জুমবাংলা ডেস্ক : মালয়েশিয়া যেতে সরকার নির্ধারিত সর্বোচ্চ অভিবাসন ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। শেষ সময়ে এসে ভিসা পাওয়া কর্মীদের কাছ থেকে নেওয়া হচ্ছে ছয় থেকে সাড়ে ছয় লাখ টাকা। আগামী শুক্রবার বন্ধ হবে মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। আগে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিলেও শেষ সময়ে আরও দেড়-দুই লাখ টাকা বাড়তি নিচ্ছে রিক্রুটিং এজেন্সি ও দালালরা।
ঢাকা-কুয়ালালামপুরের বিমান ভাড়া ২৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে লাখ টাকার বেশি। রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সও লাখ টাকা ভাড়া নিচ্ছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বিমান ভাড়া নিয়োগকারীর দেওয়ার কথা থাকলেও তা যাচ্ছে কর্মীর পকেট থেকে। প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য, ছয়-সাত গুণ বাড়তি অভিবাসন ব্যয়ের কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি।
যদিও সপ্তাহ দুয়েক ধরে প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয় লাগাতার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানাচ্ছে, মালয়েশিয়া যেতে সরকার নির্ধারিত অভিবাসন ব্যয় ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। এর বেশি টাকা কাউকে না দিতে সতর্ক করছে কর্মীদের। তবে এ সতর্কবার্তা শুধুই কাগুজে।
গত ডিসেম্বরে মালয়েশিয়া যাওয়া নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার মো. বাবুল জানালেন, ৫ লাখ ২০ হাজার টাকায় গিয়েছেন দেশটিতে। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার জাহিদুল ইসলাম গত জুলাইয়ে সাড়ে চার লাখ টাকা খরচ করে মালয়েশিয়ায় যান। রিক্রুটিং এজেন্সি স্ট্যানফোর্ড এমপ্লয়মেন্ট লিমিটেড (নিবন্ধন নম্বর ১৩৫২) তাঁকে পাঠিয়েছে। দু’জনই চুক্তি অনুযায়ী চাকরি পাননি। বাবুল মিয়া বলেন, কত টাকা দিয়েছি, তা বলে লাভ কী? চুক্তিতে তো লেখা আছে ৭৮ হাজার ৯৯০ টাকা। কয়েক দিন ধরেই বিমানবন্দরে মালয়েশিয়াগামী কর্মীদের ভিড় বেড়েছে। ঘূর্ণিঝড় রিমালে গত সোমবার একটি ফ্লাইট বাতিল হয়। আগামী শুক্রবারের মধ্যে মালয়েশিয়ায় প্রবেশের বাধ্যবাধকতা থাকায় অনিশ্চয়তায় পড়া কয়েকশ কর্মী গতকাল মঙ্গলবার বিক্ষোভও করেন। মালয়েশিয়াগামী ১০ নতুন কর্মীর সঙ্গে গতকাল কথা বলেছে ।
সবাই জানিয়েছেন, ছয় লাখ টাকা লেগেছে। তবে কেউ নাম প্রকাশ বা রিক্রুটিং এজেন্সির নাম বলতে চান না। তাদের আশঙ্কা, বাড়তি ব্যয়ের কথা জানালে এজেন্সি তাদের আটকে দিতে পারে। যেসব কর্মী গত কয়েক দিনে মালয়েশিয়ায় গেছেন, পাসপোর্ট হাতে না পাওয়ায় তারাও একই ভয়ে রয়েছেন বলে নাম প্রকাশ করে কথা বলতে চাননি।
বাড়তি অভিবাসন ব্যয়ের বিষয়ে প্রবাসীকল্যাণ সচিব মো. রুহুল আমিন বলেছেন, বেশি টাকা নেওয়ার অভিযোগ পায়নি মন্ত্রণালয়।
তবে মালয়েশিয়ায় কয়েক মাস আগে যাওয়া কর্মী ও জনশক্তি ব্যবসায়ীরা খোলাখুলি বলেছেন বাড়তি অভিবাসন ব্যয়ের কথা। জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রার যুগ্ম মহাসচিব ফখরুল ইসলাম বলেন, প্রত্যেক কর্মীর জন্য ‘সিন্ডিকেটকে’ ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা এবং বিমান ভাড়ায় এখন ১ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। এ দুই খাতেই তো পৌনে তিন লাখ টাকা লাগছে। কর্মী কীভাবে ৭৯ হাজার টাকায় যাবে?
