সকালের ক্লান্তি যেন পায়ে শিকল বেঁধেছে। চুল পড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারছেন না? মনমরা ভাব, হতাশা কিংবা অকারণ উত্তেজনা গ্রাস করছে দৈনন্দিন জীবন। এই লক্ষণগুলো যদি আপনার পরিচিত মনে হয়, তাহলে জেনে রাখুন, আপনার শরীরের সেই ছোট্ট প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থি – থাইরয়েড – হয়তো তার স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়েছে। বাংলাদেশে থাইরয়েড ডিসঅর্ডারের হার উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে, বিশেষ করে নারীদের মধ্যে। কিন্তু হতাশ হবেন না! থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে খাবার যে কত বড় ভূমিকা রাখতে পারে, তা অনেকেই জানেন না। এই লেখায় শুধু তত্ত্ব নয়, বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতা, বিশেষজ্ঞের পরামর্শ এবং সহজেই মেলে এমন খাবারের মাধ্যমে কিভাবে আপনি আপনার থাইরয়েডকে বশে আনতে পারেন, সেই প্রাকৃতিক পথের সন্ধান দেব। আপনার সুস্থ জীবনের যাত্রা এখান থেকেই শুরু হোক।
থাইরয়েড: আপনার শরীরের অদৃশ্য কন্ডাক্টর
আমাদের গলার সামনে, শ্বাসনালির ঠিক সামনে অবস্থিত এই ছোট্ট প্রজাপতি আকৃতির গ্রন্থিটির নাম থাইরয়েড। এটি যদিও আকারে ছোট, এর কাজ কিন্তু বিশাল। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন (প্রধানত T3, T4 এবং ক্যালসিটোনিন) আমাদের শরীরের প্রায় প্রতিটি কোষ, প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করে। বিপাক হার (মেটাবলিজম) ঠিক রাখা থেকে শুরু করে হৃদস্পন্দন, শরীরের তাপমাত্রা, হজমশক্তি, পেশির শক্তি, স্নায়ুতন্ত্রের কার্যকারিতা, এমনকি আমাদের মেজাজ-মানসিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণেও থাইরয়েড হরমোনের ভূমিকা অপরিসীম। থাইরয়েডের সামান্য অসামঞ্জস্যতাই আমাদের পুরো শরীরের ছন্দপতন ঘটাতে পারে। বাংলাদেশের মতো দেশে, যেখানে আয়োডিনের অভাবজনিত সমস্যা একসময় প্রকট ছিল এবং এখনও কিছু অঞ্চলে রয়ে গেছে, সেখানে থাইরয়েড সমস্যা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। জাতীয় পুষ্টি সেবা ও লাইন ইনস্টিটিউট (NNS) এর তথ্য মতে, দেশের প্রায় ৩০% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নানা ধরনের থাইরয়েড ডিসঅর্ডারে ভুগছেন, যার বেশিরভাগই নারী। হাইপোথাইরয়েডিজম (অতিসক্রিয়তা) এবং হাইপারথাইরয়েডিজম (অবসক্রিয়তা) – এই দুই প্রধান সমস্যাই দেখা যায় বেশি।
খাবারই কেন থাইরয়েড ম্যানেজমেন্টের মূল চাবিকাঠি?
