জুমবাংলা ডেস্ক : আজ ১৭ এপ্রিল। তিন মাস পূর্ণ করল ভারতীয় পণ্য বর্জনের আন্দোলন। গত ১৭ জানুয়ারি এই ডাক দিয়েছিলেন প্যারিসে অবস্থানকারী বাংলাদেশের একজন সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাক্টিভিস্ট। তার মতে, গত ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সফল আয়োজনে আওয়ামী লীগকে সম্পূর্ণ সহায়তা এবং সমর্থন করেছে ভারত সরকার। সেই ক্ষোভ থেকে দেশের মানুষকে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
শুরুর দিকে তিনি নিজেই বলছিলেন যে, এই বয়কট আন্দোলন প্রযোজ্য হবে বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া ভারতীয় ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডসের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশের বাজারে ঠিক কী প্রভাব পড়েছে সেটা হিসাব করে বোঝা না গেলেও সামাজিক মাধ্যমে একটা ব্যাপক প্রচারণা দেখা যায়। এমনকি আমেরিকা, ইউরোপে বসবাসকারী অনেক বাংলাদেশি নাগরিকও এই প্রচারণায় যোগ দিয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের ভিডিও আপলোড দিচ্ছেন।
একটা আন্দোলন তিন মাস ধরে সামাজিক মাধ্যমে বজায় রাখাকে অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। তবে পণ্য বয়কটের আন্দোলনকে সামগ্রিকভাবে ইন্ডিয়া আউট বা ভারত খেদাও আন্দোলনে পরিণত করা যায়নি। কিন্তু এ কথাও ঠিক যে, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সমাজে বিরাজমান ভারতবিরোধী মনস্তত্ত্বকে কিছুটা হলেও নাড়ানো সম্ভব হয়েছে। পুরোটাই রাজনৈতিক, তবে রাজনৈতিক জায়গা থেকে সাংগঠনিকভাবে কেউ এই আন্দোলনে প্রকাশ্যে এগিয়ে আসেনি।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ গত ২০ মার্চ বিএনপির নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে তার কাশ্মীরি শাল ছুড়ে ফেলে পায়ে মাড়িয়ে ভারতীয় পণ্য বর্জনের স্লোগান দিলেও তার দল সক্রিয়ভাবে এতে অংশ নেয়নি। বরং বিএনপি থেকে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে যে, দল ভারতের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন চায় এবং রিজভী যা করেছেন সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। বিএনপি দলীয়ভাবে এই বর্জনে অংশ না নিলেও ফেসবুকে বিএনপির পেজগুলোতে দেখা যাচ্ছে সারাদেশের দলের নেতাকর্মীরা সক্রিয়ভাবেই অংশ নিচ্ছে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক একাধিকবার এ নিয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীও সমালোচনা করেছেন। তবে বিষয়টি বড় রাজনৈতিক বিতর্কে পরিণত হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত সরকার ও জনগণের ভূমিকা বাংলাদেশ ভুলবে না কখনো। তবে বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে ভারতবিরোধী অংশটি একেবারে ছোট নয়। নানা কারণে এটি বেশ শক্তিশালী অবস্থানে আছে এবং আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এই অংশটিকে তাদের ভোটব্যাংক মনে করে রাজনীতিটা সেভাবেই করে। বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে এবং দলীয়ভাবে ভারতীয় পণ্য বয়কটে অংশ না নিলেও বিএনপির সঙ্গে বা সমান্তরালভাবে আন্দোলনে থাকা কয়েকটি বিরোধী দল তাতে সংহতি জানিয়ে একে রাজনৈতিক রূপদানের চেষ্টা করছে।
