লাইফস্টাইল ডেস্ক : পাঠকদের অনেকেই এ বিষয়ে বিভ্রান্ত হবেন। মনে হতে পারে, সিংহকে বনের রাজা বলা হয়। নিশ্চয়ই সিংহ বেশি শক্তিশালী। তাই লড়াই হলে সিংহই জিতবে।
আমরা বাঙালি, আবেগটাও একটু বেশি। বাঘ আমাদের জাতীয় পশু। সিংহের চেয়ে বাঘের প্রতিই আমাদের পক্ষপাতিত্ব থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাই আমরা হয়তো বেশিরভাগই বলব, বাঘ জিতবে।
কিন্তু কেন বাঘ জিতবে, তার ব্যাখ্যা আমরা দিতে পারব না, যদি না গুগল ঘেঁটে তথ্য বের করি। গুগল কি আমাদের বাঙালি আবেগের পক্ষে যাবে, নাকি বিশ্বজুড়ে রাজার তকমা পাওয়া সিংহকেই জয়ী ঘোষণা করবে?
সিংহের পক্ষে যারা অবস্থান নেবেন, তাদেরও যুক্তি আছে। তারা বলবে পুরুষ সিংহ আকারে বিশাল। নিশ্চয়ই বাঘের চেয়ে সিংহের ওজন বেশি, তাই শক্তিতেও এগিয়ে থাকার কথা।
এখন একটা কথা বলি। একটা দেশের রাজাই কি সবচেয়ে শক্তিশালী? গায়ের শক্তিতে রাজার চেয়ে অনেক বীরযোদ্ধাই শক্তিশালী হতে পারেন। কিন্তু সৌর্যে-বীর্যে, অর্থে, ক্ষমতায় রাজাই সবচেয়ে শক্তিশালী।
তবে আমরা এখানে রাজকীয় চালের কথা বলছি না। বলছি গায়ের শক্তির কথা, সৌর্য-বীর্যকে একপাশে সরিয়ে রেখে।
একটা পুরুষ বাঘ আর একটা পুরুষ সিংহের মুখোমুখি লড়াইয়ে হলে কী ঘটবে?
বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে একটা ঐতিহাসিক লড়াইয়ের কাহিনি জানলে অনুমান করতে পারবেন, আসলেই কে জিততে পারে। উনিশ শতকের শুরুরে দিকের কথা। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছে। কিন্তু তখনো এখান থেকে রাজতন্ত্র বিলুপ্ত হয়নি। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে আঞ্চলিক রাজারা তখনো রাজ করছেন- কেউ কেউ ব্রিটিশদের বশ্যতা মেনে, কেউ কেউ স্বাধীনভাবে। তেমনই এক রাজা ছিলেন গুজরাটের বরোদায়। গুজরাট ভারতের উত্তরাঞ্চলীয়-পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য, যেখানে এখনো বুনো সিংহ আছে। নিশ্চয়ই উনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সিংহের সংখ্যাটা বর্তমানের তুলনায় বেশি ছিল।
রাজার কি খেয়াল হলো, যুদ্ধ বাঁধাবেন বাঘে-সিংহে। গুজরাট সিংহের জন্য বিখ্যাত। তাই বরোদার রাজার আবেগটা ছিল সিংহের পক্ষেই। তিনি বাজিও ধরেন সিংহের পক্ষ নিয়ে। কিন্ত লড়াইয়ের ময়দানে সিংহ তার মান বাঁচাতে পারেনি। হেরে যায়, সঙ্গে রাজার তহবিল থেকে বেরিয়ে যায় ৩৭ হাজার রুপি।
শুধু একটা লড়াই দিয়ে পুরো দুটো প্রজাতির শক্তিমত্তা বিচার করা হয়তো ঠিক নয়। হয়তো সিংহটা শারিরিকভাবে দুর্বল বা অসুস্থ ছিল। কিন্তু বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ আপনাকে ভুল তথ্য দেবে না। তাই বৈজ্ঞিানিক তুলনাটা দেখে নেওয়া যেতে পারে।
প্রথমেই আসে আকার। খোলা চোখে সিংহের চেয়ে বাঘ আকারে কিছুটু ছোট। কিন্তু ওজনে বাঘ ঢের এগিয়ে। একটা পুরুষ সিংহের ওজন গড়ে ১৯০ কেজি, স্ত্রী সিংহের সেখানে ১৩০ কেজি। অন্যদিকে একটা পুরুষ রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ওজন গড়ে ২২৭ কেজি। স্ত্রী রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের ওজন ১৪০ কেজি। কিন্তু ওজন বেশি হলেই কি শক্তি বেশি হবে? বাঘের-সিংহের ক্ষেত্রে, এটাই সত্যি?