ঔষধ (যেমন লেভোথাইরক্সিন) থাইরয়েড হরমোনের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে অপরিহার্য, বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে। কিন্তু ঔষধ একাই পুরো সমাধান নয়। আপনার প্লেটে যা উঠছে, তা সরাসরি প্রভাব ফেলে আপনার থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা, হরমোন তৈরির প্রক্রিয়া এবং সেই হরমোনগুলো শরীরে কিভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে তার উপর। সঠিক খাবার:
- থাইরয়েড গ্রন্থিকে পুষ্টি জোগায়: থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য নির্দিষ্ট কিছু পুষ্টি উপাদান অপরিহার্য, যেমন আয়োডিন, সেলেনিয়াম, জিংক, আয়রন, ভিটামিন ডি, বি ভিটামিন (বিশেষ করে B12)।
- প্রদাহ কমায়: অনেক থাইরয়েড সমস্যার (বিশেষত হাশিমোটো’স থাইরয়েডাইটিসের মতো অটোইমিউন অবস্থা) পেছনে দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহ একটি বড় কারণ। অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি খাবার এই প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- অটোইমিউন প্রতিক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে: কিছু খাবার অটোইমিউন প্রতিক্রিয়াকে বাড়িয়ে দিতে পারে, আবার কিছু খাবার তা প্রশমিত করতে পারে। গ্লুটেনের মতো উপাদান অনেকের ক্ষেত্রে সমস্যা তৈরি করে।
- হরমোনের বিপাক ও কার্যকারিতা উন্নত করে: খাদ্যাভ্যাস লিভারের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে, যা থাইরয়েড হরমোনের সক্রিয়করণ (T4 কে T3 তে রূপান্তর) এবং বিপাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
- থাইরয়েড হরমোন শোষণে বাধা দেয় না: কিছু খাবার বা পানীয় থাইরয়েড ঔষধের শোষণে ব্যাঘাত ঘটায়। সঠিক সময়ে সঠিক খাবার গ্রহণ ঔষধের কার্যকারিতা নিশ্চিত করে।
বাংলাদেশী প্রেক্ষাপটে বিশেষ বিবেচ্য: আমাদের খাদ্যাভ্যাসে ভাত-মাছ-ডাল-শাকসবজির আধিক্য থাকলেও, আয়োডিনযুক্ত লবণের সঠিক ব্যবহার, ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণ এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার থেকে দূরে থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে খাবার এর কৌশল বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
হাইপোথাইরয়েডিজমে (অবসক্রিয়তা) কী খাবেন, কী এড়াবেন?
হাইপোথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড গ্রন্থি পর্যাপ্ত হরমোন তৈরি করতে পারে না, ফলে শরীরের বিপাক হার কমে যায়। লক্ষণগুলো হলো ওজন বৃদ্ধি, ক্লান্তি, ঠান্ডা সহ্য করতে না পারা, কোষ্ঠকাঠিন্য, বিষণ্নতা, চুল পড়া, শুষ্ক ত্বক ইত্যাদি।
খাবেন যা যা (Focus on):
- আয়োডিনের সঠিক উৎস: থাইরয়েড হরমোন তৈরির মূল কাঁচামাল। তবে অতিরিক্ত আয়োডিনও ক্ষতিকর হতে পারে।
- সবচেয়ে ভালো উৎস: আয়োডিনযুক্ত লবণ (আইওডিনাইজড সল্ট)। বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী, বাজারে বিক্রি হওয়া সব লবণই আয়োডিনযুক্ত হওয়া বাধ্যতামূলক। রান্নায় এবং খাওয়ার সময় আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার নিশ্চিত করুন। তবে অতিরিক্ত লবণ নয়।
- অন্যান্য উৎস: সামুদ্রিক মাছ (ইলিশ, রূপচাঁদা, টুনা – মাঝারি পরিমাণে), চিংড়ি, ডিম, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার। (সূত্র: Institute of Public Health Nutrition (IPHN), Bangladesh)
