জুমবাংলা ডেস্ক : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে ভূমিকা পালন করে আসছে ডলার। কিন্তু কালের বিবর্তনে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বেশ কিছু কারণ যুক্ত হয়ে ধীরে ধীরে ডলারের আধিপত্য কমিয়ে দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) তথ্য অনুসারে, আন্তর্জাতিক রিজার্ভ অর্থাৎ আন্তর্দেশীয় লেনদেনের জন্য সঞ্চিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের প্রায় ৬০ শতাংশই ডলার মূল্যের সম্পদ। এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্যেও সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা ডলার।
ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা শক্তি রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাসহ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। এতে ওয়াশিংটনের বিরোধিতার পরিণাম নিয়ে অন্যান্য দেশও উদ্বিগ্ন। কিন্তু তারা নীরবেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বলয়ের বাইরে নিজেদের অর্থনীতির বিকাশের পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
বাণিজ্যিক লেনদেন ও পরিশোধের জন্য চীনা ইউয়ান ও বিটকয়েনের মতো বিকল্প মুদ্রা ব্যবহারের কথা ভাবছে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, বাংলাদেশ ও ভারত। বৈশ্বিক বাণিজ্য ও অর্থায়নে ডলারের দীর্ঘ আধিপত্যের মধ্যেও ব্য়ষ্টিক অর্থনৈতিক-ভূরাজনৈতিক পরিবেশ দেশগুলোকে বিকল্প মুদ্রা অনুসন্ধানের পথে ঠেলে দিচ্ছে। অন্তত গত শতকের সত্তরের থেকে কয়েক বছর পরপর ডলারের বিকল্প নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠে।
ডলারের আধিপত্য কমানোর পরিকল্পনার সম্ভাব্য ৩টি কারণ তুলে ধরেছে বিজনেস ইনসাইডার:
১. বিশ্বজুড়ে মার্কিন মুদ্রানীতির প্রভাব
ডলার বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও পরিশোধ ব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র আধিপত্য বিস্তার করে আছে। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের মাত্রাতিরিক্ত প্রভাব আছে। প্রায়ই এটি অতিমূল্যায়িত হয়।
১৯৭৪ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ছিলেন প্রেসিডেন্ট ভালেরি জিস্কার দেস্তাঁ। তিনি বলেছেন, ডলারের আধিপত্যের কারণে মাত্রাতিরিক্ত সুবিধা ভোগ করছে যুক্তরাষ্ট্র। সুবিধার বড় দিক হলো ডলারের ব্যাপক দরপতনের কারণে ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলেও যুক্তরাষ্ট্র সংকটে পড়বে না। কারণ, দেশটি চাইলেই ডলার ছাপাতে পারবে।
এর অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের কারণে নিজ দেশের অর্থনীতির ক্ষতি এড়াতে অন্য দেশগুলোকে মার্কিন অর্থনীতি ও মুদ্রানীতিকে অনুসরণ করতে হবে। ভারতসহ অন্য অনেক দেশই বলছে, তারা মার্কিন মুদ্রানীতির কাছে জিম্মি থেকে থেকে বিরক্ত ও ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। বলা যায়, বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রার ইস্যুকারী হিসেবে যে দায়িত্বজ্ঞান থাকা উচিত, যুক্তরাষ্ট্রের তা নেই।
ভারতের রিজার্ভ ব্যাংকের একটি অংশ বিদেশি বাণিজ্যের জন্য ভারতীয় রুপি ব্যবহারের চেষ্টা করছে। এটিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মুদ্রানীতির রূপকল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
২. উদীয়মান দেশগুলোর জন্য অত্যন্ত ব্যয়বহুল হয়ে উঠছে মার্কিন ডলার
বিশ্বজুড়ে বেশির ভাগ মুদ্রার বিপরীতেই ডলার শক্তিশালী হয়ে ওঠায় উদীয়মান দেশগুলোর জন্য আমদানি বেশ ব্য়য়বহুল হয়ে পড়েছে।
রাজনৈতিক চাপ ও রপ্তানি হ্রাস পাওয়ায় আর্জেন্টিনায় মার্কিন ডলারের রিজার্ভ কমে আসছে। এতে আর্জেন্টিনার মুদ্রা পেসোর ওপর চাপ পড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাচ্ছে।
দেশটির অর্থমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলছে, মুদ্রাস্ফীতির কারণে আর্জেন্টিনা মার্কিন ডলারের পরিবর্তে ইউয়ান দিয়ে চীনা আমদানি দায় শোধ করছে।
আন্তর্জাতিক আর্থিক পরিষেবা প্রতিষ্ঠান আলিয়াঞ্জের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘মার্কিন ডলার যত শক্তিশালী হতে থাকবে, রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে এর ভূমিকা তত দুর্বল হতে থাকবে। কারণ, ডলার ব্য়য়বহুল হয়ে উঠলে ঋণগ্রহীতারা বিকল্প খোঁজা শুরু করবে।’
ডলারের আধিপত্য থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিকল্প মুদ্রায় লেনদেন নিষ্পত্তি চালু করতে সবচেয়ে সোচ্চার ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা ডা সিলভা। এ পথে আসতে রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে উৎসাহিত করে যাচ্ছেন তিনি।
৩. বিশ্ববাণিজ্য ও তেলের চাহিদায় বৈচিত্র্যে পেট্রোডলার ঝুঁকিতে
মার্কিন ডলারের বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হয়ে ওঠার অন্যতম কারণ হলো তেলের বাণিজ্যে উপসাগরীয় দেশগুলোর ডলার ব্যবহার। কারণ, এর মধ্যেই বাণিজ্যিক লেনদেনের মুদ্রা হিসেবে ডলার বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল।
১৯৪৫ সালে বিশ্বের প্রধান তেল উৎপাদনকারী দেশ সৌদি আরব যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক চুক্তির মাধ্যমে পেট্রোডলার ব্যবস্থা স্থায়ী রূপ লাভ করে। চুক্তি অনুযায়ী, সৌদি আরব আমেরিকার কাছে শুধু ডলারের বিনিময়েই তেল বিক্রি করবে। এর পরিবর্তে সৌদি আরব এর বাড়তি ডলার রিজার্ভ যুক্তরাষ্ট্রের কোষাগার ও কোম্পানিগুলোতে পুনরায় বিনিয়োগ করবে। এর ফলে সৌদি আরবের জন্য মার্কিন নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়ে যায়।
কিন্তু এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শেল অয়েল বা পাথুর থেকে তেল নিষ্কাশন শুরু করায় দেশটি তেল স্বনির্ভর এবং একই সঙ্গে তেল রপ্তানিকারক হয়ে ওঠে।
আলিয়াঞ্জের অর্থনীতিবিদেরা বলেন, ‘শেল অয়েল বিপ্লবের ফলে তেলের বাজারে যে কাঠামোগত পরিবর্তন এসেছে, তা বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলারের ভূমিকা খর্ব করতে পারে। কারণ, ডলারের আধিপত্য বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা তেল রপ্তানিকারকদের তখন অন্য দেশ ও মুদ্রার দিকে আবার ঝুঁকতে হবে।’
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।