কর্মী পাঠাতে নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ২০০৯ সালে বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০১৫ সালে খুললেও তা সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে। ১০ রিক্রুটিং এজেন্সির ‘সিন্ডিকেট’ কর্মী পাঠিয়ে প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করেছে অভিযোগে ২০১৮ সালে বন্ধ হয় মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সমঝোতা স্মারক সইয়ের পরের বছরের ৮ আগস্ট আবার খোলে মালয়েশিয়া। এর আগের মাসে বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগে ২৫ রিক্রুটিং এজেন্সি বাছাই করে মালয় সরকার। এই এজেন্সিগুলো সিন্ডিকেট হিসেবে পরিচিত। পরে আরও ৭৫ বেসরকারি ও একটি সরকারি এজেন্সিকে কর্মী পাঠানোর কাজ দেয় দেশটির সরকার। গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত চাহিদাপত্রের কোটার বিপরীতে বাংলাদেশি কর্মীদের ভিসা দিয়েছে দেশটি। যারা ভিসা পেয়েছেন, তাদের আগামী শুক্রবারের মধ্যে যেতে হবে।
সমঝোতা স্মারক ও প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের ৫ জুলাই জারি করা অফিস আদেশ অনুযায়ী, মালয়েশিয়ার নিয়োগকারী দেবে কর্মীর বিমান ভাড়া। কিন্তু তা কখনোই হয়নি। কর্মীর পকেট থেকে যাচ্ছে এ টাকা। যদিও এতদিন তা ২৫ থেকে ৪০ হাজার টাকা লাগত। শেষ সময়ের তাড়াহুড়ায় যাত্রী বেড়ে যাওয়ায় বিশেষ ফ্লাইট পরিচালনা করছে বাংলাদেশ বিমান। তবে এসব ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে ঘুষ বাণিজ্য হচ্ছে বলে গত ২৬ মে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অভিযোগ দেন ফারিয়েল ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইথার ফারিয়েল হামিদ। তবে পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। গতকাল বিকেলেও দেখা যায়, ঢাকা-কুয়ালালামপুরের ভাড়া ১ লাখ ৮ হাজার টাকা। প্রবাসীকল্যাণ সচিব জানিয়েছেন, এ বিষয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সঙ্গে কথা হয়েছে। ভাড়া সহনীয় করতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এত টাকা খরচ করে মালয়েশিয়া গিয়েও কাজের নিশ্চয়তা নেই। মালয়েশিয়া প্রবাসীদের ‘কাজের খবর’ নামে একটি ফেসবুক গ্রুপ রয়েছে। এর সদস্য সংখ্যা ৭০ হাজার। গত দু’দিনে গ্রুপটি ঘুরে দেখা যায়, হাজার হাজার প্রবাসী জানিয়েছেন, তারা প্রতিশ্রুত চাকরি পাননি। শত শত কর্মী প্রতিদিন পোস্টে জানাচ্ছেন, ছয়-সাত মাস ধরে বেকার। আকুতি জানাচ্ছেন, বেতন যা-ই হোক, একটি কাজ দিতে।
চাঁদপুরের মো. মঞ্জুর পাঁচ বছর ধরে মালয়েশিয়ায় রয়েছেন। তিনি এই গ্রুপের মাধ্যমে ওয়েল্ডিংয়ের কাজ জানা বেকার কর্মীদের কাজ খুঁজে দেন। তিনি বলেন, নতুন সবাই আসছেন ‘সাপ্লাই ভিসায়’।
এ নামে কোনো ভিসা আছে কিনা প্রশ্নে তিনি জানান, এর অর্থ হলো আসলে কোনো চাকরি নেই। মালয়েশিয়ার নিয়োগকারীর কোম্পানিতে কোনো কাজ নেই। ভিসা বিক্রির জন্য বাংলাদেশ থেকে কর্মী এনেছে। কর্মীকে কাজ খুঁজে নিতে হবে।