- সেলেনিয়াম: থাইরয়েড হরমোনের বিপাক ও সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
- উৎস: ব্রাজিল নাট (সীমিত পরিমাণে), সামুদ্রিক মাছ (টুনা, সার্ডিন), মুরগির মাংস, ডিম, সূর্যমুখীর বীজ, মাশরুম, পেঁয়াজ, রসুন।
- জিংক: থাইরয়েড হরমোন সংশ্লেষণে সাহায্য করে।
- উৎস: শিম জাতীয় ডাল (মসুর, মুগ, ছোলা), বাদাম (কাজু, কাঠবাদাম), বীজ (কুমড়ার বীজ, তিল), গরুর মাংস (লিন কাট), দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য, ডিম।
- আয়রন: থাইরয়েড হরমোন তৈরির জন্য দরকারি এনজাইমের জন্য প্রয়োজনীয়। আয়রন ঘাটতিও থাইরয়েড সমস্যার লক্ষণের সাথে মিলে যায়।
- উৎস: লাল মাংস (গরু, খাসি – পরিমিত), কলিজা, ডাল, পালং শাক, কচু শাক, মটরশুঁটি, শুকনো ফল (কিসমিস, খেজুর)। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবার (লেবু, আমলকী, পেয়ারা, ক্যাপসিকাম) আয়রন শোষণে সাহায্য করে।
- ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড: প্রদাহ কমায় এবং ইমিউন ফাংশন উন্নত করে।
- উৎস: ফ্যাটি ফিশ (ইলিশ, চিংড়ি, পাঙ্গাশ – নদীর মাছও ভালো), ফ্ল্যাক্সসিড (আলসিবীজ), চিয়া সিড, আখরোট।
- ফাইবার সমৃদ্ধ খাবার: কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
- উৎস: ওটস, ঢেঁকিছাটা চালের ভাত, শাকসবজি (সব ধরনের), ফল (পেয়ারা, নাশপাতি, আপেল), ডাল, বাদাম, বীজ।
- স্বাস্থ্যকর চর্বি: হরমোন উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয়।
- উৎস: ঘি (পরিমিত), নারিকেল তেল, অ্যাভোকাডো, বাদাম, বীজ, জলপাইয়ের তেল (অলিভ অয়েল)।
যা এড়িয়ে চলবেন (Avoid/Minimize):
- গয়ট্রোজেন সমৃদ্ধ খাবার (Goitrogens): এগুলো থাইরয়েড গ্রন্থিকে আয়োডিন গ্রহণে বাধা দিতে পারে এবং গলগণ্ড (Goiter) সৃষ্টি করতে পারে। তবে ভয়ের কিছু নেই! রান্না করলে এদের গয়ট্রোজেনিক প্রভাব অনেকটাই কমে যায়। কাঁচা বা অতিরিক্ত পরিমাণে খাওয়াই সমস্যা। এদের সম্পূর্ণ বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, পরিমিত ও রান্না করে খান।
- সাধারণ গয়ট্রোজেন: সয়াবিন ও সয়া পণ্য (সয়াদুধ, টফু, সয়া সস – বিশেষ করে কাঁচা বা অপর্যাপ্ত প্রক্রিয়াজাত), ক্রুসিফেরাস শাকসবজি (বাঁধাকপি, ফুলকপি, ব্রকোলি, ওলকপি, শালগম, মূলা – কাঁচা অবস্থায় বেশি সমস্যা), স্ট্রবেরি, পীচ, চীনাবাদাম। (সূত্র: American Thyroid Association)
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: এতে প্রচুর লবণ থাকে, কিন্তু তা আয়োডিনযুক্ত নয়! এতে সোডিয়াম বাড়ে, পটাসিয়াম কমে, যা থাইরয়েডের জন্য ভালো নয়। এছাড়াও থাকে ক্ষতিকর ফ্যাট, চিনি ও প্রিজারভেটিভ।
- অতিরিক্ত চিনি ও রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট: রক্তে শর্করার ওঠানামা বাড়ায়, যা ইতিমধ্যেই ধীর বিপাকের সাথে মিলে ক্লান্তি ও ওজন বাড়াতে পারে। সাদা চিনি, ময়দা, পেস্ট্রি, কোল্ড ড্রিংকস, প্যাকেটজাত জুস এড়িয়ে চলুন।
- থাইরয়েড ঔষধের শোষণে বাধা দেয় এমন খাবার: থাইরয়েডের ঔষধ (লেভোথাইরক্সিন) খাওয়ার কমপক্ষে ৩-৪ ঘন্টা আগে বা পরে এগুলো খাবেন।
- ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট বা ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ, দই, পনির – প্রচুর পরিমাণে)।
- আয়রন সাপ্লিমেন্ট বা আয়রন সমৃদ্ধ খাবার (লাল মাংস, কলিজা – প্রচুর পরিমাণে)।
- ম্যাগনেসিয়াম সাপ্লিমেন্ট।
- অতিরিক্ত ফাইবার সাপ্লিমেন্ট।
- কফি।
