স্পোর্টস ডেস্ক : বিশ্বায়নের সবচেয়ে বড় প্রতীক ফুটবল। যোগাযোগ ব্যবস্থা, প্রযুক্তি ইত্যাদির কারনে পৃথিবী এখন একটি গ্রামে পরিণত হয়েছে আর যেই ব্যাপারটা দুনিয়ার সমস্ত কোণায় কোনায় অবস্থান করে তা হচ্ছে ফুটবল। সেই ফুটবলের সবচেয়ে প্রভাবশালী দুই মহাদেশ ইউরোপ এবং আমেরিকার সবচেয়ে বড় দুই প্রতিযোগীতা ইউরো এবং কোপা আমেরিকার ফাইনাল কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে জার্মানী এবং যুক্তরাষ্টে অনুষ্ঠিত হবে। কয়েক সপ্তাহ জুড়ে দুনিয়ার সেরা ফুটবলারদের দুনিয়ার দুই প্রান্তে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই দেখার পর দুই প্রতিযোগীতার মধ্যে তুলনা আসতেই পারে।
ফুটবলের অন্যতম সেরা লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো বলতেন, একেকটা দেশ বা সংস্কৃতির ছাপ তাঁর ফুটবল খেলায় ফুটে উঠে। সমাজবিজ্ঞানী নরবার্ট এলিয়াস বিশদে দেখিয়েছেন কিভাবে খেলাধুলা তথাকথিত সভ্যতা ও রাষ্ট্র গঠন করে এবং এদের চরিত্রে ছাপ রেখে যায়। একেকটা অঞ্চলের ভূগোল, পরিবেশ, খাদ্যভাস, সংস্কৃতি, যুদ্ধের ইতিহাসসহ নানা বিষয় ফুটবলের শৈলী নির্মাণ করে বলে প্রমাণ হচ্ছে। এর ফলে, ফুটবল মূলত মানববীক্ষন হতে পারে।
গত অর্ধ শতাব্দী বা তাঁর বেশী সময় ধরে এর প্রভাবে ল্যাটিন ঘরানা, ইউরোপীয় ঘরানা ইত্যাদি নিয়ে বেশুমার তর্ক হয়। ব্রাজিলের ফাবোলা থেকে উঠে আসা, ল্যাটিন আমেরিকার ট্যাংগো নাচের ঘরানা, ইউরোপের নিখুঁত রনকৌশল, ইতালীয়দের ডবল তালা মেরে ঘর রক্ষণের ধারনা ইত্যাদির ভালোমন্দ নিয়ে সমর্থকেরা গলা ফাটান। সেই বিচারে ইউরো আর কোপা নিশ্চয়ই দুইটা ভিন্ন ধাচের সুর, লয় আর স্বাদ নিয়ে আসার কথা। তা আনে সন্দেহ নাই, তবে বিশ্বায়নের প্রভাবে আর সবকিছুর মতো বৈচিত্র্যও কমে গেছে।
ইউরো আর কোপা আমেরিকার খেলার শৈলী নিয়ে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য চোখে পড়ে তা হচ্ছে পাস দেয়ার ধরন। ইউরোতে যেখানে প্রায় সব দল পাস নির্ভর, দ্রুত বেগে অদলবদল করে খেলতে চায়, কোপাতে সেরকম না। একটা উদাহরণ দেই, ইউরোর ইতালী বনাম আলবেনিয়ার খেলায় প্রতি মিনিটে গড়ে ১২.২টা করে পাস দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে কোপার ইকুয়েডর বনাম জ্যামাইকার খেলায় প্রতি মিনিটে এই সংখ্যা ছিলো মাত্র ৬.১। ইটালির ৮০৯ টা পাসের বিপরীতে আলবেনিয়ার ৩৭২। অন্যদিকে কোপার দুইদল ইকুয়েডর আর জ্যামাইকার যথাক্রমে ২৭৫ ও ৩৩২।
কন্ডিশন এখানে বড় ভূমিকা রাখে। জার্মানীর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের বেশীরভাগ এলাকা গরম, আদ্রতা বেশী। ফলে খেলোয়াড়রা অফ দ্যা বল রান কম করতে চান। এই কারনেই বল ক্যারি করার হারও বেশী। অন্যদিকে কন্ডিশনের কারনে কোপায় আলগা ট্যাকল করা, ফাউলের হার বেশী।
আবার, ইউরোতে ট্যুকটিকাল ফাউল বেশী হয়। বেশিরভাগ দল পজেশন বেজড খেলতে চায়, এই কারনে খেলার গতি স্লথ হয়ে যায়। অন্যদিকে কোপায় এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে দ্রুত বলের অবস্থানের পরিবর্তন হয়, এই এন্ড টু এন্ড গেমে গতি বেশী থাকলেও ভুলের পরিমাণও বাড়ে।
