আন্তর্জাতিক ডেস্ক : করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে উচ্চ মূল্যস্ফীতির ফলে ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে অর্থনৈতিক উদ্বেগ আর হাহাকার। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসিপত্রের দাম লাগামহীনভাবে বাড়তে থাকায় দিশেহারা সাধারণ মানুষ। আশংকাজনকভাবে উৎপাদন কমে আসায় বাজারের ওপর ভরসা পাচ্ছেন না বিনিয়োগকারী ও ভোক্তারা। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারে পতনের ধারা অব্যাহত রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্ধশতাব্দীর মধ্যে সর্বোচ্চ সুদহার ঘোষণা করেছে। ভোগ্যপণ্যের বৃদ্ধি লাগামহীন হয়ে পড়ায় লাগাম টেনে ধরার চেষ্টায় সুদহার বৃদ্ধি ছাড়া উপায় ছিল না বলে জানানো হয়েছে। মার্চ মাসের পর এটি তৃতীয় দফা সুদহার বৃদ্ধির ঘটনা। মুদ্রাস্ফীতিও আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে বলে ভোক্তাদের জীবনে নাভিশ্বাস ওঠেছে। ব্যাংকগুলোর ঋণের ওপর ফেডারেল সূদ হার বছর শেষে ৩.৪ শতাংশ পর্যন্ত পৌছতে পারে। ফলে মর্টগেজ, ক্রেডিট কার্ড এবং অন্যান্য ঋণের ওপর সুদহার বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে জনগণের ওপর আর্থিক চাপ সীমা ছাড়িয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারগুলোতে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দরপতন ঘটেছে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের সর্বত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো মুদ্রাস্ফীতির লাগাম টেনে ধরার জন্য একই পন্থা অবলম্বন করতে শুরু করেছে, যা সমগ্র বিশ্বের অর্থনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। যুক্তরাজ্যে ভোগ্যপণ্যের মূল্য গত এপ্রিল মাসে ৯ শতাংশ বেড়ে গেছে এবং গত দেড় মাসে মূল্য সূচক আরও বেড়েছে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড গত ডিসেম্বর মাসের পর থেকে এ পর্যন্ত সূদ হার পঞ্চম দফা বৃদ্ধি করেছে। ব্রাজিল, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোও হার বাড়িয়েছে। ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংক আভাস দিয়ে সামারে তারা সূদ হার বৃদ্ধি করবে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় তিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ, ইউরোপের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের শীর্ষ নির্বাহীরা সতর্ক করে বলেছেন, নিম্ন মূল্যস্ফীতি এবং সুদের হার কমিয়ে রাখার বিষয়টি ইতিহাস হতে চলেছে। তারা বলেছেন, পণ্যের দাম যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায় সে লক্ষ্যে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। উল্লেখ্য, বর্তমান সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের পাশাপাশি ব্যাংক অব ইংল্যান্ডও সুদের হার এক শতাংশ থেকে বাড়িয়ে সোয়া শতাংশ করেছে। অর্থনীতিবিদরাও মনে করছেন, বিভিন্ন দেশ যেভাবে সুদের হার বাড়িয়েছে তা আরো কয়েক বছর অব্যাহত থাকবে। খুব শিগগিরই সুদের হার কমার কোনো লক্ষণ নেই।
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমার আশঙ্কায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক পতন অব্যাহত রয়েছে। আকঙ্কিত বিনিয়োগকারীরা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের শেয়ারবাজারের এসএন্ডপি (স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর) সূচকের সবচেয়ে বড় পড়ন হয়েছে। গত ছয় মাসে এসঅ্যান্ডপি সূচক ২০ দশমিক ৬ শতাংশ কমেছে। এছাড়া দেশটির পুঁজিবাজারের অন্যান্য সূচকেরও পতন হয়েছে। নাসডাক, দাও জোনসের শেয়ারের দামও ক্রমাগতভাবে পড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এশিয়ার দেশগুলোর শেয়ারবাজারেরও পতনের ধারা অব্যাহত আছে। যুক্তরাজ্যে এফটিএসই-২৫০ সূচকে এ বছর ২০ শতাংশ পতন হয়েছে। ইউরোপের স্টকস-৬০০ সূচকেরও ১৭ শতাংশ পতন হয়েছে। এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের শেয়ারর দামও পড়েছে ১৮ শতাংশ।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা শুরু হয়েছে অনেক আগ থেকেই। কিন্তু সুদের হার ক্রমাগত বাড়ানোর কারণে মানুষের কষ্ট বাড়ছে। শীর্ষ চীনা অর্থনীতিবিদ ড্রান ওয়াং বিবিসিকে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ সুদের হার বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেখানকার পুঁজিবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে মন্দার হারও বাড়বে।
করোনায় লকডাউনের কারণে বিশ্বব্যাপী পন্য সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় উৎপাদন কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। পাশাপশি সরবরাহ বিঘ্নিত ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধীর হওয়ায় সারা বিশ্বে মন্দার ঝুঁকি বাড়ছে।
জাপানের দাই ইচি লাইফ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান অর্থনীতিবিদ ইয়োশিকি শিনকে বলেন, কিছু দুর্বলতার পর চীনের অর্থনীতি চাঙ্গা হবে বলে আশা করা যায়। তবে এখন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় অর্থনীতিতে মন্দার ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে নানা অনিশ্চয়তার কারণে মন্দা মোকাবিলা করা ততটা সহজ হবে না।
জাতিসংঘের সহযোগী সংস্থা আংটাড বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতিতে চলতি বছর প্রবৃদ্ধি হবে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগে তা ৩ দশমিক ৬ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছিল। তাদের মতে, এ মন্দা রাশিয়াতে দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেবে। পশ্চিম ও মধ্য ইউরোপের দেশগুলো এবং দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো এ মন্দার হাওয়া থেকে বাদ যাবে না। খাদ্য এবং জ্বালানির মূল্য ক্রমাগত বাড়তে থাকায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ইতিমধ্যে নানা সামাজিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। খাবার এবং জ্বালানির ওপর মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হওয়ায় এসব উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ এবং উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হবে।
বিশ্ব অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতির চরম ধাক্কার শিকার হয়েছে বাংলাদেশও। ইতিমধ্যে মুল্যস্ফতির লাগাম টানতে বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে। বাজারে অর্থ সরবরাহ কমিয়ে মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার চেষ্টা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যও কমানো হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, নতুন অর্থবছরের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা। তবে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কিছু উপকরণ ব্যবহার ছাড়া তেমন কোনো করণীয় নেই। যে কয়েকটি উপকরণ রয়েছে, তার অন্যতম প্রধান হলো টাকার প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে কম হারে ঋণ দেওয়া। সূত্র: বিবিসি, আল জাজিরা
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।