বাংলাদেশী হাইপোথাইরয়েড ডায়েট প্লান (উদাহরণ):
- সকাল (ঔষধ খাওয়ার ১ ঘন্টা পর): ১ কাপ ওটস (জলে বা পরিমিত দুধে) + ১ মুঠো বাদাম (কাঠবাদাম, আখরোট) + ১ টুকরো পেয়ারা/আপেল।
- দুপুর: ঢেঁকিছাটা চালের ভাত (১ কাপ) + মাছের ঝোল (১ টুকরা ইলিশ/রুই/কাতলা) + ডাল (১ কাপ) + সবজি তরকারি (লাউ, পটোল, ডাঁটা – গয়ট্রোজেন শাকসবজি রান্না করে খান) + সালাদ (শসা, গাজর, টমেটো)।
- বিকাল (স্ন্যাক্স): ১ বাটি ছোলা ভাজা বা সিদ্ধ ছোলা + শসা/পেয়ারা।
- রাত: রুটি (২ টা) / ভাত (১/২ কাপ) + মুরগির মাংসের ঝোল (ব্রেস্ট/থাই) / মাছের তরকারি + সবজি (পরিবর্তন করুন) + টক দই (১ কাপ)।
- হাইড্রেশন: দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি। হার্বাল চা (গ্রিন টি, আদা চা) খেতে পারেন।
হাইপারথাইরয়েডিজমে (অতিসক্রিয়তা) খাদ্যাভ্যাসের কৌশল
হাইপারথাইরয়েডিজমে থাইরয়েড গ্রন্থি অতিরিক্ত হরমোন তৈরি করে, ফলে বিপাক হার বেড়ে যায়। লক্ষণগুলো হলো ওজন হ্রাস, অতিরিক্ত ঘাম, গরম সহ্য না হওয়া, হৃদস্পন্দন বেড়ে যাওয়া, উদ্বেগ, অনিদ্রা, কাঁপুনি, দুর্বলতা ইত্যাদি।
খাবেন যা যা (Focus on):
- ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাবার: অতিসক্রিয় থাইরয়েড হাড়ের ক্ষয় (অস্টিওপরোসিস) ঝুঁকি বাড়ায়।
- উৎস: দুধ, দই, পনির (ক্যালসিয়াম), ডিমের কুসুম, ফ্যাটি ফিশ, সূর্যালোক (ভিটামিন ডি)। প্রয়োজনে সাপ্লিমেন্ট (ডাক্তারের পরামর্শে)।
- ম্যাগনেসিয়াম: পেশির খিঁচুনি ও অনিদ্রা কমাতে সাহায্য করে।
- উৎস: পালং শাক, কলা, অ্যাভোকাডো, ডার্ক চকলেট (৭০%+ কোকোয়া), বাদাম (আলমন্ড, কাঠবাদাম), বীজ (কুমড়ার বীজ, তিসি), শিমের বিচি।
- অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ ফল ও শাকসবজি: অতিসক্রিয়তার ফলে তৈরি হওয়া অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমায়।
- উৎস: বেরি জাতীয় ফল (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি – যা গয়ট্রোজেনিক, কিন্তু পরিমিত খাওয়া যেতে পারে), টমেটো, গাজর, ক্যাপসিকাম (লাল/হলুদ/সবুজ), ব্রকোলি (রান্না করে), সবুজ শাক (পালং, লাল শাক)।
- স্বাস্থ্যকর চর্বি ও প্রোটিন: ওজন ধরে রাখতে এবং পেশি ক্ষয় রোধে সাহায্য করে।
- উৎস: মুরগির মাংস, মাছ, ডিম, ডাল, বাদাম, বীজ, অ্যাভোকাডো, অলিভ অয়েল।
- কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (GI) যুক্ত কার্বোহাইড্রেট: রক্তে শর্করা স্থিতিশীল রাখে, এনার্জি দীর্ঘস্থায়ী করে।
- উৎস: ঢেঁকিছাটা চালের ভাত, ওটস, বার্লি, ডাল, শাকসবজি, ফল (আপেল, পেয়ারা, নাশপাতি)।
যা এড়িয়ে চলবেন (Avoid/Minimize):
- আয়োডিন: অতিসক্রিয় অবস্থায় আয়োডিন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদন আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
- সীমিত করুন: আয়োডিনযুক্ত লবণ (প্রচুর পরিমাণে নয়), সামুদ্রিক মাছ ও শেলফিশ (ইলিশ, চিংড়ি, কাঁকড়া – কম খান), আয়োডিন সমৃদ্ধ ডেইরি পণ্য (দুধ, দই, পনির – অতিরিক্ত নয়), আয়োডিনযুক্ত মাল্টিভিটামিন বা সাপ্লিমেন্ট (ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া নয়)। (সূত্র: National Institute of Diabetes and Digestive and Kidney Diseases – NIDDK)
- ক্যাফেইন: উদ্বেগ, হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি ও অনিদ্রা বাড়াতে পারে।
- এড়ান: কফি, চা (বিশেষ করে কড়া চা), এনার্জি ড্রিংক, কোলা।