গোলের ধরনে বড়সড় পার্থক্য চোখে পড়ে দুই টুর্নামেন্টে। কোপায় বড় অংশের গোল হয় কাছের দুরত্ব থেকে অন্যদিকে ইউরোতে বক্সের বাইরে থেকে গোলের সংখ্যা তুলনামূলক বেশী চোখে পড়ে। ইউরোর দলগুলোর রক্ষন জমাট হওয়ায় এই ব্যাপারটা ঘটে। এর সঙ্গে গত দুই আসরে যুক্ত হয়েছে আত্মঘাতী গোলের স্রোত। ইউরোর চলতি এবং সর্বশেষ আসর মিলিয়ে ২১টা আত্মঘাতী গোল হয়েছে। টানা দুই আসরে আত্মঘাতী গোলই অনেক ব্যাবধানে সর্বোচ্চ গোলদাতা। এর একটা বড় কারন সম্ভবত গোলমুখে রক্ষনের বেশি খেলোয়াড় থাকা এবং দূর থেকে শট নেয়ার প্রবণতা। এতে ডিফ্লেকশনের হার বাড়ে।
মহাদেশীয় টুর্নামেন্ট দুইটির তুলনা করাটা আকর্ষনীয় হলেও, কিছু বিচারে এই তুলনা একদমই যুতসই না। প্রথমত, খেলার কন্ডিশন। জার্মানীর মাঠগুলো যেখানে ছিলো আদর্শ মাঠের উদাহরণ, যুক্তরাষ্ট্রের মাঠগুলো মোটেই সেরকম না। এবড়োথেবড়ো, ঘাসের পরিমাণে অসাম্য, ঠিকঠাকমত পানি না দেয়া এগুলো কোপার মাঠগুলোকে ভালো ফুটবল খেলার পরিস্থিতি দেয়নি। প্রায় সব কোচই এই নিয়ে অভিযোগ করেছেন। আরেকটা বড় ব্যাপার হচ্ছে মাঠের আকৃতি। জার্মানীর মাঠগুলো ফিফার বেঁধে দেয়া ১০৫/৬৮ মিটার আয়তন বা এর বেশী অন্যদিকে কোপার আয়োজক কোনেমবলের নূন্যতম মাত্রা ১০০/৬৪ মিটার। মাঠ ছোট হওয়ায় দলগুলো পজিশন বেজড এবং শারিরীক ফুটবল খেলতে ব্যর্থ হয়, যা ইউরোপ তথা দুনিয়ার উন্নত ফুটবল দলগুলো খেলে। উন্নত এই অর্থে, কারন ল্যাটিন দলগুলোর সেরা খেলোয়াড়রাও ইউরোপীয়ান লীগেই খেলে। একদম ছোটবেলা থেকেই তাঁরা ইউরোপীয় শৈলী, আধুনিক কৌশলের সঙ্গে পরিচিত হয়।
ইউরো আর কোপাতে এও এক বড় পার্থক্য গড়ে দেয়। ইউরোতে খেলা বেশিরভাগ খেলোয়াড় পরস্পরকে খুব কাছ থেকে সারাবছর ফুটবল খেলতে দেখে বলে নিজেদের বোঝাপড়া ভালো হয়। অন্যদিকে কোপার দলগুলোর ইউরোপে খেলা বড় তারকা ও স্থানীয় খেলোয়াড়দের এই নিয়ে দুরত্ব থাকে। সবসময় তা ঘোচানো যায় না। কোপার আরেকটা অসুবিধার কথা না বললেই না। নিরাপত্তা। কলম্বিয়া বনাম উরুগুয়ের সেমিফাইনালে যে ন্যাক্কারজনক মারামারি দেখা গেলো তা ইউরোতে হবার সুযোগ নাই। যেই ইউরোপে একসময় হেইসেলের মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিলো, সে ইউরোপ এখন দর্শক নিরাপত্তায় বিন্দুমাত্র ছাড় দেয় না। আর দর্শকেরা খেলোড়দের সঙ্গে মারামারি করবে তা ভাবাই যায় না।
আর, সব ছাপায়ে বড় পার্থক্য তো অবশ্যই টাকাপয়সা। চলতি আসরে ইউরোর প্রাইজমানি ৩৬ কোটি ডলার অন্যদিকে কোপায় মাত্র ৭ কোটি ২০ লক্ষ। এই পার্থক্য কেবল এই টুর্নামেন্টে নয়, দুই মহাদেশের সার্বিক ফুটবলেই।