গত ১৮ মে অবকাঠামো কাজের ভিসায় মালয়েশিয়া গেছেন কুমিল্লা সদরের মো. সাইফুল। তবে ১০ দিন পার না হতেই তিনি কাজ খুঁজছেন। কোন এজেন্সি তাঁকে পাঠিয়েছে, তা বলতে পারলেন না। ছয় লাখ টাকায় গত রোববার মালয়েশিয়া যাওয়া বরিশালের বানারীপাড়ার আমিনুল ইসলাম রিফাতেরও একই অবস্থা।
প্রবাসীকল্যাণ সচিব বলেন, মালয়েশিয়া গিয়ে সিআইবি তথা কাজ পেতে কিছুদিন সময় লাগে। কুয়ালালামপুরের হাইকমিশনের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তাদের তথ্যানুযায়ী খুব বেশি কর্মী বেকার নেই।
বাংলাদেশের দিক থেকে অভিযোগ না থাকলেও কর্মী নিপীড়নের কারণে মালয়েশিয়ার সমালোচনায় মুখর হয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। গত ৪ মে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এবং জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক কার্যালয় যৌথ বিবৃতিতে বলেছে, সিন্ডিকেটের কারণে বাংলাদেশি কর্মীরা জোরপূর্বক শ্রমের শিকার হচ্ছে। কাগুজে কাজ দেখিয়ে বাংলাদেশি কর্মীদের মালয়েশিয়া নেওয়া হচ্ছে।
তবে এ বিবৃতিকে মিথ্যা বলেছেন রিক্রুটিং এজেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মালিক ও বায়রার সাবেক মহাসচিব রুহুল আমিন স্বপন। তিনি গত ৫ মে এ কথা বলেন। অন্য জনশক্তি ব্যবসায়ীদের ভাষ্য অনুযায়ী, রুহুল আমিন স্বপন মালয়েশিয়ায় কর্মী পাঠানোর অন্যতম নিয়ন্ত্রক।
তবে গত জুলাইয়ে মালয়েশিয়া যাওয়া সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার জাহিদুল ইসলাম জানান, তাঁকে আট মাস কাজ দেওয়া হয়নি। একটি ঘরে শতাধিক মানুষের সঙ্গে আটকে রাখা হয়। ঠিকমতো খাবার, পানি দেওয়া হয় না। গত ফেব্রুয়ারিতে একই অভিযোগে মেহেরপুরের গাংনী থানায় ৩০ তরুণের পরিবার মামলা করে। এজাহার অনুযায়ী, এই তরুণরাও সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে গত নভেম্বরে মালয়েশিয়ায় যান।
২০২১ সালের ১৯ ডিসেম্বর মালয়েশিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার পর ২০২২ সালের ৮ আগস্ট কর্মী যাওয়া শুরু হয়। গত মঙ্গলবার পর্যন্ত প্রায় ৪ লাখ ৬০ হাজার কর্মী গেছেন। সমঝোতা স্মারক ছিল পাঁচ লাখ কর্মী নিয়োগের। কর্মী পাঠানোর প্রথম ধাপে কাজ পাওয়া ২৫ এজেন্সির তিনটি বর্তমান এমপির এবং একটি সাবেক এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর। এসব প্রতিষ্ঠানের পাঠানো কর্মীরাও কাজ পাননি বলে অভিযোগ রয়েছে।
কর্মী পাঠাতে সিন্ডিকেটকে ঘুষ ও ভিসা কেনাবেচার বিষয়টি সবার জানা হলেও প্রমাণ নেই অজুহাতে ব্যবস্থা নেয়নি প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়। ঢাকায় নিযুক্ত মালয় হাইকমিশনের বক্তব্যেও তা স্পষ্ট। গত মার্চে তিনি বলেন, ‘আমরা এ সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। তার একটি কারণ সিন্ডিকেট, যারা বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ায় সক্রিয়।’ সূত্র : সমকাল
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।