- অতিরিক্ত চিনি ও রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট: এনার্জি ক্র্যাশ বাড়ায়।
- অ্যালকোহল: লিভারের উপর চাপ ফেলে, যা হরমোন বিপাকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: অতিরিক্ত লবণ (আয়োডিনসহ), ক্ষতিকর ফ্যাট, চিনি থাকে।
বাংলাদেশী হাইপারথাইরয়েড ডায়েট প্লান (উদাহরণ):
- সকাল: ২ টি ডিমের সাদা অংশের অমলেট + ১ কাপ ওটস (জলে রান্না) + ১ কাপ টক দই + ১/২ কাপ বেরি/পেয়ারা।
- দুপুর: ঢেঁকিছাটা চালের ভাত (১ কাপ) + মুরগির সাদা মাংসের ঝোল (ব্রেস্ট) + মিক্সড সবজি (লাউ, পটোল, ফুলকপি রান্না করে) + ডাল (১ কাপ)।
- বিকাল (স্ন্যাক্স): ১ মুঠো কাঠবাদাম + ১ টি কলা / ১ বাটি ফলের সালাদ।
- রাত: রুটি (২ টা) + সবজি তরকারি (মিষ্টি কুমড়া, লাউ, বরবটি) + ডাল (ভিন্ন ধরনের) + ১ কাপ টক দই।
- হাইড্রেশন: প্রচুর পানি। ক্যাফেইনমুক্ত হার্বাল টি (ক্যামোমাইল, পুদিনা পাতা)।
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
- ডাক্তারের পরামর্শই প্রথম: খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন কখনই থাইরয়েডের ঔষধের বিকল্প নয়। নিয়মিত ডাক্তারের পরামর্শ নিন, টিএসএইচ, T3, T4 টেস্ট করান এবং ঔষধের ডোজ ঠিকমত মেনে চলুন। খাদ্যতালিকা পরিবর্তনের আগেও ডাক্তার বা একজন রেজিস্টার্ড ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করুন। ঢাকার এন্ডোক্রাইনোলজিস্ট ডা. শাহজাদা সেলিম (অধ্যাপক, বারডেম হাসপাতাল) বারবার জোর দিয়েছেন, “থাইরয়েড রোগীরা প্রায়ই ‘কি খাব, কি খাব না’ নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন। মনে রাখবেন, সঠিক ঔষধ গ্রহণ এবং নিয়মিত ফলো-আপই মূল চাবিকাঠি। খাদ্যাভ্যাস একটি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।”
- ঔষধের সময়সূচী: লেভোথাইরক্সিন সকালে খালি পেটে (খাবারের কমপক্ষে ৩০-৬০ মিনিট আগে) পানি দিয়ে খাওয়া উচিত। আগেই উল্লেখিত খাবারগুলো (ক্যালসিয়াম, আয়রন, ফাইবার সাপ্লিমেন্ট, কফি) এর শোষণে বাধা দেয়।
- পানি পান: শরীরের সমস্ত বিপাক প্রক্রিয়া, হরমোন পরিবহন ও বিষাক্ত পদার্থ নিষ্কাশনের জন্য পর্যাপ্ত পানি পান অপরিহার্য। দিনে ৮-১০ গ্লাস পানি পান করুন।
- মানসিক চাপ ব্যবস্থাপনা: ক্রনিক স্ট্রেস থাইরয়েড ফাংশনকে ব্যাহত করতে পারে। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন, গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম, পর্যাপ্ত ঘুম (৭-৮ ঘন্টা) মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ব্যায়াম: হাইপোথাইরয়েডিজমে ওজন নিয়ন্ত্রণ এবং এনার্জি লেভেল বাড়াতে, হাইপারথাইরয়েডিজমে পেশি শক্তি ধরে রাখতে এবং হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটা, সাঁতার, সাইক্লিং, হালকা স্ট্রেংথ ট্রেনিং ভালো অপশন। শুরুতে হালকা থেকে মাঝারি ধরনের ব্যায়াম করুন।
- অটোইমিউন থাইরয়েডাইটিস (হাশিমোটো’স/গ্রেভস ডিজিজ): এই ক্ষেত্রে গ্লুটেন (গম, যব, রাইতে থাকে) এবং কখনও কখনও ডেইরি পণ্য সমস্যা বাড়াতে পারে। এলিমিনেশন ডায়েট (ডাক্তার বা ডায়েটিশিয়ানের তত্ত্বাবধানে) করে দেখতে পারেন কোন খাবারে সমস্যা হচ্ছে কিনা।
- বাংলাদেশী বাজারের খাদ্য নিরাপত্তা: ভেজালমুক্ত, তাজা ও প্রাকৃতিক খাবার বেছে নিন। ফল ও সবজি ভালো করে ধুয়ে নিন। প্রক্রিয়াজাত ও প্যাকেটজাত খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।
জেনে রাখুন (FAQs)
১. থাইরয়েডের সমস্যা হলে কি ভাত খাওয়া বাদ দিতে হবে?