২০১৮ সালে কোনেমবল তাঁদের ক্লাব ফুটবলের আসরগুলোর সত্ত্ব বিক্রি করে প্রতি বছরের জন্য ৩৫ কোটি ডলার, অন্যদিকে উয়েফায় এই পরিমান ছিলো ২৭৫ কোটি (প্রায় আটগুন)। ইউরোপে লোকসংখ্যা বেশি, তবুও জনপ্রতি হিসাব করলেও এই পরিমাণ চারগুন। ২০১৫ সালে ব্রাজিলের লীগের বিদেশী টিভি স্বত্ত্ব বিক্রি হয় ৩.৭ কোটি ডলারে। ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লীগের একটা খেলা এর চেয়ে বেশী আয় করতে পারে। ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা বাদ দিলে বাকি দেশগুলোর মোট ফুটবল অর্থনীতি ইউরোপের একটা মাঝারি ক্লাবের বাজেটের সমান। ইউরোপের ফুটবল অর্থনীতি বহু আগেই ২৫০০ কোটি ডলার ছাড়ালেও দক্ষিন আমেরিকায় তা ৫ বিলিয়ন ছোয়নি।
পৃথিবীর অন্য অনেক পণ্যর মতো, ফুটবলের দিক দিয়েও ল্যাটিন আমেরিকা মূলত কাচামাল সরবরাহকারী আর ইউরোপ একে ঘষেমেজে দামী পণ্য পরিণত করে। ইউরোপের এই বিনিয়োগ তাঁকে বহুগুনে মুনাফা দেয়। এই কারনে, চলতি কোপা শেষে টুর্নামেন্টে গড় মানের দিকে তাকিয়ে বিপুল হতাশা নিয়ে উরুগুয়ের কোচ মার্সেলো বিয়েলসা বলেছিলেন, কোপার খেলোয়াড়দের একটা নির্দিষ্ট বয়সের আগে মহাদেশ ছেড়ে ইউরোপে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দিতে হবে। কিন্তু, বিয়েলসার সেই আদর্শিক চাওয়া বর্তমান দুনিয়ায় সম্ভব না।
ল্যাটিন আমেরিকা আর আফ্রিকার দেশগুলো ইদানিং ফুটবলের বড় রপ্তানীকারক হয়ে উঠেছে। এটা সত্যি যে, হাজার হাজার খেলোয়াড়ের হাতে গোণা কয়েকজন ইউরোপে সফলতা পায়, মিলিয়ন ডলারে উপার্জন করে। কিন্তু, ইউরোপের নিম্ন স্তরে ফুটবল খেলাটাও আর্থিক দিক দিয়ে এদের জন্য দেশে থাকার চেয়ে শ্রেয়। এমনকি নিরাপত্তার দিক দিয়েও। যেই আশায় গ্লোবাল সাউথ থেকে লাখো লাখো তরুন গ্লোবাল নর্থে পাড়ি জমাতে চায়, ফুটবলাররাও এর ব্যাতিক্রম না। এক গ্রাম হলেও পৃথিবী যেন দুইটা ভিন্ন মেরু। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নে এই পার্থক্য আরো বাড়বে।
আর্জেন্টিনা আর ব্রাজিলের সেরা খেলোয়াড়রা ক্লাবে খেলে যেই উপার্জন করে কোপা জিতলেও এর সমান পাবে না। ফলে সন্দেহ থাকে, এরা পাঁ বাচিয়ে খেলতে চাইবে। ক্লাবগুলোরও এমনটাই নির্দেশনা থাকে, অন্তত গোপনে। তবে, সেই নির্দেশনা না থাকলেও খেলোয়াড়দের পক্ষে সেরাটা দেয়া কঠিন।
টাকার কারনে ক্লাব ফুটবলই এখন ফুটবল বিশ্বের ভরকেন্দ্র। কেবল গ্লোবাল সাউথ না, ইউরোপের খেলোয়াড়দের কাছেও ক্লাবে খেলাই ধ্যানজ্ঞান,রুটি রুজি। ফলে, সারাবছর তাঁরা শেষ বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করে। আগষ্টে শুরু হওয়া মৌসুম যখন মে মাসে গিয়ে শেষ হয়, খেলোয়াড়দের আর দম থাকে না। কোপা কিংবা ইউরোর উদ্যামও এই দমকে পুরোপুরি জাগাতে পারে না। আবার আসছে ক্লাব মৌসুমের জন্য শক্তি সঞ্চয় রাখাও জরুরী।
আর্জেন্টিনার বিপক্ষেই ২৩ বছরের অপেক্ষা ফুরোনোর স্বপ্ন দেখছে কলম্বিয়া
সব মিলিয়ে, ইউরো আর কোপা, দুইটাই যেন দুনিয়ার সেরা অথচ ক্লান্ত ফুটবলারদের আসর। সন্দেহ নাই তাঁরা সেরাটাই হয়তো দিতে চায়, কিন্তু ফুটবল বাণিজ্যে শক্তি শুষে নেয়া এই খেলোয়াড়দের অসহায়ত্ব একটু খেয়াল করলেই দেখা যায়। শো মাষ্ট গো অন মন্ত্রে, শো এর মান নিয়ে কেই বা মাথা ঘামায়।
এই এক বিচারে অন্তত কোপা আর ইউরো এক বিন্দুতে মিলে যায়।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।