জুমবাংলা ডেস্ক : জাল সনদ ধরতে দৃশ্যমান উদ্যোগ নেই, যে যার মত ম্যানেজ করে যুক্ত হয়ে পড়েছেন শিক্ষকতা নামের মহান পেশায়। নিয়মের ফাঁক গলে আর ঘুষ লেদেনের মাধ্যমে তারা নাম লিখিয়েছেন সরকারের বেতন বইয়ে। এতে সাহায্য করেছেন অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সেই সুযোগেই দিনের পর দিন সরকারি বেতন তুলে শিক্ষকতা করে চলেছেন কারিগরির হাজারো শিক্ষক।
সম্প্রতি কারিগরির প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষকের সনদে জাল পেয়েছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। চার থানায় মামলার প্রস্তুতিও নিয়েছে তারা। তবে প্রশ্ন উঠেছে ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তির বিকাশের এই সময়েও কেন এসব শিক্ষকদের ধরতে নেই কোনো দৃশ্যমান উদ্যোগ?
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সিস্টেম দুর্বলতার কারণে একজন প্রতারক যে শুধু শিক্ষক হয়েছেন বিষয়টি তা নয়, এসব কারণে দেশের কয়েক প্রজন্ম শিক্ষার আলোর পরিবর্তে অন্ধকারে পতিত হয়েছে। ফলে শুধুমাত্র লোক দেখানো কার্যক্রম না করে সব দপ্তরে এই সংশ্লিষ্ট বিশেষ সেল থাকা উচিত।
অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের কারিগরি স্কুল কলেজে জাল সনদে শিক্ষকতা করছেন কয়েক হাজার শিক্ষক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনা কমিটি ও পরবর্তীতে অধিদপ্তরের অসাধু কর্মকর্তদের ম্যানেজ করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন তারা। যেকোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ফাইলে হাত দিলেই পাওয়া যাচ্ছে জাল সনদ। তবে এসব সনদ অনেক আগের তাই তা যাচাই-বাছাই নিয়ে রয়েছে জটিলতা। এ বিষয়ে প্রযুক্তির ব্যবহার করা গেলে কার্যকরী ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব।
শুধু জাল সনদে চাকরি করা শিক্ষক নয়, তার নিয়োগপ্রক্রিয়া ও এমপিওভুক্তির সঙ্গে যারা জড়িত ছিল তাদেরও আইনের আওতায় আনা উচিত বলে মনে করেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।
তিনি বলেন, এটি খুবই দুঃখজনক যে শিক্ষকরা জাল সনদে চাকরি করছেন। তারা শিক্ষার্থীদের কী শেখাবেন। ডিজিটাল বাংলাদেশে প্রযুক্তি অনেক দূর এগিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে না। প্রযুক্তি ব্যবহারে সদিচ্ছার অভাবও রয়েছে। এজন্য পুরো ব্যবস্থা মনিটরিংয়ের মধ্যে আনা উচিত বলে অভিমত দেন তিনি।
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. মহসিন বলেন, কারিগরিতে ভুয়া সনদের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে অধিদপ্তর। জটিলতা নিরসন করে শিগগিরই থানায় মামলা রুজু হবে।
কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সূত্রমতে, বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলোতে বিভিন্ন ট্রেডে কারিগরি শিক্ষা দেয়া হয়। সনদ জালিয়াতি করে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন অন্তত হাজার খানেক শিক্ষক। গেল কয়েকমাসে দেড় শতাধিক শিক্ষককের জাল সনদ শনাক্ত করেছে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর। এসব শিক্ষকের বিরুদ্ধে শুধু এমপিও বন্ধ নয় এবার ফৌজদারি মামলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জানা যায়, অবৈধভাবে এমপিওভুক্তির জন্য এসব শিক্ষক বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ জাল করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ডিগ্রী বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়েরও সনদ রয়েছে এই তালিকায়। জাল সনদ ধরা পড়ার পর এমপিও বন্ধ করা হলে তারা উচ্চ আদালতে রিট করছেন। এতে দেখা দেয় দীর্ঘসূত্রিতা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলাধীন শিয়ালকাঠী টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের প্রভাষক জনাব মো. রফিকুল। ২০১০ সালে এমপিওভুক্তির আবেদনে তিনি আমেরিকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি থেকে বিএসসি ইন কম্পিউটার সায়েন্স ডিগ্রীর সনদ জমা দেন। কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়টি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) অনুমোদিত নয়। যেকারণে তার এমপিও আবেদন বিবেচনা করেনি অধিদপ্তর। পরে প্রভাষক রফিকুল একই শিক্ষাবর্ষ দেখিয়ে রয়েল ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বিএসসির সনদ জমা দেন। কিন্তু একই সালে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি ও পাস করার বিষয়ে অধিদপ্তরের সন্দেহ হয়। পরে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ যাচাই করে দেখা গেছে তার দুই সনদই ভুয়া। পরে ভান্ডারিয়া থানায় মো. রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অধিদপ্তর থেকে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
একইভাবে মো. আব্দুস ছালাম কম্পিউটার ডেমোনেস্ট্রেটর পদে এমপিওভুক্তির আবেদন করেন। আবেদনে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ থেকে বিবিএ পাস করেছেন ও সনদের ফটোকপি পাঠান। সনদ অনুায়ী তিনি ২০১৫ সালে ৩.২২ সিজিপিএ নিয়ে পাস করেছেন। অধিদপ্তরের এমপিও শাখা সনদটির সত্যতা যাচাইয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির রেজিস্ট্রারের কাছে আবেদন করে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় সনদটি ভুয়া বলে জানায়। এরপর গত ৩১ জুলাই পাবনা জেলার চাটমোহর থানায় মো. আব্দুস ছালামের বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয় কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর।
যেভাবে জাল সনদ খুঁজে পাচ্ছে অধিদপ্তর
কারিগরি অধিদপ্তর সূত্র জানায়, এমপিওভুক্তির ৮ বছর ও ১২ বছর পর শিক্ষকদের উচ্চতর স্কেল দেয়া হয়। এই উচ্চতর স্কেলের জন্য যখন তারা আবেদন করে তখন কাগজপত্র পুনরায় যাচাই-বাছাই করা হয়। তখনই অনেকের কাগজপত্র সন্দেহজনক হওয়ায় খোঁজ নিতেই বেরিয়ে আসছে জাল সনদধারী শিক্ষক। আবার একই প্রতিষ্ঠানে নতুন কোনো শিক্ষকের এমপিওর আবেদন আসলেও স্কুল-বা কলেজের পুরো ফাইলটি খোলা হয়। তখনো এসব জাল সনদ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এসব শিক্ষকের সংখ্যা অধিদপ্তরের কাছে নির্ধারিত না হলেও ধারণা করা হচ্ছে প্রায় হাজার খানেক শিক্ষক ভুয়া সনদে এমপিওভুক্ত হয়ে শিক্ষকতা করছেন।
জানা যায়, ২০১৫ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এর আগে যেসব শিক্ষক কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন তারাই এই ধরনের প্রতারণা করেছেন বেশি। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন তারা। তবে উচ্চ আদালতে মামলার কারণে শিক্ষকদের থেকে সরকারের কোষাগারে এসব টাকা ফিরিয়ে দেয়াও সম্ভব হচ্ছে না। এই কারণেই এখন ফৌজদারি মামলা করা হচ্ছে।
২০১৫ সালের আগে সনদ জালিয়াতির সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জড়িত কীনা এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অধিদপ্তরের আইন শাখার সূত্র জানায়, এমপিওভুক্তির জন্য একটি নীতিমালা রয়েছে। নীতিমালায় ৩৩টি বিষয় দেখার কথা বলা হয়েছে। ওই সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন তারা কোনভাবেই গাফিলতির দায় এড়াতে পারে না।
জানতে চাইলে কারিগরি অধিদপ্তরের পরিচালক এ ওয়াই এম জিয়াউদ্দীন আল মামুন বলেন, কারিগরিতে যেসব শিক্ষক সনদ জালিয়াতি করে এমপিওভুক্ত হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
থানায় মামলায় জটিলতা
কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের কর্মকর্তার জানান, এসব প্রতারক শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা রয়েছে। এখন পর্যন্ত চারটি থানায় এই ধরনের শিক্ষক-কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে চাটমোহর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, অধিদপ্তরের আইন শাখার তিনজন আমার কাছে এসেছিলেন। আমি তাদেরকে এজাহার লিখে নিয়ে আসতে অনুরোধ করেছি। সেটা আসলেই মামলা নেয়া হবে। সূত্র : জনকণ্ঠ
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।