না, ভাত খাওয়া বাদ দেওয়ার প্রয়োজন নেই, বিশেষ করে বাংলাদেশের প্রধান খাদ্য হিসেবে। তবে, সাদা চালের (পলিশড) ভাতের বদলে ঢেঁকিছাটা চালের (ব্রাউন রাইস) ভাত খাওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর। এতে ফাইবার, ভিটামিন ও মিনারেল বেশি থাকে, যা রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে এবং হাইপোথাইরয়েডিজমের কোষ্ঠকাঠিন্য কমায়। পরিমিতি বোধের সাথে খান।
২. সয়াবিন বা সয়া পণ্য (টফু, সয়াদুধ) থাইরয়েড রোগীরা খেতে পারবেন কি?
হাইপোথাইরয়েডিজমের রোগীদের জন্য সয়া পণ্য জটিল একটি ইস্যু। সয়াতে থাকা আইসোফ্লাভোন এবং গয়ট্রোজেন থাইরয়েড হরমোন উৎপাদনে হস্তক্ষেপ করতে পারে এবং ঔষধের শোষণে বাধা দিতে পারে। বিশেষ করে যাদের অটোইমিউন থাইরয়েডাইটিস (হাশিমোটো’স) আছে, তাদের সয়া এড়ানো বা খুবই সীমিত করা উচিত। হাইপারথাইরয়েডিজমের ক্ষেত্রে আয়োডিনের পাশাপাশি সয়াও সীমিত করা ভালো। তবে, যদি খেতেই চান, তাহলে ঔষধ খাওয়ার কমপক্ষে ৩-৪ ঘন্টা পরে অল্প পরিমাণে খান এবং লক্ষণগুলোর দিকে নজর রাখুন।
৩. থাইরয়েডের জন্য সবচেয়ে ভালো ফল কোনগুলো?
সাধারণত আপেল, বেরি (ব্লুবেরি, স্ট্রবেরি – পরিমিত), পেয়ারা, নাশপাতি, পাকা পেঁপে ভালো পছন্দ। এগুলো অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ফাইবার সমৃদ্ধ। তবে, হাইপারথাইরয়েডিজমের রোগীদের স্ট্রবেরি ও পীচ (গয়ট্রোজেনিক) অতিরিক্ত না খাওয়াই ভালো। ট্রপিক্যাল ফল যেমন আম, কাঁঠাল, লিচুতে চিনির পরিমাণ বেশি, তাই পরিমিত খেতে হবে, বিশেষ করে ওজন নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হলে।
৪. থাইরয়েড কমানোর ঘরোয়া উপায় বলে কিছু শুনি, সেগুলো কি কার্যকর?