আমাকে অনেকে বলেছেন, যারা বয়কটের কথা বলে তাদের অনেকে নিজেরাই ভারতীয় পণ্য কেনে। কারণ কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ ছাড়া উপায় থাকে না। বেড়ানো এবং চিকিৎসার প্রয়োজনে লাখ লাখ লোক ভারত যায়। এই ভারত বর্জনের প্রচারণার মধ্যেই এবার পবিত্র ঈদুল ফিতর ও বাংলা নববর্ষের ছুটিতে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতে রেকর্ডসংখ্যক যাত্রী পারাপার হয়েছে। ঈদের দিন থেকে গত সোমবার পর্যন্ত পাঁচ দিনে দুই দেশের ৩২ হাজারের বেশি মানুষ যাতায়াত করেছেন, যা স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অন্তত ছয়গুণ বেশি। অতিরিক্ত যাত্রীর চাপ সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছেন বেনাপোল ও ভারতের পেট্রাপোল ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের কর্মীরা। বিমানযোগেও অসংখ্য মানুষ ভারত গেছেন। আমার নিজের পরিচিত এক বিএনপি নেতাও ঈদের ছুটিতে সপরিবারে বেড়াতে গেছেন ভারত। অর্থাৎ মানুষে মানুষে যোগাযোগ এত বেশি নিবিড় এবং নির্ভরতা এত বেশি যে কোনো বর্জনের ডাকে সেটা বন্ধ হয়ে যায় না।
শহরে-বন্দরে ভারতীয় পণ্য বর্জনের একটা নাগরিক আন্দোলন থাকলেও সেটা প্রকট আকার নেয়নি অনেক স্থানে। তবে অনেকেই সচেতনভাবে ভারতীয় কাপড় কেনেননি বা কিনছেন না। কিন্তু ঈদের সময়ই পত্রিকাগুলো রিপোর্ট করেছে যে, সীমান্তবর্তী শহর ও নগরে ঈদ মার্কেট সয়লাব ছিল চোরাইপথে আসা ভারতীয় কাপড়ে। সীমান্ত গলিয়ে, কর ফাঁকি দিয়ে এসব ঢুকেছে জেলা ও বিভাগীয় বিপণিবিতানগুলোতে। বৈধ আমদানি তো ছিলই।
তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে এই প্রচারণার প্রভাব পড়েছে। ছোট ছোট দোকানে ভারতীয় শুধু নয়, আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের কোমল পানীয়র বদলে বাংলাদেশি কোম্পানির কোমল পানীয় বেশ বিক্রি হয়েছে। সাবান, শ্যাম্পু বা গুঁড়া সাবানের বেলায় স্থানীয় উৎপাদকরা কিছুটা সুবিধা পেয়েছেন। তবে সামগ্রিকভাবে আমদানির পরিমাণে কোনো প্রভাব ছিল না বলেই ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন।
এই প্রচারণায় যেসব পণ্য বর্জনের কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস- সেগুলোর পরিমাণ ভারত থেকে বাংলাদেশের আমদানি খুব সামান্য। বাংলাদেশ বিশাল আকারে আমদানি করে শিল্পের কাঁচামাল। এমনকি প্রধান যে রপ্তানি পণ্য পোশাক খাত, সেটাও বড় আকারে নির্ভরশীল ভারতের ওপর। তুলা, সুতা এবং ডাইজ অ্যান্ড কেমিক্যাল্স- পোশাক খাতের এই কাঁচামালের বড় অংশ আসে ভারত থেকে। কারণটা অর্থনৈতিক। অন্য দেশ থেকে আনলে খরচ বেশি।
ভারতীয় পণ্য বর্জনের ডাক যে কেউ দিতে পারে। আবার যে কেউ সে ডাক প্রত্যাখ্যানও করতে পারে। প্রশ্ন হলো কতটা করা যায় সেই বর্জন। বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার ওপর বিরক্ত হয়ে সাধারণ নাগরিকরা যায় ভারতে, কারণ তারা ধনিক শ্রেণি এবং বিএনপি, আওয়ামী লীগের নেতাদের মতো সিঙ্গাপুর বা থাইল্যান্ড বা ইউরোপ যেতে পারে না। একটু ঘুরতে যাওয়ার শখ হলে ভারতই নিকটতম এবং সাশ্রয়ী। আমরা ভালো করেই জানি, ভারতের পেঁয়াজ, চিনি না এলে বাংলাদেশের বাজারে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে তা কল্পনা করা যায় না। কখনো কখনো চালও আমদানি করতে হয়। তাই সব বর্জনে সব মানুষ সাড়া দেয় না, জীবনের প্রয়োজনটা তাদের কাছে অনেক বড়।
ছেলে কৌমার্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন অভিনেত্রী, আরহানের পাল্টা উত্তরে হতবাক মালাইকা
স্বদেশি পণ্যের জন্য যদি ভালোবাসা তৈরি করতে হয় তা হলে এখানকার ব্যবসায়ীদেরও সে রকম গুণগত মানসম্পন্ন দামে সাশ্রয়ী পণ্য মানুষের কাছে নিয়ে আসতে হবে। খাবারে বিষ মেশানো, ওজনে আর দামে ঠকানো স্থানীয় ব্যবসায়ীরা কি সেটা পারবেন?
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।