যা দেখা যায়। অষ্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলের সমুদ্রের পানি বেশি উষ্ণ থাকে। বসন্ত আর গ্রীষ্মে বেশি ঘূর্ণিঝড় দেখা যায়।
২০২৩ সাল থেকে চলা এল নিনোর প্রভাবেই এবার গ্রীষ্ম ও বর্ষার সমীকরণ বদলে যেতে পারে বলে আগেই পূর্বভাস দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। সেই পূর্বাভাস সত্যি করেই ২০২৪ সালের শুরু থেকেই দাবদাহে নাজেহাল হচ্ছে মানুষ। এপ্রিল-মে মাসের গরমে হিমসিম খেতে হচ্ছে আম জনতাকে।
এরিমধ্যে কিছু হলেও স্বস্তির খবর শুনিয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ব্যুরো অব মেটিওরোলজি বা বিওএম। জানিয়েছে, এল নিনো সাউদার্ন অসিলেশন নিরপেক্ষ অবস্থায় ফিরে এসেছে। এর ফলে ফিরে আসবে লা নিনা। অগাস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ লা নিনার পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে মনে করছেন আবহাওয়াবিদরা।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।