“থাইরয়েড কমানো” বলতে যদি হাইপারথাইরয়েডিজম বোঝায়, তাহলে জেনে রাখুন, এর জন্য চিকিৎসা অপরিহার্য (ঔষধ, রেডিওআয়োডিন থেরাপি বা অস্ত্রোপচার)। কোন ঘরোয়া উপায়েই অতিসক্রিয় থাইরয়েডকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। অবসক্রিয় থাইরয়েড (হাইপোথাইরয়েডিজম) এর জন্যও ঔষধই প্রধান চিকিৎসা। খাদ্যাভ্যাস শুধু সহায়ক ভূমিকা পালন করে এবং লক্ষণগুলো মোকাবিলায় সাহায্য করে। আয়োডিন, সেলেনিয়াম বা অন্য কোন সাপ্লিমেন্ট নিজে নিজে না নিয়ে ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
৫. থাইরয়েড থাকলে কি গরুর মাংস বা খাসির মাংস খাওয়া যাবে?
হ্যাঁ, পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে হাইপোথাইরয়েডিজমে যাদের আয়রনের ঘাটতি থাকতে পারে। লাল মাংস আয়রন, জিংক এবং ভিটামিন বি১২ এর ভালো উৎস। তবে, চর্বি ছাড়া অংশ (লিন মিট) বেছে নিন এবং অতিরিক্ত তেলে ভাজা না করে ঝোল বা গ্রিল করে খান। হাইপারথাইরয়েডিজমে ওজন ধরে রাখা জরুরি, তাই লাল মাংস পরিমিত খেতে হবে। মনে রাখবেন, অতিরিক্ত লাল মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
৬. থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে কতদিন লাগে?
থাইরয়েড সমস্যা সাধারণত একটি দীর্ঘমেয়াদী বা আজীবন অবস্থা। ঔষধ শুরু করার পর হরমোনের মাত্রা স্থিতিশীল হতে (সাধারণত টিএসএইচ স্বাভাবিক সীমায় আসতে) কয়েক সপ্তাহ থেকে কয়েক মাস লাগতে পারে। তারপরও নিয়মিত ঔষধ খাওয়া এবং ডাক্তারের সাথে ফলো-আপ চালিয়ে যেতে হয়। খাদ্যাভ্যাসের ইতিবাচক প্রভাবও ধারাবাহিকভাবে মেনে চললে ধীরে ধীরে লক্ষণগুলোর উন্নতি দেখা যায় এবং সামগ্রিক সুস্থতা বজায় থাকে। ধৈর্য্য ধারণ করা এবং চিকিৎসা পরিকল্পনা মেনে চলাই মূল কথা।
আপনার থাইরয়েড গ্রন্থি আপনার শরীরের সেই নীরব নায়ক, যে সঠিক ছন্দে সুর বাজাতে পারলেই জীবনের গানও বাজবে সুমধুর। ঔষধের পাশাপাশি সচেতন খাদ্যাভ্যাসই হতে পারে আপনার থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে শক্তিশালী মিত্র। মনে রাখবেন, কোন একটি ‘সুপারফুড’ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে সুষম, পুষ্টিকর ও প্রাকৃতিক খাবারের দিকে ঝুঁকুন। আয়োডিনযুক্ত লবণের সঠিক ব্যবহার থেকে শুরু করে গয়ট্রোজেনিক খাবার সম্পর্কে সচেতনতা, সেলেনিয়াম-জিংকের উৎস সম্পর্কে জানা – এই ছোট ছোট পদক্ষেপগুলোই আপনার থাইরয়েডের স্বাস্থ্য এবং আপনার সামগ্রিক সুস্থতার উপর বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সহজলভ্য মাছ, ডাল, শাকসবজি, ঢেঁকিছাটা চালই হতে পারে আপনার ডায়েটের মূল স্তম্ভ। আপনার ডাক্তারের পরামর্শকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে, আজ থেকেই শুরু করুন থাইরয়েড নিয়ন্ত্রণে খাবার এর এই প্রাকৃতিক যাত্রা। নিয়মিত চেকআপ করুন, ফলো-আপে যান, ঔষধ সঠিক সময়ে সঠিক নিয়মে খান এবং এই লেখায় দেওয়া খাদ্য সংক্রান্ত পরামর্শগুলো বাস্তবায়নের চেষ্টা করুন। আপনার সুস্থ, প্রাণবন্ত ও সক্রিয় জীবনের দ্বারপ্রান্তে অপেক্ষা করছে এক অনন্য অনুভূতি। সেই সুখকর জীবনের জন্য আজই সিদ্ধান্ত নিন!
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।