একটা বাঘের চোয়ালের শক্তি সিংহের চেয়ে অনেক বেশি। সিংহ প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৬৫০ পাউন্ডের ওজনের কামড় বসাতে পারে। অন্যদিকে বাঘের কামড়ের ওজন প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১০৫০ পাউন্ড।
শিকার ধরার সামর্থ্যেও বাঘ যোজন যোজন এগিয়ে। সিংহ নিজের দ্বিগুন ওজনের প্রাণী স্বীকার করতে পারে। বাঘ শিকার করতে পারে নিজের ওজনের পাঁচগুণ শক্তিশালী প্রাণীকে। আফ্রিকায় বুনো মোষ কেপ বাফোলো আছে। ৮৭০ কেজি ওজনের এই বাফোলোকে একা একা শিকার করতে পারে না সিংহ। অন্যদিকে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশে বাস করে মহীষ প্রজাতির সবচেয়ে বড় প্রাণী গৌর। একটা পুরুষ গৌরের ওজন গড়ে ১৫০০ কেজি।
রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের অন্যতম প্রিয় শিকার এই গৌর। মনে রাখতে হবে বাঘ একা একা শিকার করে, সিংহ শিকার করে দলবেঁধে। তাই সদদলবলে কেপ বাফোলো শিকার করতেই পারে পারে সিংহ। কিন্তু গৌর শিকারের সময় বাঘ কখোনেই অন্যকে সঙ্গী করে না। এখানে একটা কথা বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশে এখনো গৌর আছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জঙ্গলে। কিন্তু রয়্যাল বেঙ্গলের আবাস সুন্দরবনে গৌর নেই। বালাদেশের জঙ্গলে তাই এখন আর বাঘের গৌর শিকারের সুযোগ নেই। তবে ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য জঙ্গলগুলোতে এখনো বাঘ-গৌরের সহাবস্থান আছে।
বাঘের আকারে ছোট ওজনে বেশি। তাই এর পেশী অনেক শক্তিশালী। যেটা বড় বড় প্রাণী শিকার করতে সুবিধা হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া বাঘের পা সিংহের চেয়ে ছোট। সুতরাং শারিরিক ভারসাম্যও বাঘের অনেক বেশি। এটাও বাঘকে অনেকটাই এগিয়ে রাখে।
বাঘের শক্তিমত্তার আরেকটা প্রকাশ হলো, একা থাকার প্রবণতা। শুধু প্রজনন মৌসুমেই কিছুদিন স্ত্রী-বাঘের সঙ্গে সময় কাটায় পুরুষ বাঘ। বছরের অন্য সময় তার নিজের এলাকায় নিজেই সর্বেসর্বা। প্রায় পাঁচ শ বর্গকিলোমিটারের মতো এলাকা নিজের দখলে রাখে একটা পুরুষ বাঘ। এর মধ্যে অন্য পুরষ এমনকী বছরের বেশিরভাগ সময় স্ত্রী বাঘেরও প্রবেশ নিষেধ। কেউ যদি প্রবেশ করেও, সেটাকে জীবনপণ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েই ঢুকতে হবে।
সিংহও নিজের এলাকা ভাগ করে নেয়। তবে সেই এলাকায় পুরো একটা দল নিয়েই রাজত্ব করে। এখানেই বাঘের শক্তিমত্তার প্রমাণ যেমন মেলে, তেমনি সিংহের রাজকীয় স্বভাবের চিত্রও ফুটে ওঠে। শক্তিতে পিঁছিয়ে থাকলেও সিংহ বনের রাজা আসলে দলবদ্ধতার কারণেই। একজন রাজা যেমন পুরো পরিবার, সাম্রাজ্য নিয়ে নিজের রাজ্য চালায়, সিংহের ভেতরেও এ ধরনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। দলের ওপর তার কর্তৃত্ব, নিজে শিকার না করলেও খাবারের সেরা অংশটার দখল নেওয়া, প্রয়োজনে রাজার মতো বিলাসী জীবন-যাপন- এসবই সিংহকে রাজার মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু মুখোমুখি লড়াইয়ে সিংহের পক্ষে বাঘের সঙ্গে পেরে ওঠা সম্ভব নয় কখোনোই।
জুমবাংলা নিউজ সবার আগে পেতে Follow করুন জুমবাংলা গুগল নিউজ, জুমবাংলা টুইটার , জুমবাংলা ফেসবুক, জুমবাংলা টেলিগ্রাম এবং সাবস্ক্রাইব করুন জুমবাংলা ইউটিউব চ্যানেলে।